বাংলা ভাষাকে বাঁচাবেন কারা

“ইউনেস্কোর মতে ১০,০০০ এর কম মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষার বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেই হিসেবে ভারতে এখনও পর্যন্ত পাওয়া ৭৮০ ভাষার মধ্যে বিপদ সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ৬০০টির। এবং জানা যাচ্ছে গত ৬০ বছরে প্রায় ২৫০ ভারতীয় ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কি জানি, বাংলাভাষাও দূর ভবিষ্যতে এমন বিপদ সম্ভাবনার তালিকায় নাম লেখাবে কী না।“

২০১৯-এর ১ ফেব্রুয়ারি মালবী গুপ্ত এই মন্তব্য করেছিলেন বিবিসির এক প্রতিবেদনে। লিখেছিলেন, “নাহ্ বলতেই হচ্ছে , ‘.. আ মরি বাংলা ভাষা ‘ আর ‘মোদের গরব’ও নয়, ‘মোদের আশা’ ও নয়। অন্তত পশ্চিমবঙ্গে। থাকলে, আমার মনে হয়, বাংলা ভাষাকে আজ এমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হত না।“

আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের প্রাক্কালে মালবীর এই মন্তব্য কতজন সেভাবে অনুভব করবেন জানিনা। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত, মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনেক সময় ন্যূনতম ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে বাংলায় কথা বলতে দেখেছি। সদিচ্ছা  থাকলে আমরা সকলেই এভাবে লিখতে বা বলতে পারি। বাংলা বিভিন্ন প্রকাশিত খবরে ইংরেজি শব্দ দেখতে দেখতে রক্তের চাপ বাড়ে। চেয়ারকে কেদারা, টেবিলকে চৌপায়া না বলি ফার্নিচার, গোডাউন, ডাক্তার, মেমোরেন্ডাম, ইন্টারভিউয়ের বদলে কেন আসবাবপত্র, গুদাম, স্মারকলিপি, সাক্ষাৎকার কথাগুলো লিখব না? প্রতিষ্ঠানবিরোধী না লিখে কেন অ্যান্টি ইনকাম্বেন্ট লিখব? কৈলাশবাবু না লিখে কেন কৈলাশজী লিখব?

২০১১ সালের জনগণনা রিপোর্ট বলছে, শুধুমাত্র সংখ্যার নিরিখে দেশে হিন্দির পরেই সব থেকে বেশি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। সারা দেশে এই মাতৃভাষার মানুষ ৯ কোটি ৭২ লক্ষ ৩৭ হাজার ৬৬৯ জন এবং পশ্চিমবঙ্গে ৭ কোটি ৮৬ লক্ষ ৯৮ হাজার ৮৫২ জন। জনগণনায় মাতৃভাষার সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে, মা সন্তানের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেন, সেটিই মাতৃভাষা। কারও মা শৈশবেই মারা গেলে পরিবারের ভাষাই মাতৃভাষা। শিশু ও মূক-বধিরদের ক্ষেত্রে মায়ের ভাষাই মাতৃভাষা। সংশয় থাকলে সংশ্লিষ্ট পরিবারের কথ্য ভাষাকেই মাতৃভাষা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয় বলে জনগণনায় বলা হয়েছে।

কেউ বলতেই পারেন, বিভিন্ন ভাষা মিশিয়ে লিখলে কী এসে যায়? আমরা যেসব বাংলা কথা ব্যবহার করি, সেগুলোর একটা বড় অংশ তো আরবি, ফার্সি, তূর্কি থেকে এসেছে। বোঝা গেলেই হল। ফেসবুকে বাংলা, ইংরেজি বহু মন্তব্যে বানান, ব্যাকরনের মাথামুন্ডু থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, শুদ্ধ করার অনুরোধ করলে কিছু ক্ষেত্রে অপ্রীতিকর মন্তব্যের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। 

এক চিকিৎসক সংগঠন সংবাধমাধ্যমে নিয়মিত প্রেস বিবৃতি পাঠায়। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ওই সংগঠনের এক কর্তাকে হোয়াটসঅ্যাপে এটা লিখতে বাধ্য হলাম— “আপনাদের অনেকবার বলেছি। কেন ডাক্তার? কেন চিকিৎসক নয়? পাবলিক হেলথ পে কেন? কেন জনস্বাস্থ্য ভাতা নয়? কেন ডেপুটেশন? কেন স্মারকলিপি নয়? সামনেই ভাষা দিবস। প্রতি বছর এই দিনটিতে সব কুম্ভীরাশ্রু ফেলে। একটু চেষ্টা করুন না বাংরেজি বিবৃতি না দিয়ে শুদ্ধ বাংলা লিখতে! আগে আপনাদের অনেকবার এই আবেদন করেছি।“ 

আজ, মানে ১৯/২ যুক্ত সংগ্রাম পরিষদের একটা প্রতিবাদ সমাবেশ হচ্ছে। ওরা একটা ছোট্ট প্রেস বিবৃতি পাঠিয়েছে। এর মধ্যে এমন কিছু শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যেগুলো অনায়াসে বাংলা করা যায়। যেমন টাইম বাউন্ড প্রমোশন। কেন সময়ভিত্তিক পদোন্নতির বিধি লিখব না। অপশন কথাটা এখানে সুযোগ লিখলে ক্ষতি কী? ইউনিটকে কেন শাখা লিখব না?

