রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুসারে বিজেপি এবং বামেরা দু-মেরুর লোক৷ সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের বেশ কয়েকমাস আগে একটা খবর করতে গিয়েছিলাম রাজ্যের ডিওয়াইএফআই-এর দীনেশ মজুমদার ভবনে৷ ওখানেই কথা প্রসঙ্গে এক জনপ্রিয় তরুণ বাম নেতা আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, ‘‘বিজেপির মিডিয়া সেল আমাদের থেকে কয়েকগুণ এগিয়ে৷ আর শুধু আমাদেরই কেন, সারা ভারতেই ওরা এখন এক নম্বরে৷ প্রচন্ড সিস্টেমেটিক ওরা৷’’ রাজনৈতিকভাবে চরম বিরোধীদের কাছ থেকে এরকম প্রশংসায় বলে দেয় বিজেপি মিডিয়া সেলের কাজের দক্ষতা কতটা৷
সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় ইতিহাস গড়ে ১৮টি সিট জিতেছে বিজেপি৷ এই যুদ্ধ জয়ের পেছনে অতীন্দ্র প্রহরীর মতো রয়েছে একদল ছেলে৷ যারা সংবাদমাধ্যমের সামনে না এসেও সময় মতো তথ্য সরবরাহ করে গেছে দলের নেতা কর্মী এবং সাংবাদিকদের৷ ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে সোশ্যাল ও প্রথাগত মিডিয়াতে বারবার উঠে এসেছে বিজেপি মিডিয়া সেলের নাম৷ ২০১৯-এর লোকসভা রেজাল্টের পর বাংলা বিজেপির মিডিয়া সেলের সম্পর্কেও মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়েছে৷ কারা রয়েছে রাজ্যে বিজেপির এই মিডিয়া সেলে? কিভাবে কাজ করে বিজেপির মিডিয়া সেল?
পুরো বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছেন বিজেপির মিডিয়া সেলের কর্মীরা৷ রাজ্য বিজেপির মিডিয়া প্রধান সপ্তর্ষী চৌধুরী জানান, রাজ্যে বিজেপির ৩৮টি সাংগঠনিক জেলার ৩৭টিতে কাজ করছে সোশ্যাল মিডিয়া সেল৷ প্রতি বিধানসভায় একজন কনভেনার এবং দুজন কো কনভেনার, একই ভাবে প্রতি লোকসভায় একজন কনভেনার এবং দু’জন কো কনভেনার পাশাপাশি জেলা স্তরে একজন মিডিয়া সেলের আধিকারিক এবং তার সহকারি৷
এছাড়া চারটি জোন রয়েছে বিজেপি মিডিয়া সেলের, কলকাতা, রাঢ় বাংলা, নবদ্বীপ, উত্তর এবং দক্ষিণ বঙ্গ৷ সপ্তর্ষীর পরেই বিজেপি রাজ্য মিডিয়া সেলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন আরও দু’জন কালীচরণ সাউ এবং অর্নিবান বোস৷ এছাড়াও আরও ১২ জন স্টাফ রয়েছেন বিজেপি মিডিয়া সেলে যারা কন্টেন্ট, গ্রাফিক্স এবং টেকনিক্যাল বিষয়গুলো দেখেন৷ মুরলীধর লেনে বিজেপির রাজ্য সদর দফতরে ঢুকেই সিঁড়ির পাশ দিয়ে ডানদিকে এগিয়ে গেলেই একটা ছোট রুমে কাজ করেন মোদীজীর মিডিয়া সেল স্টাফরা৷ করপোরেট ঢঙে তিনটে শিফটে কাজ চলে৷
বিজেপি মিডিয়া সেলের এই কর্মীরা প্রত্যেকেই মাস শেষে স্যালারিও পান৷ এ বিষয়ে সপ্তর্ষীর বক্তব্য হল, ‘‘আমরা এখানে যারা কাজ করি প্রত্যেকেই সমমতাদর্শের মানুষ৷ কিন্তু দিনের অনেকটা সময় যার পরিশ্রম করছেন তাদের কিছু তো একটা পারিশ্রমিক দিতেই হয়৷ হয়ত সেটা খুব বেশি কিছু নয় তবে আমরা খুশি যে ওদের জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পেরেছি৷’’
মিডিয়া সেলের কাজটা মোটেও সহজ নয়৷ এমনটাই জানাচ্ছেন সপ্তর্ষী৷ টিভিতে কারা বসবেন, কোন বিষয় নিয়ে তারা কথা বলবেন কিংবা বিরোধীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে কোন ইস্যুগুলি তুলে ধরবেন তার পুরো তথ্য প্যানেলিস্টদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিজেপির মিডিয়া সেলের অন্যতম প্রধান কাজ৷ এর জন্য প্রচুর পড়াশুনো করতে হয় এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিটি প্রকল্পের আপডেট রাখতে হয়৷ প্যানেলিস্টদের জন্য আলাদা হোয়্যাটঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে যেখানে প্রতিনিয়ত তথ্য সরবরাহ করে থাকেন মিডিয়া সেল কর্মীরা৷
সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং তাদেরকে সাংবাদিক সম্মেলন সহ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতার বক্তব্যের ফুটেজ, সভার তারিখ এবং আরও সমস্ত রকমের প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করা হয়ে থাকে এই মিডিয়া সেল থেকে৷ এই তথ্য সরবরাহের জন্য তিনটি হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেছে বিজেপি মিডিয়া সেল, অনলাইন পোর্টাল, প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং ফটো জার্নালিস্টদের জন্য৷
বাংলা বিজেপি মিডিয়া সেলের প্রধান সপ্তর্ষী ২০১২ সাল পর্যন্ত সাংবাদিকতার সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন৷ তিনি জানান, ‘‘আমি সাংবাদিকতার ছাত্র ছিলাম না৷ তবে একটা সময় পেশাদার সাংবাদিকতায় ছিলাম৷ তারপর বাংলা বিজেপির মিডিয়া সেলের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে৷ ছোট থেকেই সংঘের শাখায় যাতায়াত ছিল তাই আদর্শগতভাবে সবসময় বিজেপির হয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক ছিলাম৷ মিডিয়া সেলে আসার আগে বিদ্যার্থী পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম৷’’
দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের একটি রাজ্যের মিডিয়া সেলের দায়িত্ব কতটা চাপের? এই প্রশ্নের উত্তরে সপ্তর্ষী বলেন, ‘‘চাপের থেকেও বড় বিষয়টা দায়িত্বের৷ বাংলায় এখন এরকম একটা পরিস্থিতি যে জয় শ্রী রামও বলা যায় না৷ সেখানে কাজ করতে অসুবিধে যে হবে এটাই স্বাভাবিক৷ তবে আমি অসাধারণ একটা টিম পেয়েছি৷ পাশাপাশি আমাদের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, সহ সভাপতি সুব্রত চট্টোপাধ্যায়, কৈলাশ বিজয়বর্গীয়জী(বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কৈলাশ বিজয়বর্গী), সায়ন্তন দা(রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু) , রাহুল দা(বিজেপির জাতীয় সম্পাদক রাহুল সিনহা) সহ সবাই আমাকে সাহায্য করেছেন৷ গাইড করেছেন৷ সম্বিৎ পাত্রও তাঁর ব্যস্ত সময় থেকে আমাদের সময় দিয়েছেন৷ এভাবেই পরিবারের মতো পরিবেশে আমরা দেশের জন্য কাজ করার চেষ্টা করছি৷ শ্রদ্ধেয় মোদীজীর শক্তিশালী ভারতের স্বপ্নের ভাগীদার হতে চেয়েছি৷’’
বিজেপি মিডিয়া সেলের টেকনিক্যাল বিষয়টার দায়িত্ব অর্নিবাণ বোসের উপর৷ বিটেক ছাডা়ও ওয়েব ডিজাইনিং এর জ্ঞান থাকা অনির্বান শেষ একবছর ধরে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, সহ ওয়েব সংক্রান্ত সমস্ত প্রযুক্তিগত বিষয়গুলির খুঁটিনাটি খেয়াল রাখে৷ পেশা নাকি নেশা কিসের কারণে বিজেপি মিডিয়া সেল? এই প্রশ্নের উত্তরে অর্নিবাণের উত্তর, আদর্শ এবং নরেন্দ্র মোদী প্রতি বিশ্বাস থেকেই এই লড়াইয়ে সামিল হওয়া৷
ডেটা মাস্টার কালীচরণ, হ্যাঁ এই নামেই হয়ত কলেজ পড়ুয়া ছেলেটিকে সম্বোধন করা উচিৎ৷ কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প৷ সেগুলো রাজ্যে কোথায় কতটা হয়েছে থেকে শেষ ১০ বছরের সমস্ত নির্বাচনের বুথ ভিত্তিক তথ্যের সংগ্রহ রয়েছে বিজেপি মিডিয়া সেলের ডেটা মাস্টার কালীচরণ সাউয়ের কাছে৷ সিএ-এর ছাত্র কালীচরণ স্পষ্ট জানান আদর্শের কারণেই রয়েছেন বিজেপি মিডিয়া সেলে৷