ভৌগলিকগত অবস্থান আগামীতে ত্রিপুরার জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে। অবশ্যই পড়শি দেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা অস্বীকার করার কোনও অবকাশ নেই। কারণ, বাংলাদেশের সাথে রেল সংযোগের মাধ্যমে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হতে চলেছে। সম্ভবত অপেক্ষা করতে হবে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। ত্রিপুরার নিশ্চিন্তপুরের সাথে বাংলাদেশের গঙ্গাসাগর পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপন হয়ে যাবে। দ্রুতগতিতে রেলেওয়ের কাজ সে-দিকেই ইঙ্গিত করছে। নতুন সম্পর্কে অনেক নতুনত্বের ছোঁয়া মিলবে, তা সরেজমিনে পরখ না করলে বোঝা দায়। অবশ্য, ত্রিপুরাকে দেশীয় মানচিত্রে এভাবেই সম্ভাবনাময় স্থানে তুলে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অবদান অস্বীকার করা যাবে না।
এক সময় পার্বত্য এই রাজ্য যেখানে জাতীয় সড়ক অবরুদ্ধ হলে গোটা দেশের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত, সেখানে আগামী এক বছরের মধ্যে জলপথ এবং স্থলপথে অতি অল্প সময়ে দেশের অন্য রাজ্যের সাথে জুড়ে যাবে ত্রিপুরা। অবশ্যই, বাংলাদেশের মাধ্যমে ওই সুযোগ পাবে রাজ্য। বিশেষ করে রেল সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে কমবে দূরত্ব, সাথে কম হবে পরিবহণ খরচও। তাতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের খুশির কিনারা হবে না।
২০১৩ সালে ঐতিহাসিক আগরতলা-আখাউড়া রেল প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছিল। ভারত এবং বাংলাদেশে রেল সংযোগ স্থাপনে ভারত সরকার সমস্ত অর্থ বহন করবে, এমনটাই স্থির হয়। কিন্তু কাজ শুরু হতে সময় নেয় প্রায় তিন বছর। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ভারতের তদানীন্তন রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু এবং বাংলাদেশের রেল মন্ত্রী মহম্মদ মুজিবুল হক ত্রিপুরায় দাঁড়িয়ে আগরতলা-আখাউড়া ডুয়েল গেজ রেল প্রকল্পের রাজ্যের অংশের কাজের সূচনা করেন।
অন্যদিকে, ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের উপস্থিতিতে ভিডিও কনফারেন্সে বাংলাদেশের অংশের কাজের সূচনা করেন। প্রকল্পের প্রারম্ভিক অবস্থায় ভারতের অংশের নির্মাণ কাজে ৫৮০ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশের অংশে নির্মাণ কাজে ৯৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে ভারতের অংশে কাজের জন্য বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪০ কোটি টাকা। সময় যত এগিয়েছে, কাজের গতি তত বেড়েছে। সাথে দুই দেশের সম্পর্কে মাধুর্য নতুন মাত্রা নিয়েছে। কারণ, আগরতলা-আখাউড়া রেল প্রকল্পে পরিকল্পনা ছিল, ট্রেন আগরতলা স্টেশন থেকে সোজা বাংলাদেশের আখাউড়া পর্যন্ত যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার মাঝখানে গঙ্গাসাগর স্টেশন পুরোদমে চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাতে, আগরতলা থেকে ট্রেন খুব সহজেই বাংলাদেশের বিভিন্ন রেল রুটের সাথে সহজে যোগাযোগ স্থাপনের সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়। কারণ, বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় শহরের সাথে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত রেল সংযোগ স্থাপিত রয়েছে। এ-ক্ষেত্রে রেল যোগাযোগে ওই প্রকল্পে দূরত্ব কমে যায়।
