পঞ্চম অধ্যায়: কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র
(এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছিল ১৯৮১ সালে। এখন সোভিয়েত ইউনিয়ান দৃশ্য থেকে অবলুপ্ত হয়েছে এবং ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন কোন পক্ষ নেবে জানা নেই। কিন্তু হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের বিদ্বেষ অটুট রয়েছে। খুব সম্ভব যথাসময়ে এই ভাড়াটে গুণ্ডারা আবার বিকিয়ে যাবে ভারতের ইতিবাচক জাতীয়বাদের শত্রুদের হাতে। কমিউনিস্টরা নিজেদের দেশ ও দেশবাসীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু করতেই পারেনা।)
এতক্ষণ আমরা বিদেশী শাসনের পড়ে থাকা তলানিগুলোর ভারতীয় অর্থাৎ হিন্দু সমাজে ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করলাম। আমরা ইসলামকে চিনেছি হিংসাত্মক বৈশিষ্ট্য দিয়ে, খ্রিস্টানবাদকে তার চাতুর্য দ্বারা ও ম্যাকলেবাদকেকে সনাক্ত করেছি তার মৃদু ও ধীর বিষক্রিয়া করার ক্ষমতা দিয়ে। এবার আলোচনা করব কমিউনিজ়ম নিয়ে, যদিও এটাকে ঠিক বিদেশী শাসনের অবশেষ বলা যায় না, কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক চরিত্রের আরোপিত বিদেশী মতাদর্শ তো বটেই।
কিন্তু এগুনোর আগে একটা কথা পরিষ্কার করা দরকার, এই লেখার দ্বারা ভারত-সোভিয়েত সম্পর্কের প্রতি কোনও বিদ্বেষপূর্ণ ইঙ্গিত বা সমালোচনা নেই। এই দ্রুত পরিবর্তনশীল জগতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক পরিণত হয়ে এসেছে। সেই বন্ধুত্বের মূল্য আমরা অবশ্যই দিই, যদিও সোভিয়েতের বন্ধুত্ব ভারতের জন্য যতটা জরুরি, ভারতের বন্ধুত্বও সোভিয়েতের পক্ষে ততটাই আবশ্যক। আমরা এ ব্যাপারেও সতর্ক থাকব, যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন কোনওটাকেই আমাদের অন্যান্য বিকল্প পথগুলো রোধ করতে না পারে, বিশেষ করে যেখানে আমাদের আমেরিকান হস্তক্ষেপও মানিয়ে চলতে হচ্ছে।
যদিও কমিউনিজ়মকে ব্রিটিশ শাসনের অবশেষ বা তলানি বলা চলে না, কিন্তু এর বিকাশে ব্রিটিশ সরকারের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। ত্রিশের দশকে সরকার অ-কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের কমিউনিস্ট সাহিত্য পড়তে উৎসাহ দিত। এটা করা হতো যাতে সশস্ত্র বিপ্লব থেকে তারা পরিপুষ্ট না হয়। অনেকেই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে একই সঙ্গে কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী অথচ জাতীয়তাবাদী বীরদের ভাস্বরতায় মুগ্ধ হয়ে থাকত। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকার ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে (Communist Party of India) রীতিমতো অর্থসাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বন্ধু করে নিয়েছিল এবং এটাকে স্বাধীন রাজনৈতিক দল হিসাবে গড়ে উঠতে সাহায্যও করছিল।
আদর্শগতভাবে ভারতে কমিউনিজ়ম নানাভাবে ব্রিটিশ শাসনের তলানি ম্যাকলেবাদেরই পরিবর্ধিত রূপ। তাই যে সব জায়গায় ম্যাকলেবাদের বাড়বাড়ন্ত ছিল, সেই সব জায়গাগুলোতেই কমিউনিজ়মের সবচেয়ে জোরালো ঘাঁটি। তাই ম্যাকলেবাদ সব সময় কমিউনিজ়মের মতোই রক্ষণাত্মক ও অপরাধ স্বীকারের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থেকেছে। ম্যাকলেবাদ সর্বদা এ দেশে কমিউনিজ়মের কুকীর্তিগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সেগুলোর সাফাই গেয়ে গেছে। দুঃখজনকভাবে এটা কমিউনিস্টদের করা ঘৃণ্যতম অপরাধগুলোকেও বরদাস্ত করেছে বা বড়োজোর সেগুলোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে গেছে। সংসদীয় বিতর্কের লম্বা রেকর্ড সাক্ষ্য দেয়, সর্দার প্যাটেলের মৃত্যুর পর কীভাবে ট্রেজ়ারি বেঞ্চ কমিউনিস্ট সদস্যদের অসাংবিধানিক এবং একেবারে অনৈতিকভাবে প্রভাব খাটানো অপভাষণ ও ভর্ৎসনার কাছে নত হতে বাধ্য হয়েছিল।
