ভূমিকা/ অনুবাদকের নিবেদন
শ্রী সীতারাম গোয়েলের লেখা “The Hindu Society under Siege” অনুবাদের দায়িত্ব যখন পেলাম, তখন আশা করিনি চর্বিতচর্বণের বাইরে নতুন কিছুর সন্ধান চল্লিশ বছর আগে লেখা পুরোনো এই বইটিতে পাওয়া যাবে। এমনিতে ইংরিজিতে আমি দিক্গজ নই। প্রতিটা শব্দের অর্থ যথাসম্ভব বুঝে অনুধাবন করে বাংলা বাগ্ধারা ও শৈলী বজায় রেখে অনুবাদ কর্ম করতে গিয়ে যথেষ্ট নাকাল হতে হলেও মনে হল আমার শ্রম সার্থক। বইটা যাকে বলে ‘eye opener’ অনেকটা তাই, তবে তাদের জন্য যাদের চোখ সত্যিই খোলেনি; যারা জেগে ইচ্ছাকৃত চোখ বুজে রেখেছে তারা সব কিছুর ঊর্ধ্বে বা বলা ভালো বাইরে। লেখকের রাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যদ্বাণী কতটা যথার্থ, তা সাম্প্রতিকতম সমাজের দিকে তাকালেই হাতে-কলমে প্রমাণ পাওয়া যায়।
“কোণঠাসা হিন্দু সমাজ”। হিন্দু সমাজের অবরুদ্ধ দশার জন্য হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতিকেই দোষারোপ করাটা খুব সহজ, অনেকটা victim blaming-এর মতো। কিন্তু কি কি কারণে তার এই দুর্দশা, সেগুলো নিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য ও পূর্ণাঙ্গ আলোচনা খুব কমই আছে। আমার সৌভাগ্য অনুবাদ করার সূত্রে সেই আলোচনার সুযোগ আমার হল।
সীতারাম গোয়েল হিন্দু সমাজে বারবার বৈদেশিক আগ্রাসন ও প্রলম্বিত বৈদেশিক শাসনের প্রভাবে কী কী অনুপ্রবেশ ঘটে রয়ে গেছে, তা বোঝাতে গিয়ে তলানি বা অবশিষ্টাংশ (residue) শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ছয়টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই গ্রন্থে খুব স্পষ্ট করে চারটি তলানি তিনি সনাক্ত করেছেন – ইসলামবাদের অবশিষ্টাংশ, খ্রিস্টানবাদের অবশিষ্টাংশ, ম্যাকলেবাদের অবশিষ্টাংশ ও কমিউনিজ়মের অবশিষ্টাংশ।
এর মধ্যে ইসলামের নীতি ও কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা ও অধ্যয়ন অনেকটাই হয়েছে; বলা যায় ইসলামপন্থীরা সারা বিশ্ব বিশেষত ভারতীয় সমাজকে সেটা করতে বাধ্য করছে। খ্রিস্টধর্মের প্রেম ও দয়াদাক্ষিণ্যের বাণীর পেছনে লুকিয়ে থাকা উদ্দেশ্যের কিছুটা আভাস পাওয়া গেলেও আমাদের অনেকের মধ্যে তার প্রতি যথেষ্ট সমীহ রয়েছে এখনও। বইটি পড়লে এই সেমেটিক ধর্মটির স্বরূপ অনেকটাই অনাবৃত হতে বাধ্য। আর কমিউনিজ়ম বা ব্যাপকতর প্রয়োগে বামপন্থার জাতীয়তাবিরোধী অবস্থানের দৌরাত্ম্যে আমাদের সমাজ ও দেশ তো অতিষ্ঠই। যাঁরা এর স্বরূপ ও ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি জানেন না, তাঁদের চোখেও বামপন্থীদের দ্বিচারিতা ও মিথ্যাচার নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন অবশিষ্ট নেই। কিন্তু যে মতবাদ বা সরাসরি মতবাদ না বলে ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থার অবশেষ বা hangover বলা সমীচীন, সেই ম্যাকলেবাদের-এর প্রকৃতি ও প্রভাব সম্পর্কে বিশেষ কেউ জানি না, অন্তত আমার তো জানা ছিল না। ভারতে ইংরেজীসহ আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার রূপকার হিসাবে টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকলের প্রতি শ্রদ্ধাই ছিল, কারণ ভারতের ‘প্রথম আধুনিক মানুষ’ স্বয়ং রাজা রামমোহন রায় তাঁর শিক্ষা ব্যবস্থার সমর্থক ও আহ্বায়ক ছিলেন।
