পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে: তৃনমূল সরকারের প্রশাসনিক​ অবক্ষয় এবং জনগণের ভবিষ্যৎ

বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশের ভেতরে আজ প্রায় পাঁচ দশক ধরে চলে আসছে এক স্বৈরাচারী শাসন। দীর্ঘসময় ধরে চলে আসা এই নির্মম স্বৈরাচারী শাসনের শিকার হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের​ জনগণ। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের গনতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে স্বৈরতন্ত্রী কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ​ ঘোষণা করেছিল তার ফলেই  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসীন হতে পেরেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পূর্ববর্তী কমিউনিস্ট সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মাননীয়া শুধু বাঙ্গালার মানুষকে হতাশই করেননি  এককথায় তিনি জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।

বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইগুলিতে জায়গা করে নিয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিকৃত ইতিহাস যারফলে নতুন প্রজন্মের কাছে দেশভাগ থেকে শুরু করে পুরো স্বাধীনতা আন্দোলনের ভুল ব‍্যাখ‍্যা পৌঁছে যাচ্ছে, আর আসল সত্য তলিয়ে যাচ্ছে কালের অতলে। ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন হুসেন শাহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং তিনি ছিলেন “গ্ৰেট ক‍্যালকাটা কিলিং” -এর মূল হোতা। তাঁর  শাসনকালে যে ব্যাপক গণহত্যার​ ঘটনা হয়েছিল তার ভয়ঙ্কর স্মৃতি আজও বাঙালি মনের​ মধ্যে বয়ে নিয়ে চলছে।

হিন্দু বাঙালি সম্প্রদায়কে বাঁচানোর তাগিদে ডঃ শ‍্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় মুসলিম লীগের হাত পশ্চিমবঙ্গকে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এই ঘটনার প্রায় ৭৪ বছর পর, সোহরাবর্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানানোর একটি পোস্ট দেখেছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই পোস্টের মৌলিকতা বা পোস্টের স্রষ্টার সম্পর্কে সত‍্যতা যাচাইয়ের পরিবর্তে মাননীয়ার পুলিশ প্রশাসন সেইসব  সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করেছিল যারা এমন একটি ন‍্যাক্কারজনক পোষ্টের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছিল। দিন দিন আমরা কোন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি সেটা বোঝানোর জন্য আশা করি এই একটি ঘটনাই যথেষ্ট!

তৃনমূল নেতারা দেশের প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্য রাজ্যের বিজেপি নেতাদের বহিরাগত বলে আক্রমণ করার নতুন ট্রেন্ড শুরু করেছে। এবার মজার ব্যাপার হলো যে ২০১৯ সালের​ নির্বাচনের​ সময় তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনের জন্য মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যখন অন্যান্য আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে হাত মিলিয়ে ছিলেন তখন কিন্তু কোনো সমস্যা থাকেনি। এমনকি আমাদের মতো সাধারণ প্রবাসী বাঙালিদেরও বহিরাগত তকমা দিতে পিছপা হচ্ছেন না তৃনমূল সাংসদ। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি​ যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই স্বৈরচারী শাসনের সাথে ফ্যাসিবাদের অনেকগুলি  লক্ষণ খালিচোখেই​ স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

এখনও পর্যন্ত, রাজ্যে ১৩৮ টি রাজনৈতিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। জনসমক্ষে নিষ্ঠুরভাবে মানুষের উপর অত্যাচার করে, খুন ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু রাজ্য পুলিশের সাহস ছিল না এমন ঘটনাকে খুন বলে ঘোষণা করার বা দোষীদের শাস্তি দেওয়ার। সম্প্রতি বিজেপি দলের এক কর্মীকে থানার কাছে গুলি করা হয়। এছাড়াও কিছুদিন আগে নির্বাচনী  প্রচারে অংশ নিতে গিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টির দুজন কর্মীকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। 

পুলিশের সামনেই বিজেপির জাতীয় সম্পাদকের কনভয়ে গুন্ডারা হামলা চালায়। কিন্তু রাজ্য সরকারের​ তরফে এই ঘটনার তদন্ত করা তো দূর বরং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের প্রতিবাদ করার সুযোগটুকু দেওয়া হয়নি। এই ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নামা সাধারণ মানুষের জোর করে কন্ঠরোধের চেষ্টা করা হয়।

দ্বিতীয়ত, গোড়া থেকেই সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংককে সন্তুষ্ট করতে তৃণমূল সরকার সবরকম চেষ্টা করে এসেছে। সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ তোষন নীতির​ পত্তন করেছেন। অত‍্যন্ত কুটনৈতিক উপায়ে সবদিক থেকে অগ্ৰাধিকার দিয়েছেন এই বিশেষ সম্প্রদায়কে। একই দিনে এই বিশেষ সম্প্রদায় তাদের উৎসব পালন করার অনুমতি পেলেও বাঙ্গালী হিন্দুদের​ দেবী “মা দুর্গা”র  প্রতিমা বিসর্জনের অনুমতি পাওয়ার জন্য আদালতে ছুটতে হয়েছে।