কমিউনিজ়ম ও ম্যাকলেবাদের আদর্শগত নৈকট্য আসলে উভয়েই পশ্চিমী বস্তুবাদী অধিবিদ্যা (metaphysics), বিবর্তনমূলক সমাজবিজ্ঞান (evolutionistic sociology), উপযোগিতাবাদী নীতি (utilitarian ethics), ভোগবাদী মনস্তত্ত্ব (hedonistic psychology) ইত্যাদি থেকে উদ্বুদ্ধ হওয়ার কারণে। এই বিশ্ব-দর্শনে সব মানুষই একই ধাঁচের আয়ুধ বা যন্ত্র নির্মাতা কিংবা মিস্ত্রি। একটা কেন্দ্রীকৃত অর্থনীতি ও শহুরে সমাজ এই বিশ্ব-দর্শনের স্বাভাবিক পরিণতি। বৃহত্তর আদর্শের নিরিখে মার্ক্সবাদ হল ধনতন্ত্রেরই অবধারিত পরিণতি। মার্ক্স ধনতন্ত্রের প্রতি বিশেষ বাছাই করা শব্দে প্রশংসা ও কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের প্রতি বিশেষ তাচ্ছিল্য পোষণ করতেন। সমাজবাদের অন্যান্য ধারাগুলির একমাত্র অপরাধ হল তারা যান্ত্রিকতা শিল্পায়ন ও কেন্দ্রীকরণ দ্বারা মানুষকে অসহায় যান্ত্রিক সত্তায় পরিণত করার বেপরোয়া ধনতান্ত্রিক প্রয়াসকে বাধা দিয়েছিল।
পাশ্চাত্যের ধনতন্ত্রবাদ (ক্যাপিটালিজ়ম) ও পূর্ব ইওরোপের কমিউনিজ়মের মধ্যে ফারাক তৈরি হয়েছিল ধনতান্ত্রিক সমাজগুলো দার্শনিক নমনীয়তা, সংসদীয় গণতন্ত্র, স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম, স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদির মাধ্যমে রাজনৈতিক বহুত্ববাদকে রেখে দেওয়ায়। অন্যদিকে কমিউনিস্ট সমাজগুলি মার্কসীয় দর্শনকে একটা রক্ষণশীল ব্যবস্থায় আবদ্ধ করে রাখে। এর ফলে কালক্রমে এমন গোঁড়ামি দানা বাঁধে যে মার্কসবাদ শেষ পর্যন্ত ইসলাম বা খ্রিস্টানবাদের মতোই একটা সেমিটিক ধর্মীয় মতবাদে পরিণত হয়। বার্ট্রান্ড রাসেল কমিউনিজ়মকে খ্রিস্টান কট্টরতার সঙ্গে তুলনা করে ভুল করেননি। খ্রিস্টান গীর্জার যাবতীয় বৈশিষ্ট্য এতে প্রতিফলিত। যেমন একমাত্র পরিত্রাতা, একমাত্র প্রকাশ, একমাত্র পোপ, একমাত্র পৌরোহিত্য, একমাত্র ব্যাপটিজ়ম বা দীক্ষা এবং একমাত্র পবিত্র বাণী। কমিউনিস্ট প্রশাসন কিছুতেই মানুষের স্বাধীনতার সামূহিক শত্রু ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
তবে আদর্শগত সাদৃশ্য থাকলেও কমিউনিজ়ম ম্যাকলেবাদের প্রকারভেদ নয়, যদিও প্রথমটি দ্বিতীয়টি দ্বারাই পরিপুষ্ট হয়। কমিউনিজ়মের অনুপ্রেরণা পশ্চিম থেকে আসেনি। বরং তার বিপরীতে এর প্রশ্নাতীত বাক্য ও নির্দেশিকা এসেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। ব্যতিক্রম হিসাবে চীনও কিছুদিন এর সৌজন্যে আলোকিত ছিল।
মার্কসবাদী দর্শন নিয়ে আলোচনার কিংবা লেনিনবাদ, স্টালিনবাদ বা মাওবাদের কলাকৌশলের নিয়ে চর্চা করার সময় এটা নয়। এখানে আলোচ্য কমিউনিজ়ম হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতিতে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি করে সেইগুলো। বহু ক্ষেত্রেই ভারতের কমিউনিজ়ম আদৌ মার্কসইজ়ম, লেলিনিজ়ম, স্টালিনিজ়ম, মাওইজ়ম কোনওটাই তেমন অনুসরণ করে না। শুধু মাত্র পার্টিলাইন বদলানোর প্রয়োজনে বৃহত্তর সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিকে প্রভাবিত করা ও দলীয় ক্যাডারদের ওপর চাল মারার জন্য নাম কা ওয়াস্তে একটা আদর্শের মোড়ক বজায় রাখে।
তাহলে কমিউনিজ়ম কী?