লেখকের বর্ণনায় বাহ্যিক লক্ষণে ম্যাকলেবাদকে কমিউনিজ়মের যমজ মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তিনি খুব সন্দর করে এই দুটি ভাবধারার পার্থক্য ও কীভাবে উভয়ে পরস্পর পরস্পরকে পরিপুষ্ট করে সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে প্রাঞ্জল করেছেন এই দুই ইজ়ম কীভাবে ইসলামের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ও হিন্দুত্বের প্রতি বৈমাত্রেয় অবস্থান নিয়ে দেশে ইতিবাচক জাতীয়তাবোধের সর্বনাশ করেছে। সেই সঙ্গে কমিউনিস্টদের সাম্যবাদের ভেক ধরে ইসলামীয় সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আঁতাত ও সনাতন সংস্কৃতির প্রতি বিদ্বেষ, বিভিন্ন সময় পরিবর্তিত অবস্থান – এই দিকগুলিও দেখিয়েছেন চাঁছাছোলা ভাষায় ঐতিহাসিক সূত্র সহকারে। শুধু তাই নয়, ইসলাম-বাদ, খ্রিস্টানবাদ, ম্যাকলেবাদ ও মার্কসবাদের একক প্রভাব নয়, তাদের যৌথ মোর্চা বা যুক্তবাহিনী কীভাবে হিন্দু সমাজকে কোণঠাসা করে রেখেছে, তার অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিয়েছেন ক্ষুরধার ভাষায়।
বইটিতে হিন্দু সংস্কারক হিসাবে বিবেকানন্দের নাম কয়েকবার উল্লিখিত। এমনকি গান্ধীজীও বহুবার সশ্রদ্ধায় উদ্ধৃত ও আলোচিত, যেখানে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের ভূমিকা উহ্য। জানি না, ব্রিটিশ শাসনকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা হিন্দু সমাজের সংস্কার করেছিলেন বলেই লেখকের এই দুই প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষকে ম্যাকলেবাদী মনে হয়েছে কিনা। বস্তুত রামমোহনের শেষ জীবন বিলেতেই কেটেছিল। কিন্তু এঁরা দুজনেই হিন্দু শাস্ত্রগুলো বিশদে অধ্যয়ন করে, সেখান থেকে উদ্ধৃতি তুলেই হিন্দু সমাজের ব্যাধিগুলোর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। অর্থাৎ সীতারামজীর ভাষায় “The tragedy of a Hindu victim of Macaulayism is that while he is acutely aware of the evils prevalent in Hindu society, he is not aware of the Hindu doctrines which provide no sanction for these evils and which can be depended upon in any endeavour for their eradication.” অর্থাৎ হিন্দু শাস্ত্র বা নীতিশিক্ষাতে যে হিন্দু সমাজ মন্দগুলোর প্রতি অনুমোদন নেই, বরং সেগুলো সংশোধনের নির্দেশ ও উপায় আছে, লেখকের সেই বক্তব্যকেই জোরালোভাবে প্রমাণ করেছিলেন এই দুই বাঙালী। হয়তো তাঁরা এর জন্য ক্ষমতাসীন ব্রিটিশ সরকারের সাহায্য নিয়েছিলেন। কিন্তু কখনই নিজেদের হিন্দু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নয়। বেদান্ত বর্ণিত একেশ্বরবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রামমোহনের ইসলামের মতো কট্টরপন্থী হিংস্র মতবাদকেও একাসনে বসানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়, তবে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্রিটিশ পূর্ববর্তী মুসলিম শাসকদের অত্যাচারী হিসাবেই বর্ণনা করেছিলেন। বিদ্যাসাগরও ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা বিভাগে উচ্চপদে আসীন থেকে সার্বজনীন শিক্ষা ও হিন্দু সমাজে যে বৈপ্লবিক সংস্কার করেছিলেন, তার উত্তরাধিকার সারা ভারতবর্ষ ভোগ করছে। তিনিও বাংলার নবাব সিরাজ উদ্দৌলাকে লম্পট নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠনকারী হিসাবে সনাক্ত করতে দ্বিধা করেননি। অর্থাৎ ম্যাকলের শিক্ষানীতি গ্রহণ করলেও ম্যাকলেবাদীয় ভণ্ডামি তাঁরা দেখাননি। তাই হয়তো লেখক ‘ব্রাহ্ম সমাজ’-কে হিন্দুদের প্রথম আধ্যাত্মিক প্রতিরোধ বলেই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর পুরোপুরি উহ্য।