কমপ্যাশনেট, কোয়ালিফায়েড পুলে প্রমোশন— একটু চিন্তা করলে এই কথাগুলোরও হয়ত বাংলা করা সম্ভব। 

কল্যাণ চক্রবর্তী নামে এক ব্যক্তি বছর চার আগে রাষ্ট্রভাষা হিন্দি কি না তা জানতে চেয়ে তথ্য জানার অধিকার আইনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকে প্রশ্ন করেন৷ তার উত্তরে জানানো হয়, ভারতে কোনও রাষ্ট্রভাষা নেই৷ হিন্দিকে রাজভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়৷ অর্থাৎ সরকারি কাজে ব্যবহৃত ভাষা৷ এই বক্তব্য হাতিয়ার করে ২০১৭-র ৯ অক্টোবর হাইকোর্টে মামলা করেন তিনি৷ তাঁর আইনজীবী অনিন্দ্যসুন্দর দাস বলেন, ‘হিন্দি রাষ্ট্রভাষা নয়, অথচ গত বছর তিনেক ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞাপন যা বাংলা দূরদর্শনে প্রচার করা হয়, তা-ও হিন্দিতে৷ এ রাজ্যে তা বাংলায় করতে হবে বলে মামলায় দাবি তোলা হয়৷ রেলের টিকিটে বাংলা ভাষায় কোনও নাম লেখা হয় না৷ এটা নিয়েও আদালতের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে৷ তা ছাড়া এ রাজ্যে যেহেতু বাংলাই অধিকাংশ নাগরিকের মাতৃভাষা, তাই সরকারি ক্ষেত্রে, অফিস-আদালতে বাংলা ব্যবহারের পক্ষে হাইকোর্টের রায় চেয়ে আবেদন করা হয়েছে৷৷’ ওই মামলায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে যুক্ত করা হয়৷ মামলার মূল বিষয়, যেহেতু হিন্দি রাষ্ট্রভাষা নয়, তাই জোর করে কারও উপরে তা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না৷ 

অনেকের বক্তব্য, যেহেতু রাজ্যের বর্তমান শাসকদল রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গের বদলে বাংলা করার পক্ষেই সওয়াল করছে, স্কুলস্তরে বাংলা পড়া বাধ্যতামূলক করার কথা বলেছে। ফলে বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবিতে আন্দোলনের অনুকূলেই যেতে পারে সরকারি অবস্থান৷ হিন্দি রাষ্ট্রভাষা নয় জেনেই এমন দাবি৷ উল্লেখিত মামলাকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষার পক্ষে নতুন করে আন্দোলন শুরু হয় কি না, তা নিয়ে কৌতূহল ছিল অনেকেরই৷ কিন্তু ফেসবুকে কিছু দাবি উঠলেও সঙ্গবদ্ধ আন্দোলন দানা বাঁধেনি। 

এ রাজ্যে বাংলা ভাষার প্রসারে নয়ের দশকে সরকারিস্তরে উদ্যোগ শুরু হয়৷ বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশও জোরালো প্রচার শুরু করেন৷ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হোর্ডিং-ফ্লেক্স বাংলায় লেখার দাবি ওঠে৷ সরকারি স্তরে বাংলা ব্যবহারের দাবিতে সে সময়ে আন্দোলনে উৎসাহ দেন তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও৷ কিছু ক্ষেত্রে সেই আন্দোলনে কাজ হলেও তা ধারাবাহিকতার অভাবে বেশি দূর এগোয়নি বলে ধারণা অনেকেরই৷ পশ্চিমবঙ্গের নাম ইংরেজিতে ওয়েস্ট বেঙ্গল বদলে বঙ্গ বা বাংলা বা বেঙ্গল করার দাবি সে সময় জোরদার হয়েছিল৷ আবার ক্যালকাটার বদলে ইংরেজিতেও কলকাতা লেখার আবেদনও সাড়া ফেলেছিল৷ সরকারি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা রূপায়ণের আশ্বাস দেওয়া হয় নানা সময়ে। মুখের কথাতেই আটকে গিয়েছে সে সব। “অনেক আমলা অবাঙালি, ওঁদের অসুবিধা হবে“— এই অজুহাত অন্তত আমি সঠিক বলে মনে করি না। 