কমিউনিজ়মের গবেষক ও ঐতিহাসিক যাঁরা বর্তমান লেখকের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ, যা লিপিবদ্ধ করেছেন তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই যে, কমিউনিজ়ম সোভিয়েত ইউনিয়ানের বৈদেশিক নীতির একটি অস্ত্র যা দিয়ে তারা বিশ্ব শাসন করতে পারে; বিশেষ করে স্টালিনের সোভিয়েত রাশিয়া ও বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা হিসাবে নিরঙ্কুশ উত্থানের পর থেকে। ক্রুশ্চেভ গণহত্যাকারী স্টালিনের মুখোশ খুলে দেওয়ার ফলে প্রোলেতারিয়েতদের স্বর্গরাজ্য রূপে সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে গড়ে ওঠা মিথটা উড়ে গেল। চীনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ায় বিশ্বে কমিউনিস্ট একাত্মতা চুরমার হয়ে গেল। কিন্তু এই ধাক্কাগুলো মোটামুটি কাটিয়ে ওঠায় কমিউনিস্ট আন্দোলন নিজের স্ব-ধার্মিকতা বা আত্মতুষ্টি ফিরে পেল; এবং সেইসঙ্গে ফিরে পেল সোভিয়েত ইউনিয়ানের বৈদেশিক নীতিতে নিজের ভূমিকাও।
সুতরাং প্রতিটি দেশে ইতিবাচক জাতীয়তাবাদের সাথে কম্যুনিজ়মের বিরোধ বাধাই স্বাভাবিক এবং অনিবার্য। ভারতও এর ব্যতিক্রম হতে পারে না। ইতিবাচক জাতীয়তাবাদ বলতে আমরা সেই জাতীয়তাবাদ বুঝি যা তার নিজস্ব সংস্কৃতিগত এবং আর্থ-রাজনৈতিক ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে। এইরকম জাতীয়তাবাদের বিশ্বের ঘটনাবলী দেখার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী এবং বিশ্বের শক্তিগুলির পারস্পরিক জোট মূল্যায়ন করারও নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। এই ধরণের জাতীয়তাবাদ নিজের স্বার্থ রক্ষার ও লক্ষ্য পূরণের জন্য নিজস্ব অতীত অভিজ্ঞতার দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। এই স্বার্থ ও লক্ষ্যগুলি বিশ্ব রাজনীতির কোনও নির্দিষ্ট পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ানের পররাষ্ট্র নীতির স্বার্থ ও লক্ষ্যগুলির সঙ্গে মিলে যেতেও পারে। তবে তা না হওয়ারও সমান সম্ভাবনা।
ভারতে কমিউনিজ়ম এবং ইতিবাচক জাতীয়তাবাদের মধ্যে এই মৌলিক সংঘাত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শেষ পর্যন্ত চরম নাটকীয় পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সেটি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী এবং তার তাৎক্ষণিক ও সহিংস মূলোৎপাটনের পক্ষপাতী ছিল। দলটি মুসলিম লীগেরও বিরোধিতা করেছিল তাকে ভূমিজ স্বার্থের দোসর ষড়যন্ত্রী হিসাবে চিহ্নিত করে। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দৃষ্টিতে এই দলটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেরই একটি বিপ্লবী শাখা ছিল। কংগ্রেসের সোশ্যালিস্ট পার্টি ব্রিটিশ সরকার দ্বারা নিষিদ্ধ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে তার মঞ্চটি ব্যবহার করার অনুমতিও দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৪১ সালে হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার সময় অকস্মাৎ মঞ্চের পর্দা উন্মোচিত হয়ে সবার সামনে কমিউনিজ়মের আসল চেহারাটা বেরিয়ে পড়ে।
কংগ্রেস নেতৃত্ব দীর্ঘ দু বছর ধরে ব্রিটিশদের সঙ্গে আলোচনা করে রফাসূত্রে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল। ব্রিটিশদের জেদি একগুঁয়ে মনোভাব দেখে কংগ্রেস ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন শুরু করবে স্থির করে। কংগ্রেসের মধ্যে কমিউনিস্টরা বম্বের AICC অধিবেশনে ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ অঙ্গীকারের বিরোধিতা করে বসে। তারা প্রচার করা শুরু করে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ জনতার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়নকে ব্রিটেনের শত্রুরা আক্রমণ করেছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধ নিজের অনুপ্রেরণা ও তাগিদেই এগিয়েছে। কিন্তু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নিজের সর্বশক্তি দিয়ে এর