আমাদের দৃষ্টিতে সেই যুগে এই রাজনৈতিক পালাবদল ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা ছাড়া হিন্দু সমাজ কখনই অগ্রসর হতে পারত না, এবং স্বাধীনতার পরে যে শাসন ক্ষমতার ভরকেন্দ্র অনেকটাই হিন্দুদের হাতে এসেছিল, তা এই পাশ্চাত্য শিক্ষাকে অস্ত্র করেই। তবে সীতারামজীর বক্তব্য ভারতের তৎকালীন নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত ছিল, যাকে সম্পূর্ণ নতুন বিদেশী শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার বদলে প্রয়োজনীয় সংস্কার করলে ফল অনেক ইতিবাচক হতে পারত।
এটা সত্যিই আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য। হিন্দু শাস্ত্রগুলির মধ্যে উৎকৃষ্ট একটি দর্শন বেছে নিয়ে রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ব্রাহ্মসমাজ’, যা হিন্দু সমাজের উন্নতির বদলে প্রবল হিন্দু বিদ্বেষী উন্নাসিক অভিজাত জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হল, যদিও বৈবাহিক ও সামাজিক মেলামেশায় কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না কোনও পক্ষ থেকেই। একই ভাবে পাশ্চাত্য জগতের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে যে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা অভিষিক্ত হলাম, তার দ্বারা নিজেদের শক্তিশালী করার পাশাপাশি বা পরিবর্তে সনাতন সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতে শিখে গেলাম আমাদের কেউ কেউ। এই ঘৃণার ইন্ধন ডিরোজিও-র মতো কিছু শিক্ষাবিদ দিয়েছিলেন কিনা সেটা ভিন্ন অনুসন্ধান।
এখন গান্ধীজী হিন্দুদের প্রতি কতটা সুবিচার করেছিলেন, তা নিয়ে অনেকেই ভিন্নমত হবেন। তবে বইটির রচনাকাল যে সময় ও যাদের আমলে, তখন ‘জাতির পিতা’ বলে শিরোধার্য ব্যক্তির সমালোচনা করলে হিতে বিপরীত হত। বরং তাঁকে সনাতন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হিসাবে তুলে ধরার মধ্যেই বিচক্ষণতা ছিল। বরং লেখক দেখিয়েছেন গান্ধীভক্তরা গুরুর অহিংস নীতিকে ভুল বুঝেছিল – “…because they misunderstood his doctrine of non-violence towards all people, including the Muslims of India, as an endorsement of Islam.” সীতারামজী বাংলায় বহুদিন ছিলেন। বাংলা ভালো জানতেন। How I became a Hindu বইতে তার পরিচয় আছে। সুতরাং ম্যাকলেপন্থী বলে নীরোদ সি চৌধুরীকে কটাক্ষ যেমন সঙ্গত, তেমনি কয়েকজন প্রগতিশীল বাঙালী মনীষীর হিন্দু সমাজে অবদানের উল্লেখও থাকতে পারত।
একটা ধর্মকে সেই সমাজের প্রচলিত প্রথা দিয়েই সনাক্ত করা হয়। তাই নারী নির্যাতন ও জাতিভেদ একদা হিন্দুধর্মের ট্রেডমার্ক হয়ে গিয়েছিল। ম্যাকলেপন্থীরা কেন সুযোগ পেয়েছিল হিন্দুত্বকে ছোট করার, সে দিকটা সম্ভবত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীতে গুরুত্ব পায়নি। আপাতভাবে গ্রন্থটিতে মেয়েদের সমস্যা, কর্তব্য এমনকি অস্তিত্বও আলোচিত নয়। কিন্তু একটি গভীরতর ইঙ্গিত লেখক দিয়েছেন – হিন্দু সমাজে অবক্ষয় ও কুপ্রথাগুলো আসলে বিদেশী হামলার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল।
বইটিতে লেখক যে দূরদৃষ্টির পরিচয় রেখেছেন, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। দেশদ্রোহিতা, মিথ্যাচার ও ভণ্ডামির শাখাপ্রশাখা যে সারা দেশকে জালের মতো ছেয়ে ফেলছে, সেটা আজকে আমাদের চোখে স্পষ্ট। কিন্তু আজ থেকে চার দশক আগে যখন এই অপশক্তিগুলির লক্ষ্য ও কর্মকাণ্ড ততটা প্রকট ছিল না, তখন সেইসব লক্ষণ এই ভদ্রলোকের চোখে কী করে পড়েছিল, সেটাই পরম বিস্ময়! ক্রান্তদর্শী শ্রী গোয়েল যে ছবিটা তখন এঁকেছিলেন, সেখান থেকে সতর্ক হয়ে সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষটি সমূলে উৎপাটন করা হলে আজ ভারতবর্ষের ছবিটা এতটা রক্তাপ্লুত হত না।