আগরতলা থেকে নিশ্চিন্তপুর পর্যন্ত দূরত্ব মাত্র চার কিমি। নিশ্চিন্তপুর থেকে বাংলাদেশের গঙ্গাসাগর আট কিমি এবং গঙ্গাসাগর থেকে আখাউড়া পর্যন্ত দূরত্ব ছয় কিমি। ফলে বাংলাদেশের রেল রুটের মূল স্রোতে যুক্ত হওয়ার জন্য ওই প্রকল্পে ৬ কিমি দূরত্ব কমে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ওই রেল প্রকল্প শুরু হওয়ার পর খুবই অল্প সময়ে কলকাতা এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ও আশুগঞ্জ বন্দরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে। রেল মানচিত্রের দূরত্ব অনুযায়ী বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে আগরতলা থেকে কলকাতার দূরত্ব মাত্র ৫১৪ কিমি। অথচ, বর্তমানে আগরতলা থেকে কলকাতা দূরত্ব পড়ে ১,৬১৩ কিমি। অন্যদিকে, ওই রেলপথে আগরতলা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ২১৩ কিমি এবং আগরতলা থেকে আশুগঞ্জ বন্দরের দূরত্ব মাত্র ৫৪ কিমি। ফলে, ওই রেল পথে যোগাযোগ শুরু হলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন ব্যবসায়ীরা। কারণ, অতি স্বল্প দূরত্বে পণ্য আমদানির ফলে কমবে পরিবহণ খরচ। সাথে অল্প সময়ে আমদানি সম্ভব হওয়ায় পচনশীল পণ্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
রেলওয়ের জনৈক আধিকারিকের কথায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বড় কন্টেনারে পণ্য ট্রেনে আগরতলা আনা যাবে। তাতে, ব্যবসায়ীরা অধিক লাভবান হবেন। প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিটির দাবি, প্রথমে সিদ্ধান্ত ছিল আগরতলা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রেল সংযোগ হবে। কিন্তু বর্তমানে আগরতলা থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত রেল সংযোগ স্থাপন হলেই বাংলাদেশের বিভিন্ন রেল রুটের সাথে সংযোগ সহজেই স্থাপিত হচ্ছে। তিনি জানান, কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে ভারতের অংশে ১৫০ গজ এলাকায় মিটার গেজ রেল লাইন বসানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
এ-ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশ্ন জাগতে পারে, ত্রিপুরায় ব্রডগেজ রেল লাইন চালু হয়ে গেছে। তা-হলে, বাংলাদেশের সাথে নতুন রেল সংযোগে মিটার গেজের বিষয়টি আসছে কোথা থেকে? রেলওয়ের ওই আধিকারিকের কথায়, বাংলাদেশে এখনও সমস্ত প্রান্তে ব্রডগেজ স্থাপন হয়নি। খুলনা, রাজশাহী সহ কিছু কিছু রেল রুটকে ব্রডগেজে রূপান্তর সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এখনও বিরাট অংশ জুড়ে মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে রূপান্তরের কাজ বাকি। আগরতলা-আখাউড়া রেল প্রকল্পে মিটারগেজের সাথে ব্রডগেজের ব্যবস্থা রেখে রেল লাইন বসানোর কাজ চলছে।
তাঁর কথায়, প্রস্তাবিত নিশ্চিন্তপুর রেল স্টেশন থেকে কাঁটাতারের বেড়া পর্যন্ত রেল লাইন বসানোর কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। এখানে মিটার গেজ ও ব্রডগেজ উভয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নিশ্চিন্তপুর থেকে আগরতলা পর্যন্ত ইলেভেটেড করিডোরের জন্য পিলার নির্মাণ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ চলছে। তিনি বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে জিরো পয়েন্ট থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত রেলের কাজ শ্লথগতিতে হচ্ছে। এর জন্য অবশ্যই করোনা পরিস্থিতি দায়ী। সাথে তিনি যোগ করেন, বাংলাদেশের অংশে অনেকগুলি কালভার্ট নির্মাণ করতে হচ্ছে। কারণ সেখানে ভীষণ জল জমে থাকে প্রায় সারা বছরই। গঙ্গাসাগর রেল স্টেশনের কাজ আপাতত থমকে রয়েছে, দাবি করেন তিনি। তাঁর কথায়, ভারতের অংশে নিশ্চিন্তপুর স্টেশনে সম্পূর্ণ আলাদা ইমিগ্রেশন, কাস্টমসের যাবতীয় সমস্ত অফিস তৈরি করা হবে।
আশা প্রকাশ করে আধিকারিকটি বলেন, ৩১ মার্চের মধ্যে নিশ্চিন্তপুর থেকে জিরো লাইন পর্যন্ত রেল লাইনের সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। ফলে, বাংলাদেশ সরকার চাইলে তাদের অংশের কাজ সমাপ্ত করে নিশ্চিন্তপুর পর্যন্ত পণ্য আমদানি-রফতানি শুরু করে দিতে পারবে। তবে, আগরতলা থেকে নিশ্চিন্তপুর পর্যন্ত রেল সংযোগ স্থাপনে আগামী বছর ২০২২ সালের ৩১ মার্চের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে সমস্ত কাজ অবশ্যই সমাপ্ত হবে।