বিপরীত দিকে হেঁটেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তখন কমিউনিস্টদের কাছে ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রে পর্যবসিত, মুসলিম লীগ হয়ে গেল মুসলিম জনগণের মুখপাত্রের অভ্যুত্থান, আর পাকিস্তানের দাবি হয়ে দাঁড়াল মুসলিম জাতীয়তাবাদের সঙ্গত অভিব্যক্তি যা কংগ্রেসের অবিলম্বে মেনে নেওয়া উচিত। পরবর্তী কাহিনী খুব পরিচিত। অর্থাৎ কীভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধকে ফ্যাসিজ়মের সহযোগী হিসাবে দাগানো হল, কীভাবে সুভাষচন্দ্র বসুকে ‘নাৎসি কুত্তা’ ও ‘জাপানি ইঁদুর’ বলে ছোট করা হল, কীভাবে গোপনে আন্দোলন সংগঠিত করা সমাজবাদী ও ফরোয়ার্ড ব্লক কর্মীদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট ক্যাডাররা ব্রিটিশদের হয়ে চরবৃত্তি করেছিল, এবং কীভাবে অধিকারী ও আশরাফের মতো কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীরা তথ্য পরিসংখ্যান দর্শিয়ে, বৌদ্ধিক যুক্তি দিয়ে এবং আবেগসিক্ত স্লোগান সহকারে পাকিস্তান গঠনের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেছিল – সেইসব বৃত্তান্ত।
পাকিস্তান গঠনে কমিউনিস্টদের অবদান মুসলিম লীগের ঠিক পরেই। সোভিয়েত ইউনিয়ান ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর ভারত দখলের জন্য একটা ঘাঁটি খুঁজছিল। সেই পরিকল্পনা সফল না হওয়ার কারণ পাকিস্তানের ক্রমশ আমেরিকার নাক গলানোর ক্ষেত্র হয়ে ওঠা। তখন থেকে ভারতের কমিউনিস্টরা দেশভাগের জন্য ভারতীয়দের ইতিবাচক জাতীয়তাবাদকে দোষারোপ করে চলেছে যা কিনা মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়েছিল। কমিউনিস্টদের স্লোগান বদলাতে পারে, কিন্তু ইতিবাচক জাতীয়তাবাদের প্রতি তাদের বিদ্বেষ চিরস্থায়ী।
ভারতে ইতিবাচক জাতীয়তাবাদের উৎস হল ‘সনাতন ধর্ম’ এবং হিন্দুদের সুদীর্ঘ ইতিবৃত্ত। হিন্দু সমাজই এ দেশের ইতিবাচক জাতীয়তাবাদের একমাত্র ভিত্তি।
মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলি ইতিবাচক জাতীয়তাবোধে অংশ তখনই নিতে পারে, যদি সনাতন ধর্ম কর্তৃক নির্ধারিত সর্বজনীন নীতি তাদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থের পক্ষে থাকে। ভারতে কমিউনিজ়ম সনাতন ধর্ম এবং হিন্দু সমাজকে ধ্বংস করার অভিমুখে ঝুঁকেছে। তাই নিজেদের স্বার্থেই মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের ইতিবাচক জাতীয়তাবাদের মূল স্রোতে ভাসতে কমিউনিস্টরা বাধা দেয়। এই বিষয়টা হিন্দু বিদ্বেষী সংযুক্ত বাহিনীর মুখোশ খোলার সময় আলোচনা করব। এখানে আমরা কেবল হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কমিউনিজ়মের কয়েকটি প্রধান লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে বলব। তারা যে পন্থা অনুসরণ করে সেগুলো হল:
১। কমিউনিজ়মের সর্বপ্রথম এবং প্রধান ভেদ্য লক্ষ্য হল হিন্দু সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত সনাতন ধর্ম এবং তাকে আশ্রয় করে জীবনযাপন করা বিশাল সংখ্যক সাধু, ভক্ত ও তাদের রহস্যে ভরা জীবন। সনাতন ধর্মের অতুল ঐশ্বর্যকে নির্লজ্জ কুসংস্কার, বিবমিসা উদ্রেগকারী অশ্লীলতা এবং বৃদ্ধ পুরোহিত-তন্ত্রের সংমিশ্রণ বলে উপহাস করা তাদের অন্যতম রণকৌশল।
২। এর পর আক্রমণ শানায় হিন্দু ধর্মশাস্ত্রগুলির প্রতি, যেগুলো সনাতন ধর্মের উৎস এবং যেগুলো সামগ্রিকভাবে সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের নৈতিকতার আধার। কমিউনিজ়ম এই ধর্মশাস্ত্রগুলিকে নিন্দা করতে গিয়ে আদিম নির্দেশিকা, সুচতুর নৈতিকতা, বর্ণভিত্তিক নিপীড়ন, অস্পৃশ্যতা, নারীর অবক্ষয়, ব্রাহ্মণ আধিপত্য, সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব ইত্যাদি যতরকম অপবাদ হতে পারে দিতে থাকে।