লেখক প্রথম অধ্যায়ে হিন্দু সমাজের নিয়তি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ দেখালেও শেষ অধ্যায়ে একটি বাঁচার সূত্র নির্দেশ করেছেন। ম্যাকলেবাদের ফলাফলকে তীব্র নিন্দা করলেও এর ইতিবাচক প্রধান বৈশিষ্ট্যও উল্লেখ করেছেন। ম্যাকলেবাদের সঙ্গে সেকুলারিজ়ম ও ডেমোক্রেসি দুটোরই গাঁটছড়া বাঁধা, এবং যার জন্য তাকে ইসলামবাদ, কমিউনিজ়ম ও খ্রিস্টীয়বাদে বাইরে তাকাতেই হবে। যেদিন ম্যাকলেবাদ এই ত্রিবিধ শক্তির অশুভ আঁতাতকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া বন্ধ করে দেবে, সেদিন ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের কে শত্রু কে মিত্র, তাই নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকবে না।
এই বইটি যদি আমাদের ম্যাকলেবাদে আক্রান্ত শিক্ষিত সমাজের চোখ খুলে দিতে পারে, তাহলেই অনুবাদক হিসাবে শ্রম সার্থক হয়।
– শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম অধ্যায়: হিন্দু সমাজের তাৎপর্য
হিন্দু সমাজ বিশ্বের একমাত্র সমাজ যা স্মরণাতীত কাল থেকে সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব ও কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা বহন করে চলেছে।
পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ –সর্বত্র সব সমাজই খ্রিস্টান, ইসলাম ও কমিউনিজ়মের মতো অর্বাচীন মতাদর্শের আক্রমণ ও বিজয়ের ফলে আকস্মিক বাধা ও যন্ত্রণাময় বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। প্রাক-খ্রিস্টান, প্রাক-ইসলাম ও প্রাক-কমিউনিজ়়ম যুগের সাংস্কৃতিক সৃষ্টিগুলোর জায়গা এখন শুধু লাইব্রেরি ও সংগ্রহশালায়। পুরাত্ত্ববিদদের নিষ্ঠার জন্য ধন্যবাদ।
হিন্দু সংস্কৃতিও অনুরূপ বিপজ্জনক নিয়তির সম্মুখীন হতে পারে, যদি তা ধারণ ও বহন করার মতো হিন্দু সমাজেরই অস্তিত্ব না থাকে। এই বিষয়টা অনেকেই ভুলে যায়, এমনকি হিন্দু সংস্কৃতি নিয়ে যারা গর্ব বোধ করে তারাও।
বহু হিন্দু আছে যারা হিন্দুত্বের মহান আধ্যাত্মিকতা ও ‘গীতা’ বা ‘উপনিষদ’-এর মতো ঐতিহ্যময় সাহিত্য নিয়ে গর্বিত; কিন্তু যে হিন্দু সমাজ এই ঐতিহ্য ও সাহিত্যগুলো এত বছর ধরে সংরক্ষণ করে এসেছে, তার প্রতি সমতুল্য উন্মাদনা ও উৎসাহ দেখায় না।
আবার কিছু আছে যাদের দারুণ আস্থা যে ‘সনাতন ধর্ম’ অর্থাৎ ‘হিন্দুত্ব’ অবিনশ্বর। এটা এক অর্থে সত্য। অহিন্দু সমাজেও কিছু মানুষ আত্ম অনুসন্ধান করতে গিয়ে সনাতন ধর্মের রহস্যকে স্বীকার করেছে, প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু সনাতন ধর্মেও গ্রহণ লাগতে পারে, যদি না তা ধারণ করার মতো কোনও হিন্দু সমাজের অস্তিত্ব থাকে। তখন তার বার্তা বিশ্ব মানবতার কাছে আর পৌঁছতে পারবে না।
সবশেষে বলতে হয়, বহু হিন্দু আছে যারা হিন্দু শিল্প, স্থাপত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, নৃত্য, নাটক, সাহিত্য, ভাষাতত্ত্ব, অভিধান রচনা ইত্যাদি নিয়ে সঙ্গতভাবেই গর্বিত। কিন্তু সঙ্গে এটাও বুঝতে হবে সংরক্ষণ, রক্ষা ও স্থায়ীভাবে বহন করার মতো হিন্দু সমাজ নষ্ট হয়ে গেলে তাদের তৈরি যাবতীয় মহান শিল্প, সাহিত্য ও বৈজ্ঞানিক উত্তরাধিকার – সবই হারিয়ে যাবে।