এমনকি কোভিড অতিমারীর সময় লকডাউন চলাকালীন, সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে সীমাবদ্ধ করতে বলার মতো সাহস সরকারের ছিল না। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, ধাপে ধাপে লকডাউন তোলার সময় শুক্রবারকে ছাড় দেওয়া হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের জন্য জড়ো হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রসাশনিক বাধার​ সম্মুখীন হতে হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি দাঙ্গা হয়েছে এবং যথারীতি নিজেদের ভোট ব্যাংক সুরক্ষিত রাখতে সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে গেছে। 

এছাড়াও, বেশিরভাগ টিভি চ্যানেল তৃনমূলের দালালে পরিনত হয়েছে। শাসকদলের গুন্ডামি বা রাজ্যের মন্ত্রীদের মিথ্যা দাবির বিরুদ্ধে তারা দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের মুখ বন্ধ রাখে। এই অরাজকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য সন্ময় ব্যানার্জী, শফিকুল ইসলামের মতো খ‍্যাতনামা ব‍্যক্তিত্বদের জেলে পাঠানো হয়েছে।

 দুর্নীতি তৃনমূল সরকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেছে। অনেকগুলি কেলেঙ্কারী বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে। এছাড়াও, কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা দিন দিন কমে আসছে।  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই​ তিনি “সেজ”(স্পেশাল ইকোনমিক​ জোন) বন্ধ করার পাশাপাশি এফডিআইয়ের বিরুদ্ধে চলে যান। এখনও পর্যন্ত রাজ‍্যে ছোট বড় কোনো ধরনের শিল্পায়ন হয়নি এমনকি শিল্পের পরিকাঠামো গড়ে তোলার ব‍্যাপারের কোনোরকম নজর দেওয়া হয়নি। জনগণের সর্বশেষ আশা ছিল সরকারি চাকরি। কিন্তু দুর্নীতির​ করালগ্ৰাস সেই আশাকেও গলা টিপে খুন করেছে। উন্নয়ন নয় অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে সমাজ খুব দ্রুতগতিতে। 

রাজ্যের মন্ত্রী এবং তৃনমূল নেতাদের পরিচিত ব্যক্তিদের কোভিডের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে ব‍্যাপকহারে অভিযোগ পাওয়া গেছে এবং এমনকি​ বিভিন্ন নেতা মন্ত্রীদের আত্মীয়রা অন‍্যায়ভাবে এমনসব  উচ্চপদে রয়েছেন যেখানে থাকার মতো যোগ‍্যতা বা গুনমানের ছিঁটেফোঁটাও তাদের মধ্যে নেই।  মাননীয় কলকাতা হাইকোর্ট সম্প্রতি ৬ বছর ধরে চলা আইনি লড়াইয়ের পরে ওয়েষ্টবেঙ্গল স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ তালিকা বাতিল করে দেন যা আবারও প্রমাণ করে যে দুর্নীতি আজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে।

রাজ্যের​ আইন শৃঙ্খলা অনেকদিন আগেই ভেঙ্গে পড়েছে বরং বলা ভালো ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে।  হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর বারবার আঘাত করা হয়েছে, নির্যাতনের শিকার হয়েছে হিন্দুরা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে যেভাবে তোষামোদ  করা হচ্ছে এবং নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরোধিতা চলছে তারফলে একটা প্রশ্ন বারবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যে তৃনমূল সরকার কি তাহলে পশ্চিমবঙ্গকে দ্বিতীয় বাংলাদেশ বানাতে চাইছে? অতীতে হিন্দু বাঙালি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব দু’বার সংকটের মুখে পড়েছিল। তৃনমূল সরকার যদি আবারও ক্ষমতায় থেকে যায় তবে আমাদের তৃতীয় যুদ্ধের​ জন্য নিজেদের তৈরী রাখতে হবে। 

গত এক দশকে রাজ্য সরকার শিল্পায়নের জন্য পরিকাঠামোগত উন্নয়নের​ কোনো রকম চেষ্টা করেননি। তারপরেও দিনের পর দিন ধরে শুধু ঋনের বোঝা বাড়িয়েই চলেছেন। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন প্রায় দোড়গোড়ায় চলে এসেছে। তৃনমূল সরকারের মিথ্যে প্রতিশ্রুতির​ জালে আটকা না পড়ে সঠিক সরকার নির্বাচন করা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, দশের জন্য​ সর্বোপরি দেশের জন্য একান্ত জরুরী।

দ্রষ্টব্য: নিবন্ধটি লিখেছেন রানা প্রসন্ন ব্যানার্জি, কানাডার রিসার্চ স্কলার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.