৩। তৃতীয়ত, কমিউনিজ়ম হিন্দু দর্শনগুলিতেও মনোনিবেশ করে, যেগুলো এক ও অভিন্ন সনাতন ধর্ম থেকে উৎসরিত হয়ে বহু ধারায় প্রবাহিত হয়ে বিবিধ আধিবিদ্যাগত দৃষ্টিকোণকে নানাভাবে উদ্ভাসিত করে, তাদের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য নিরূপণ করে, এবং সশক্তিকরণ ও রক্ষা করে চলে। এই সমস্ত দর্শনকে ‘লোকায়ত’ দমন করার ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্র হিসাবে ধিক্কার জানাতে থাকে। তাদের মতে ‘লোকায়ত’ই একমাত্র বৈজ্ঞানিক দর্শন যা বিপ্লবী নীতি দ্বারা পরিচালিত। রাহুল সাংকৃত্যায়ণ ছিলেন হিন্দী পড়ুয়া জনসাধারণের মধ্যে এই কমিউনিস্ট বিদ্যার এক দুর্দান্ত বিক্রেতা। তাঁর কয়েকটি রচনা অন্য ভাষাতেও অনুবাদ করা হয়েছে। তিনি এ ব্যাপারে সত্যিই খুব উদ্যোগী ছিলেন। নিজের এক তত্ত্বে দাবি করেছিলেন, একমাত্র নিজের ভুল করে প্রচার করা প্রমাণহীন জন্মান্তরবাদ ছাড়া গৌতম বুদ্ধ আর সমস্ত ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে মার্কসবাদের প্রচার করতেন।
৪। চতুর্থত কমিউনিজ়ম যেখানে সত্যিই অপরিমেয় শ্রম ও চেষ্টা বিনিয়োগ করেছে, সেটি হল হিন্দু ইতিহাস এবং হিন্দুদের বীরত্বের ইতিহাসকে একেবারে নাকচ করে দেওয়া। কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকদের একটি পুরো ব্যাটালিয়ন বছরের পর বছর ধরে হিন্দু ইতিবৃত্তের প্রাচীরে আঘাত করে গেছে, যার পেছনে নাকি হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্যবাদ বা পুরুষতান্ত্রিকতা নিজের কুৎসিত মুখ লুকিয়ে রেখেছে। তারা হিন্দুদের গর্ব করার মতো প্রতিটি বীর, প্রতিটি সময়কাল, প্রতিটি পর্ব ও প্রতিটি নিদর্শনকে নিয়ে তীব্র বিদ্রূপ করে গেছে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে যখন শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হিন্দুরা উৎকর্ষের চরম শিখরে, সেই সময়কার সমৃদ্ধিকে Ancient India: An Introductory Outline-এর লেখক ডি.এন. ঝা একটি মিথ বা কিংবদন্তী বলে একেবারে নস্যাৎ করে দিয়েছেন। বইটি নতুন দিল্লীর People’s Publishing House প্রকাশনা দ্বারা সম্প্রতি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। অন্যান্য কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকরা তো মহারাণা প্রতাপ, শিবাজী ও গুরু গোবিন্দ সিং-কে শান্তিপূর্ণ মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে স্থানীয় বিদ্রোহী হিসাবে চিত্রিত করেছেন। সেই একই ঐতিহাসিকরা বিজয়ী রক্তপিপাসু আগ্রাসী ইসলামি শাসকদের যাবতীয় অপকর্মকে হয় পুরো সাদা চুনকাম করে ঢেকে দিয়েছে কিংবা তাদের ভালো কীর্তি দ্বারা প্রশমিত করতে চেয়েছেন, অথবা সাম্রাজ্য গঠনের প্রচলিত রীতি বলে ব্যাখ্যা করে সাফাই দিয়েছেন।
৫। সবশেষে কমিউনিস্ট নৃতাত্ত্বিক ও সমাজবিজ্ঞানীরা হিন্দুদের সামাজিক প্রতিষ্ঠান, রীতিনীতি, আচার পদ্ধতি তথা শিষ্টাচারের গভীরে ডুব দিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও শ্রেণীস্বার্থের সন্ধান পেয়েছেন। আমাদের বলা হয় হিন্দু সমাজ বরাবর অস্বাস্থ্যকর ছিল একমাত্র সম্ভবত বৈদিক যুগ ছাড়া, যখন রোমিলা থাপারের মতে আর্যরা গরুর মাংস খেত। প্রাচীন আর্যদের গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে থাপার মহোদয়া এমন আবিষ্ট ছিলেন, যে বারংবার যে কোনও সূত্রে এমনকি মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষে পাওয়া নৃত্যরত মেয়েটির বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়েও প্রসঙ্গটিতে ফিরে আসতেন।
হিন্দুদের সব কিছুর প্রতি কমিউনিজ়ম কতটা বিদ্বেষপ্রবণ হতে পারে, তা একটি ঘটনা প্রমাণ করে। কয়েক বছর আগে এস.এ. ডাঙ্গে ও তাঁর জামাতা দেশপাণ্ডে ঘটনাটিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। দেশপাণ্ডে বেশ বৈদগ্ধপূর্ণ বই রচনা করে দেখান যে, আধুনিক গণিত ও বিজ্ঞানের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি যার মধ্যে কমিউনিস্ট মতানুসারে আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ নীতি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদও পড়ে, সর্বপ্রথম হিন্দু দর্শন শাস্ত্রগুলো আবিষ্কার করেছিল, বিশেষত ‘সাংখ্য’ ও ‘বেদান্ত’। এর আগে বেশ কয়েকজন কমিউনিস্ট প্রবক্তাও হিন্দু দর্শনগুলিকে বস্তুবাদী ছাঁচে