কিন্তু হিন্দু সমাজের পরিণাম যে মৃত্যু তা আর বলার আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই মহান সংস্কৃতি বর্তমানে সবদিক দিয়ে এমন কিছু অন্ধকার ও ঘাতক শক্তিগুলো দ্বারা আক্রান্ত ও অবরুদ্ধ, যারা বহু প্রাচীন সমাজকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন ও নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। নিজের ভরবেগ হারিয়ে হিন্দু সমাজটা নিজের মধ্যেই বহু-বিভক্ত। এর উত্তরসূরীরা এমন প্রতিকূল প্রচারের শিকার, যে তারা নিজেরাই নিজেদের উত্তরাধিকার আর টিঁকিয়ে রাখতে চায় না। তাদের মধ্যে এর প্রতি হয় চরম ঘৃণা নয় পরম নিরাসক্তি তৈরি করছে। কোনও হিন্দুই আর নিজের সম্পদ নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। এমন মরণ বিপর্যয় হিন্দু সমাজে এর আগে আসেনি। হিন্দু সমাজের ইতিহাসটাই স্মরণ করে কতগুলো তথ্য সোজাসুজি ঝালিয়ে নেওয়া যাক। কারণ সেই ইতিবৃত্তে ঘৃণা বা নিরাসক্তির নজির নেই, অধিকাংশই সম্মান ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের মতো।
প্রথম কথা হল ভুল বোঝা। একদা পশ্চিমের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও তাঁদের শিষ্যকুল, যাদের কাছে আলেক্সান্ডারের ভারত আক্রমণ থেকে ভারতের ইতিহাস শুরু হচ্ছে, তারা এই ইতিহাসকে উপস্থাপনা করেছে ধারাবাহিক বিদেশী আক্রমণের সাফল্য দিয়ে, যার কাছে ভারতের হিন্দু সমাজ অনিবার্যভাবে পদানত হয়েছিল। তারা আর্যদেরও বহিরাগত বানিয়ে খ্রিস্ট পূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে আর্য আক্রমণ তত্ত্ব উদ্ভব করে এই দেশ সম্পর্কে নিজেদের পোষণ করা ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। মানে ভারতভূমি যেন সবার জন্য উন্মুক্ত এক রোমাঞ্চকর অভিযান ও যখন খুশি বসবাসের ক্ষেত্র।
আলিগড় ঘরাণার ঐতিহাসিকরা তো হিন্দু সমাজকে জন্মলগ্ন থেকেই অবদমন ও শোষণকারী হিসাবে প্রমাণ করতে ব্যস্ত। অতএব, তাদের কল্পনায়, বহিঃশত্রুদের এই ভূখণ্ডকে জয় করতে গিয়ে কখনই বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। ভারতের সংখ্যালঘু অত্যাচারী শাসকেরা শহর ও দুর্গে বসবাস করেছে, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ অত্যাচারিত শ্রেণী নিজেদের উদ্ধারকারী হিসাবে বহিরাগত হামলাবাজদের সমর্থন দিয়ে গেছে।
মার্কস্বাদী ঐতিহাসিকরাও এই আলিগড়ী উপস্থাপনাকেই দু’ বাহু বাড়িয়ে স্বাগত জানিয়েছে এবং ইতিহাস সম্পর্কে তাদের বস্তুবাদী সিদ্ধান্তের সাফাই গেয়ে গেছে। তারা আলিগড়ী গবেষণাকেই আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বোঝাতে চেয়েছে, বহিরাগত আক্রমণকারীরা শুধু সমাজ ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুক্তিদাতার ভূমিকা পালন করেনি, এখানকার উৎপাদন ক্ষমতাকেও বাড়িয়েছে। সোজা কথায় আমাদের জানানো হয়েছে, বিদেশী আক্রমণ আসলে ধাপে ধাপে অর্থনৈতিক বদ্ধতা থেকে ঐহিক ও সমাজিক প্রগতি।
মক্কা ও মস্কো দ্বারা অনুপ্রাণিত পণ্ডিতদের সঙ্গে লড়াই করে লাভ নেই। বার বার দেখা গেছে ঘটনা যাই হোক, তাদের সিদ্ধান্ত একই। তাদের সিদ্ধান্ত এক কারণ তাদের উদ্দেশ্যও অনুরূপ। তাদের উদ্দেশ্য হল হিন্দু ইতিবৃত্তকে ভুল উপস্থাপনা দ্বারা নিন্দা করে হিন্দু সমাজটাকেই কলঙ্কিত ও ধ্বংস করে ফেলা। এখন তো বহু ভারতীয়ই এই খেলায় যোগ দিয়ে মেতে উঠেছে।