আনন্দবাজার অনলাইন লিখেছিল, “প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, প্রয়াত রমেশচন্দ্র মজুমদার ১৯৬২-র বিধানসভা নির্বাচনে ‘সংযুক্ত বিপ্লবী পরিষদ’-এর প্রার্থী হয়ে বেহালা কেন্দ্র থেকে দাঁড়িয়েছিলেন। ওই দলের কাছে ‘আমরা বাঙালি’, এই মতাদর্শ অন্যতম ছিল। ফলাফল বলছে, সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের তিন জন প্রার্থীর মধ্যে সব থেকে কম ভোট পেয়েছিলেন রমেশচন্দ্র। ওই কেন্দ্রের ৬৪,৮৫২টি বৈধ ভোটের মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন মাত্র ৫,৯৯০টি।

স্মৃতি রোমন্থন করে শিক্ষাবিদ সৌরীন ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, প্রয়াত ইতিহাসবিদের মতো পণ্ডিত, বিদ্বান ব্যক্তি খুবই কম ছিলেন। কিন্তু তাঁর ‘আমরা বাঙালি’ মনোভাব, নির্বাচনে দাঁড়ানো এবং পরাজিত হওয়া নিয়ে অনেক নেতিবাচক চর্চাও হয়েছিল। ১৯৬২ সালের পরেও একাধিক বার বাংলা ভাষা নিয়ে বিপ্লব হয়েছে বা হচ্ছে। সেখানে বাংলায় হোর্ডিং লেখা, চিকিৎসকদের বাংলায় প্রেসক্রিপশন লেখা-সহ সবই রয়েছে। কিন্তু এই ভাষার ভবিষ্যৎ এ সবের উপরে নির্ভর করছে না বলেই বিশ্বাস সৌরীনবাবুর। তাঁর কথায়, ‘‘সারা বিশ্বের প্রায় ২৯-৩০ কোটি মানুষের কথ্য ভাষা বাংলা। ফলে বাংলা নিয়ে গেল-গেল রব তোলার পক্ষপাতী নই।’’

আমরা ছেলেমেয়েদের বাংলা মাধ্যমের স্কুলে না পড়িয়ে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়াই। ওদের সিংহভাগের সঙ্গে সুকুমার রায়, উপেন্দ্রকিশোর-অবনীন্দ্রনাথের পরিচয় হয় না। অজ্ঞাত থেকে যায় হজবরল, বুড়ো আংলা। বাংলা চ্যানেলের রিয়্যালিটি শোয়ে প্রায় অর্ধেক হিন্দি গান পরিবেশিত হয়। একটি চ্যানেলের জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে কোনও গানের শেষ অক্ষর দিয়ে গান করতে বললে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ সময়েই উপহার দেন হিন্দি গানের কলি। অথচ রবীন্দ্রনাথ থেকে সলিল চৌধুরীর কত গান সেই অক্ষর দিয়ে আছে, আমরা মনে রাখিনা। রাখার চেষ্টাও করি না। 

আবার ফিরে যাই মালবীর লেখায়— “মনে হতে পারে, একটা ভাষা তো বেঁচে থাকে এবং সমৃদ্ধ হয় বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করেই। এবং এও মনে হতে পারে, প্রতি বছর পশ্চিমবঙ্গে যখন হাজার হাজার বাংলা বই প্রকাশিত হচ্ছে, তখন এর মৃত্যু ঘণ্টা বাজাবে কে? তবে মৃত্যু না হলেও সে যে ক্রমে রক্তহীন হচ্ছে, চারপাশে একটু সজাগ দৃষ্টিপাতেই তা টের পাওয়া যায়। কারণ, যে মাতৃভাষার আন্দোলন বাংলাদেশকে প্রসব করেছে, যে আন্দোলনের হাত ধরে সারা বিশ্ব ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পেয়েছে, সেই ভাষা নিয়ে সেই দেশবাসীর চূড়ান্ত আবেগ এবং গভীর ভালবাসা হয়তো স্বাভাবিক। অপর দিকে, পশ্চিমবঙ্গের জন্ম বাংলাদেশের মত কোন রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে হয় নি। রাজ্যবাসীদের কাছে বাংলাভাষা অনেকটাই যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। তাই তাকে নিয়ে কোন বিশেষ আবেগ নেই আমাদের। বরং যা রয়েছে তা হল কিছুটা অবজ্ঞা মিশ্রিত অবহেলা।“

অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.