ঢালার অনুরূপ অনুশীলনে লিপ্ত হয়েছিল। ভারতের দার্শনিক ঐতিহ্যের তলায় প্রবাহিত বৈপ্লবিক স্রোতের বিশেষজ্ঞ ও যথাযথ ব্যাখ্যাকার হিসাবে এই দলটি নিজেদের মেলে ধরত। দেশপাণ্ডের যেটা ভুল হয়েছিল তা হল, তিনি প্রাচীন হিন্দু অতীত নিয়ে প্রকৃতই গর্ব প্রকাশ করেছিলেন এবং কোনওভাবেই হীনতা ব্যক্ত করেননি। বইটিকে শিক্ষাগত উৎকর্ষ বা কৃতিত্ব হিসাবে তুলে ধরে ডাঙ্গে নিজেই তার একটি ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরিণতি কী হতে চলেছে, তাঁদের দু’জনের ধারণা ছিল না। পূর্বোক্ত কমিউনিস্ট দলটি তাদের মাথার ওপর এক টনের ইটের বোঝার মতো চেপে বসে পড়ল। “Marxism on Vedanta” বিষয়ক একটা সেমিনার ডেকে ডাঙ্গেকে ভুল স্বীকার করতে বাধ্য করায়। বোম্বের যে সংগঠন থেকে দেশপাণ্ডের বইটি প্রকাশিত হয়েছিল তাদের সার্কুলেশন ফিরিয়ে নিতে হয়।
গঠনমূলক জাতীয়তাবাদীদের অপবাদ দিতে কমিউনিজ়ম যে পদ্ধতি ভারতে প্রয়োগ করে, সারা বিশ্বেও সেটাই করে এসেছে। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে সেই পদ্ধতিগুলোর প্রতি এবার মনোনিবেশ করা যাক:
১। ভারতে কমিউনিজ়ম যে ভাষা গড়ে তুলেছে, তাকে জর্জ ওরওয়েল বর্ণনা করেছেন ‘doublespeak’ বা দ্বিচারিতা হিসাবে। এই ভাষায় কমিউনিস্টদের বিশ্বাসঘাতক ও একনায়কতন্ত্রী শক্তিকে ‘দেশপ্রেম’ ও ‘গণতান্ত্রিক শক্তি’, কমিউনিস্টদের সহযোগীদের প্রগতিশীল মানুষ, ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদকে ধর্মনিরপেক্ষতা, আর ইতিবাচক জাতিয়তাবাদকে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা হিসাবে উপস্থাপনা করা হয়। অনেকেই বুঝতে পারে না এই দ্বিচারিতার চালাকি, তাই তাদের ফাঁদে পড়ে। [1]
২। ভারতে কমিউনিজ়ম একটা লাগাতার প্রক্রিয়া যা কার্ল পপার ‘সমাজের মধ্যে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বলে চমৎকার ব্যাখ্যা করেছিলেন। সমস্ত শ্রমজীবী শ্রেণী, কৃষিজীবী, মধ্যবিত্ত, মজুর, ধর্মনিরপেক্ষতা – সবকিছুর বিরুদ্ধে একের পর এক এরা ষড়যন্ত্র রচনা করে যায়। এই চক্রান্তে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও পুরুষতান্ত্রিক বৈষম্যবাদের সঙ্গে ধনতন্ত্র, জমিদার তন্ত্র, ইচ্ছাকৃত অস্পষ্টতা, রক্ষণশীলতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং সব শেষে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদকে জুড়ে দেয়। অতএব বাইরের আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ ও অন্দরের হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ার জন্য গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিগুলোকে কমিউনিস্ট আন্দোলনে শামিল হতে ডাক দেওয়া হয়। এর ফলে কমিউনিস্ট ক্যাডারদের মস্তিষ্ক না খাটিয়ে অনুধাবনের বিরল অগভীরতা জন্মায়। তারা যত কম জানে ও ভাবে তত ভালো বোধ করে এবং কাজও করতে পারে। সাম্প্রতিককালে কমিউনিজ়ম নতুন এক ষড়যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে – মুসলিমরা উন্নয়নের সামন্য চিহ্ন দেখালেই নাকি হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা তাদের শেষ করে দিতে চাইছে।
৩। কমিউনিজ়ম ভারতে প্রতিপক্ষদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়ার জন্য কড়া গালাগালির একটা প্রবণতা তৈরি করেছে। এর কিছু নমুনা তাদের অন্তর্নিহিত বিষের খানিকটা প্রকাশ করে। ১৯৪৮-৫০ সালে রানাডিভ পার্টি-লাইনের সময় মহাত্মা গান্ধীর মুখোশ খোলা হয়েছিল ‘চতুরতম বুর্জোয়া শয়তান’ (cleverest bourgeois scoundrel) হিসাবে, রবীন্দ্রনাথকে বলা হল ‘মাগীর দালাল’ অর্থাৎ পতিতালয়ের দালাল। তবে সেরা নিন্দাটা সংরক্ষিত ছিল সরদার প্যাটেল এবং পণ্ডিতনেহরু এই দুজনের জন্যই – ‘ফ্যাসিবাদী জুটি’ হিসাবে। প্রখ্যাত বাংলা মাসিক “পরিচয়” পত্রিকায় এই দুজনের সম্পর্কে দীর্ঘ কবিতা বেরিয়েছিল এই মর্মে, যে তাঁরা আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের পরিচর্যায় ষড়যন্ত্র করছেন। এর একটি পংক্তি তাঁদেরকে “শালা শুয়োরের বাচ্চা, বিড়লা