দায়িত্ববান পশ্চিমী ঐতিহাসিকরা অবশ্য স্বীকার করেন, হিন্দু ইতিহাস বহু বহু পুরোনো, আলেক্সান্ডারের ভারত আক্রমণের অনেক আগেকার। তাঁরা এটাও স্বীকার করেন আর্য আক্রমণ তত্ত্ব নিছকই অনুমান যার কোনও বিশ্বাসযোগ্য লিখিত বা পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। তাঁরা মানেন হিন্দুরা বহিরাগত আক্রমণকারীদেরও মেনে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা মোটেই অসম্মানের নয়। তাঁরা এটাও মনে করেন, হিন্দুরা যখন হেরেছে, সেটা তাদের অবহেলা ও রণকৌশলের কারণে; এর সঙ্গে তাদের সমাজ ব্যবস্থার ত্রুটি বা সাংস্কৃতিক পরিবেশের সম্পর্ক নেই।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন হিন্দু সংস্কৃতি সারা বিশ্বের সভ্য জগতের কাছে রীতিমতো শ্রদ্ধাভাজন ছিল। এর ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ও সাধু, এর রহস্যময় সন্ন্যাসী, জ্ঞানীগুণী ও বিজ্ঞানী, মিশনারি ও বণিক এরা সবাই হিন্দুধর্মের বার্তা বহন করে নিয়ে যেত বিশ্বের সুদূরতম প্রান্তে – পূর্ব আফ্রিকা, মিশর, ইথিওপিয়া; সুমেরিয়া, ব্যাবিলন, চালদিয়া (উত্তর ইরাক), ইরান; ব্রহ্মদেশ, চীন, জাপান, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া; ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড; প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ়, মেস্কিকো, পেরু,কলোম্বিয়া; এশিয়া মাইনর, মধ্য এশিয়া; গ্রীস, রোম। বিশ্বের শত শত সংস্কৃতিতে এই গৌরবোজ্জ্বল ধর্ম ও দর্শন, ভাষা ও সাহিত্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং জীবনশৈলীর সাক্ষ্য ধরা পড়েছে।
এটা সত্য যে হিন্দুরা কখনই ইরান বা রোমের মতো অধীনস্থ অঞ্চলগুলিতে অত্যাচার ও প্রতিবেশী দেশে আক্রমণ চালিয়ে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রশক্তি তৈরি করেনি। তা সত্ত্বেও তাদের সমাজ ছিল শক্তিশালী, মজবুত, বিকেন্দ্রীকৃত অথচ পারস্পরিক বন্ধনে অটুট ব্য়বস্থায়। প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা এই সমাজের সংযোগ ব্য়বস্থাগুলির নাম ‘কুল’, ‘জাতি’, ‘গ্রাম’, নিগম (শহর), নগর, জনপদ বা দেশ এবং সাম্রাজ্য। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে আবার পড়েও গেছে। কিন্তু এই সমাজের আভ্যন্তরীণ পরিকাঠামো সময়োত্তীর্ণ হয়ে যথেষ্ট প্রাবল্য ও ঔজ্জ্বল্য নিয়েই বেঁচে আছে অদ্যাবধি।
গ্রীক ঐতিহাসিক যাঁরা আলেক্সান্ডারের অনুচর হয়ে আসেন তাঁরা বলেছেন, পাঞ্জাবে ও সিন্ধুতে আলেক্সান্ডারের সাময়িক সামরিক অভিযানের আগে মাত্র দুই জন বহিরাগত হামলাবাজ ভারতের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস দেখিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকে ব্যাবিলোনিয়ার রানী সেমিরামিস (Semiramis) এবং ৬ষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইরানের অধিপতি কুরুশ (Cyrus the Great)। তাঁরা সুবিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ভারত আক্রমণ করলেও সীমান্তেই হেরে যান। খুব কম সংখ্যক জীবিত যোদ্ধা নিয়ে তাঁদের পলায়ন করতে হয়।
প্লুটার্চের লেখা পড়ে সন্দেহতীতভাবে বলা যায়, আলেকজান্ডার নিজে বিপাশা নদীর তীর থেকে তাড়াহুড়ো করে পিছু হটেন। ছোট ছোট প্রজাতন্ত্রগুলোর ধারাবাহিক সাহসী প্রতিরোধে ঘাবড়ে গিয়ে তাঁর বাহিনী নদী পেরুতে অস্বীকার করে। পূর্ব এশিয়ায় তাঁর উত্তরসূরী সেলিউকাস নিকাটোর খুব শীঘ্রই নতি স্বীকার করে বিজিত ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে শুধু সরেই যাননি, বৈবাহিক সম্পর্ক দ্বারা এক ভারতীয় সম্রাটকে শ্রদ্ধাও নিবেদন করেন।