টাটার জারজ সন্তান” বলে অভিহিত করেছিল। কিন্তু আপনি কম্যুনিস্টদের অতীতে করা কোনও কীর্তিকলাপ নিয়ে খোঁচা দিতে পারবেন না। তারা সর্বদা তাদের ভুল স্বীকার করে প্রকাশ্যে এবং সেটা করে কিছুটা বুক বাজিয়ে নিজেদের পার্টির লাইন পরিবর্তন করার আদেশ পেলেই। বর্তমানে কমিউনিস্টদের যাবতীয় নোংরা অপভাষ ধাবিত হচ্ছে ইতিবাচক জাতীয়তাবাদী শিবিরের বিরুদ্ধে। এই শিবিরের মানুষজনরা প্রতিদিন সাম্প্রদায়িক, পুরুষতান্ত্রিক, সংখ্যালঘুদের ফ্যাসিস্ট হত্যাকারী, গণহত্যা সংগঠনকারী, প্রতিক্রিয়াশীল ও রক্ষণশীল পুনর্জাগরণবাদী হিসাবে নিন্দিত হচ্ছে। সুরটি এখনও মৃদু, কারণ মুহূর্তের বিজ্ঞপ্তিতে কত সহজে এই মিথ্যাচার ধরা পড়তে পারে সে কথা মাথায় রেখেই। কিন্তু যখনই দরকার হবে যে কোনও মুহূর্তে এটি পূর্ণ শক্তিতে বিস্ফোরণ শুরু করবে। [2]
হিন্দু সমাজ মূলত স্থিতধী সুস্থ সমাজ যা বিভিন্ন ধরণের বিষাক্ত ও লম্বা চওড়া বাতেলাবাজদের নিয়েও সহিষ্ণুতার সঙ্গে হাসি মুখে সহাবস্থান করতে পারে। আজ ভারতে কমিউনিজ়ম এতটা ক্ষমতা ও মর্যাদা অর্জন না করে ফেললে হিন্দুরা কমিউনিস্টদের উন্মাদ নির্বোধের দল হিসাবে বরখাস্ত করতেই পারত। কমিউনিজ়ম বলা বাহুল্য বিস্তৃত ম্যাকলেবাদ ও একটি নেতিবাচক জাতীয়তাবাদ থেকেও শক্তি সঞ্চয় করেছে। এর চালিকাশক্তি পশ্চিমী বিরোধিতা বা শত্রুতা এবং পৃথিবীর ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে ফাঁপানো ফোলানো ধারণার চেয়ে উন্নততর কিছু নয়। কিন্তু ভারতে কমিউনিজ়মের মূল শক্তির উৎস সোভিয়েত থেকে বিভিন্ন পথ ঘুরে আসা অপরিমিত ও ক্রমবর্ধমান আর্থিক সহায়তাপুষ্ট ভাণ্ডার। এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন কোন কোন চ্যানেলে ভারতে তার পঞ্চম-স্তম্ভটিকে আর্থিক মদত দিয়ে যাচ্ছে সেসব সনাক্ত করার জায়গা এটা নয়। আমরা এখানে উদ্বিগ্ন কমিউনিস্ট আন্দোলন এই অর্থ দিয়ে কী করে তাই নিয়ে। নিম্নলিখিত বিষয়গুলির বিশেষ মনোযোগ প্রাপ্য:
১। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন ইংরেজীর পাশাপাশি ভারতীয় ভাষাগুলির বৃহত্তম প্রেস তথা সংবাদ মাধ্যম তৈরি করেছে। এরা অনেকগুলি দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক এবং অনিয়মিত সাময়িকী চালায়। এই কাগজপত্র এবং জার্নালগুলির বেশিরভাগ বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য বিজ্ঞাপনগুলির প্রতি ততটা মনোযোগী নয় যা সাধারণ সংবাদ প্রতিষ্ঠানের আয়ের প্রধান উৎস। এই দলীয় অঙ্গগুলি চালাতে গিয়ে যে ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা।
২। কমিউনিস্ট আন্দোলন সর্বাধিক সংখ্যক প্রকাশনা সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারা ইংরেজী পাশাপাশি ভারতীয় ভাষাতেও কমিউনিস্ট সাহিত্য প্রকাশ করে। এই সাহিত্যের বেশির ভাগই প্যামফ্লেট আকারে, যেখানে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক যাবতীয় বিষয় নিয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরা হয়। সম্প্রতি কমিউনিস্ট প্রকাশনা সংস্থাগুলি বৌদ্ধিক অবদানের জন্য মোটা ভেট দিয়ে প্রকাশনার কাজ শুরু করেছে এই শর্তে যে, এটি কমিউনিস্টপন্থী হবে কিংবা কোনও কমিউনিস্ট বা তার সমমনস্কদের দ্বারা রচিত হবে। একটি নতুন ধারা হল পাঠ্য বইয়ের প্রকাশনা, বিশেষত ভারতীয় ইতিহাসের ওপর। কম্যুনিস্ট অধ্যাপকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলি নিয়ন্ত্রণ করার যখনই এবং যেখানেই সুযোগ পান, তখনওই এই বইগুলি সুপারিশ করেন। আর এমনটা আকছার ঘটে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগগুলি সমস্ত রকম ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে কমিউনিজ়মের আস্তানা হয়ে উঠেছে। এই জাতীয় সাহিত্য – হালকা হোক বা ভারি এমন দামে বিক্রি করা হয়, যা ব্যয়ের একটি অংশও পূরণ করতে পারে না। খুচরো বিক্রেতাদের দেওয়া বড়সড় ছাড়গুলি এই ফারাক আরও বাড়িয়ে তোলে। যে প্রকাশনা সংস্থাগুলি কমিউনিস্ট আন্দোলন দ্বারা অধিকৃত কিংবা ভাড়ায় খাটে, তাদের জন্য প্রশস্ত জায়গা বরাদ্দ থাকে এবং তারা সর্ব স্তরে প্রচুর বেতন দিয়ে কর্মী রাখে। এই সংস্থাগুলোর লোকসানও বিশাল।
৩। আন্দোলনটি একটি ক্যাডার-ভিত্তিক আন্দোলন। এখানে নেতা ও কর্মীদের মধ্যে একটি সুদূরপ্রসারী স্তরবিন্যাস রয়েছে। তারা সবাই বেতনভোগী কর্মী। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পূর্ণ সময়ের, বাকিরা খণ্ডকালীন। নেতাদের পোষা হয় শ্রমিকদের চেয়ে অনেক বেশি বেতন দিয়ে। তবে আন্দোলনটি তার সদস্যদের জন্য আয়োজিত কর্মীসভাগুলোর পেছনে যে খরচ করে সে কথা মাথায় রাখলে শ্রমিকদের বেতন এবং ভাতাও অপ্রতুল নয়। বেতন, ভাড়া, খাদ্য, পোশাক, পরিবহন ও অন্যান্য বিভিন্ন খাতে মাসের পর মাস বছরের পর বছর বিশাল অর্থ ব্যয় করে চলেছে কমিউনিস্ট আন্দোলন।
৪। আন্দোলনটি ‘সাম্রাজ্যবাদ’-এর বিরুদ্ধে ও ‘সাম্প্রদায়িকতার’ বিরুদ্ধে এবং ‘শান্তি’-র পক্ষে লড়ার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক, শিক্ষার্থী, যুব-সম্প্রদায়, মহিলা, শিশু, লেখক, শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তোলা বহু সংগঠন রক্ষণাবেক্ষণ করে ও কর্মী পোষে। এই সামনের সারির সংগঠনগুলোর বেশির ভাগেরই নিজস্ব অফিস এবং নিজস্ব কর্মী রয়েছে। তারা তাদের নিজস্ব পত্রিকা এবং সাময়িকী প্রকাশ করে। এই সংক্রমণ চক্রগুলো রক্ষণাবেক্ষণ এবং সচল রাখতে যে খরচ হয় তা লেনিনের ভাষায় considerable অর্থাৎ অঙ্কটা ‘যথেষ্ট বেশি’।
৫। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন ঘনঘন সম্মেলন, কংগ্রেস, জনসভা ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য সুপরিচিত। বহু সংখ্যক মানুষকে বহু দুর থেকে বহুবার এইসব সমাবেশে নিয়ে আসা নিয়ে যাওয়া, পার্টির প্রস্তাব পাস করানো এবং পার্টির স্লোগান দেওয়ার জন্য অর্থ দেওয়া হয়। কমিউনিস্ট বিক্ষোভগুলিতে বিশেষত কলকাতার মতো বড় শহরগুলিতে প্রতিদিন মাথাপিছু পারিশ্রমিকের কড়ারে প্রচুর অংশগ্রহণকারীকে ভাড়া নেওয়া হয়। এই জনতার ভিড় চালিত করার জন্য থাকা, খাওয়া ও পরিবহনের সমস্ত ব্যয় আন্দোলনই বহন করে। এই অনুষ্ঠানগুলিতে পোস্টার, প্ল্যাকার্ড এবং ঝাণ্ডার প্রাচুর্য দেখবার মতো। বলা বাহুল্য সে সবেও বিশাল খরচ।
প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন বা দলকে তার স্বাভাবিক কাজকর্মের জন্য যে নিয়মমাফিক ব্যয় করতে হয়, তা আমরা গণনার মধ্যে আনছি না। যে দলগুলি কোনও সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে না, তারা খুব ভালো করেই জানে যে এই সাধারণ নিত্যনৈমিত্তিক খরচগুলির জন্যও অর্থ জোটানো কতটা কঠিন। সে দিক থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনগুলো যে বিপুল খরচ করে, তা ভারতীয় রাজনীতিতে তার আকার ও তাৎপর্যের তুলনায় খুবই অস্বাভাবিক। তুলনায়, ক্ষমতাসীন কংগ্রেস পার্টি একটি দরিদ্র দল। অর্থ সংগ্রহের জন্য এদের যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়, তা লোক জানাজানি হয়ে গেলে তা পার্টির পক্ষে বেশ অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। অথচ স্লোগানের পরেই কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে জিনিসটি কখনও দুর্লভ হয় না, তা হ’ল অর্থ। এভাবেই এটি নিজেদের সর্বদা গরীবের দ্বারা গরীবের স্বার্থে ও গরীবদের করা আন্দোলন প্রতিপন্ন করার মতো অবস্থান টিঁকিয়ে রেখেছে। শঙ্কর একবার একটি কার্টুন আঁকেন, যাতে দেখা যায় একজন সুসজ্জিত উচ্চবিত্ত কমিউনিস্ট কর্মী একজন নগ্ন ও অন্ধ ভিক্ষুকের কাছ থেকে শান্তির জন্য অনুদান চাইছে, এবং ভিখারীটিকে গালাগাল দিচ্ছে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধবাজ এজেন্ট বলে যে নিজের পয়সা দিতে চায় না।
পাদটীকা
1 See Sita Ram Goel, Perversion of India�s Political Parlance, Voice of India, New Delhi, 1984.
2 The Communists who control The Times of India at present have already come out with this rhetoric.
লেখক: সীতারাম গোয়েল
অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়