কিন্তু সময়ের চাকা ঘোরে। হিন্দুরা যুদ্ধকলাকে অবহেলা করে তাদের তেজ, প্রাণশক্তি ও সতর্কতা হারিয়ে ফেলে; প্রতিবেশী ভূমিতে যা নতুন মাত্রা লাভ করে। মৌর্য সাম্রাজ্যের ভাঙনের পর সিথিয়ান, কুশান ও হুনরা উত্তর ভারতে তাণ্ডব চালায়। এরপর গুপ্ত সম্রাটরা উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ অংশ জয় করে শাসন করতে সফল হন। বিদেশী শাসনের ঐ সময়টুকু ছিল নেহাতই ক্ষণস্থায়ী। সেই সব হানাদারা শুধু হিন্দু বীরত্বের ক্রমবর্ধমান জোয়ার দ্বারা পরাজিতই হয়নি, সেই সঙ্গে সুবিশাল হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়ে তাদের সঙ্গেই মিশেও যায়।
হিন্দুদের বিজয়ের এই ইতিহাস ধাক্কা খায় সপ্তম শতাব্দীর মধ্য প্রাচ্য থেকে আগত মুসলিম হামলাবাজ বাহিনীর আবির্ভাব ঘটলে। হিন্দুরা এবার এমন এক বিপক্ষের মুখোমুখি হল, যারা শুধু যুদ্ধবিদ্যায় কুশলতর ছিল না, সেই সঙ্গে ছিল এমন মতাদর্শের যা হিন্দু মূল্যবোধ ও দর্শনের একেবারে বিপরীত মেরুর। হিন্দুদের এরপর নতুন বিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধটা করতে হল, তা ছিল অবিরাম ও দীর্ঘস্থায়ী। আরবের খলিফার সেনাবাহিনী যারা পারস্য এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে অবনমিত করেছিল, যা হিন্দুকুশ পর্বত থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জয় করেছিল এবং যা একের পর এক বিপুল জনগোষ্ঠীকে ইসলামে রূপান্তরিত করে ফেলেছিল, তারা কিন্তু বারবার আক্রমণ করেও সিন্ধু পেরিয়ে আর এগুতে পারেনি।
পরবর্তী কালে গজ়নভি, ঘোরী, খলজী, তুঘলক ও মুঘলরা অনেক বেশি সাফল্য পায় তাদের ঔপনিবেশিক রাজবংশ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে, যারা ভারতের একটা বিশাল অংশের উপর শাসন করে বেশ কয়েক শতক ধরে। কিন্তু হিন্দু প্রতিরোধ কোনও দিন বন্ধও হয়নি। রাজপুত রাজারা, বিজয়নগর সাম্রাজ্য, মারাঠা শাসকরা, বুন্দেলরা, জাঠেরা ও শিখরা একের পর এক প্রচণ্ড বিদ্রোহ করে চলে আঠারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, যতদিন না মুসলিম শাসনের ভিত সম্পূর্ণ ধ্বংস ও ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আর ইসলাম তার রাজনৈতিক ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তির জয় মনে করে যেসব ধর্মান্তরিত ভারতীয়দের, সাত শতাব্দীর দীর্ঘ রাজত্বকালের তুলনায় তাদের সংখ্যাটা তুলনামূলকভাবে কমই ছিল বলা চলে।
ব্রিটিশ আক্রমণকারীদের হস্তক্ষেপের কারণে ইসলামীয় সৈন্যবাহিনীর ওপর হিন্দুদের এই বিজয় ইতিহাসে সংকলিত করা সম্ভব হয়নি। ব্রিটিশদের শুধু যুদ্ধবিদ্যায় অভূতপূর্ব শ্রেষ্ঠত্ব ছিল না, সূক্ষ্ম কূটনীতিকেও প্রচ্ছন্ন অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার ক্ষমতা ছিল। হিন্দুরা আরও একবার দাসত্বে বাঁধা পড়ল। ব্রিটিশরা তাদের সঙ্গে করে খ্রিস্টধর্মের আকারে এমন এক মতাদর্শ নিয়ে আসে, যা আমাদের কাছে প্রায় ভিনগ্রহী এবং হিন্দুদের মৌলিক জীবনচর্চার ঘোর বিরোধী।
হিন্দুদের পরম ভাগ্য, ব্রিটেন সহ প্রতীচ্যে তখন গ্রীক ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনে অনুপ্রাণিত মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ ও সার্বজনীনতাবাদ (universalism) এইসবের ক্রমবর্ধমান জোয়ারে খ্রিস্টীয়বাদ অচিরেই নিমজ্জিত হয়ে যায়। খ্রিস্টধর্ম তাই ব্রিটিশ শাসকদের ততটা বল্গাহীন ভাবে আচ্ছন্ন করতে পারেনি যেমনটা ইসলাম মুসলিম রাজাদের দরবারে করতে পেরেছিল। তার আগে কোথাও কোথাও কিছু সময়ের জন্য পর্তুগিজ় হামলাবাজরদের মাধ্যমেও খ্রিস্টধর্ম হিন্দুদের ওপর জুলুমবাজি করতে সক্ষম হয়।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামটা মুসলিম লুঠেরাদের বিরুদ্ধে লড়ার মতো ততটা দীর্ঘায়িত ছিল না। ব্রিটেনে উদার গণতন্ত্রের উত্থান হিন্দু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য ছিল দারুণ সহায়ক। তার পরেও বৈপ্লবিক ও সাংবিধানিক, হিংসাত্মক বা অহিংস – একাধিক ক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এটা হিন্দুদের পক্ষে গর্বের বিষয় যে, তাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে অনুরূপ সংগ্রামের প্রেরণা যুগিয়েছে; এবং ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা ছিল অন্যান্য বহু দাসত্বে বন্দী জাতির জন্যই স্বাধীনতা লাভের ঊষাকাল।
অজস্র প্রাচীন সমাজকে বিধ্বস্ত ও শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করে ফেলা হানাদার বাহিনীদের হাত থেকে যে সমাজ এখনও বেঁচে রয়েছে, তাকে বিশ্ব ইতিহাসের এক বিস্ময় হিসেবে গণ্য করতেই হয়। ভারতের উপর সংঘটিত প্রতিটি বিদেশী আক্রমণকে শেষ পর্যন্ত হিন্দু সমাজ পরাজিত ও ছত্রভঙ্গ করে দিতে পেরেছে তা নিঃসন্দেহে স্বস্তির কারণ। যে সমাজ বিদেশী আক্রমণের জেরে নিজের পরিচয়, দেহ ও আত্মা সর্বস্ব হারিয়েছে, সেই সমাজ শুধুই মুক্তির জন্য গর্ব করতে পারে; কিন্তু নিজের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক স্মৃতি বহন করার মতো কোনও উত্তরসূরী রেখে যেতে পারে না, যারা জাতির নায়কদের প্রতি জাতীয় শ্রদ্ধার জাগরণ করতে পারবে। অন্য সব রকম দুর্বলতা নিয়েও কিন্তু হিন্দু সমাজ কখনও এমন মূর্খতা দেখায়নি।
যে হিন্দুদের এমন গৌরবময় ইতিহাস ছিল, ১৯৪৭-এর পর স্বাভাবিকভাবে তাদের এগিয়ে এসে নতুন সাংস্কৃতিক সৃষ্টির কর্মজীবন শুরু করা কথা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ পর্বের লাভ-ক্ষতির খতিয়ান বা ব্য়ালান্স শীট হিন্দুদের অনুকূলে যায়নি। তারা একদা হিন্দু সংস্কৃতি ও সভ্যতার পবিত্র বেশ কিছু পীঠস্থান নিজেদেরই জাতির একটি বিজাতীকৃত অংশের কাছে হারিয়ে ফেলেছে, যেখানে তারা নিজেদের জন্মভূমিতেই আর সম্মানিত নাগরিক নন। এক স্থায়ী অপবাদ যেন হিন্দু ও হিন্দুধর্ম এই শব্দ দুটির সঙ্গে সেঁটে গেছে। শব্দগুলো এখন কিছু অতি অভিজাত মানুষের মুখে গালাগালির মতো, যাদেরকে লক্ষ লক্ষ হিন্দুরাই নিজেদের রক্ত, ঘাম ও অশ্রু ঝরিয়ে ক্ষমতা ও সম্মানের শিখরে বসিয়ে রেখেছে ।
এমনটা কী ভাবে ঘটল?
আমি একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি: ভারতের মুসলিম এবং ব্রিটিশ আক্রমণ শেষ পর্যন্ত পরাজিত এবং ছত্রভঙ্গ হলেও তাদের কিছু মনস্তাত্ত্বিক ও বৌদ্ধিক অবশেষ এখনও এখানে দানা বেঁধে আছে, যা এই ক্ষতবিক্ষত হিন্দু সমাজের পক্ষে পরিপাক করা খুব কঠিন। এই তলানিগুলো এখন শক্তিশালী আন্তর্জাতিক শক্তির সঙ্গে সক্রিয় জোট বেঁধে রয়েছে ও নানাভাবে বাইরের মদতও পাচ্ছে, যাদের সঙ্গে দরিদ্র হিন্দু সমাজ লড়তে অক্ষম। আর সব শেষে বলতে হয়, এই অবশেষগুলো যদিও নিজেরাই বেকায়দায়, তবু তারা এমন এক যৌথ মঞ্চ বা মোর্চা গঠন করেছে যা হিন্দু সমাজকে কোণঠাসা করে রেখেছে। সবচেয়ে বেশি বিপদ তাই আভ্যন্তরীণ কারণেই।
বিদেশী আক্রমণের কোন্ কোন্ অবশিষ্টাংশ হিন্দু সমাজকে কোণঠাসা করে রেখেছে?
যাকে আমরা ইসলামবাদ নামে চিনি তা হল ভারতের মুসলিম আগ্রাসনের একটি অবশিষ্টাংশ। অন্যদিকে ব্রিটিশ আগ্রাসন আমাদের দু’টি অবশিষ্টাংশ উপহার দিয়েছে যাদের নাম খ্রিস্টানবাদ ও ম্যাকলেবাদ। এই হিন্দু বিদ্বেষী যুক্ত মঞ্চের ছবি উপস্থাপনার আগে আমরা এক এক করে ভারতে তাদের ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলির সঙ্গে তাদের আঁতাত বিশ্লেষণ করব।
লেখক: সীতারাম গোয়েল
অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়