বাংলা ননসেন্স সাহিত্যে সুকুমার রায়ের একটি অনবদ্য সংযোজন হলো হ য ব র ল। ভারতবর্ষের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন শেষ হতেই বুথ ফেরত সমীক্ষায় হার সুনিশ্চিত বুঝে গিয়েই মোদী বিরোধী চুনোপুঁটি আঞ্চলিক দলগুলি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন আর ভিভি প্যাট নিয়ে সে আচরণ দেখাল তাতে হযবরল-র দুটি চরিত্রের কথা মনে পড়ে গেল। প্রথমটি হলো হিজবিজবিজ। যাকে নাম জিজ্ঞাসা করলে সে অকাতরে বলে যেত, আমার নাম হিজবিজবিজ। আমার ভাইয়ের নাম হিজবিজবিজ। আমার পিসের নাম হিজবিজবিজ… ইত্যাদি। দ্বিতীয় চরিত্রটা হলো কাকেশ্বর কুচকুচে যে বিজ্ঞ পণ্ডিতের মতো হেঁড়ে গলায় জিজ্ঞাসা করত— সাত দু’গুণে কত হয়। তারপর গাল ফুলিয়ে উত্তর দিত— সাত দুগুণে চোদ্দর চার হাতে রইল পেনসিল।
যে দলগুলির অস্তিত্ব টিকে আছে দু’চারটি সাংসদ আসনের মধ্যে, যাদের সর্বভারতীয় পর্যায়ে ল্যাজ নাড়ানোর সুযোগই নেই, তাদের হাতে এখন ওই কাকেশ্বর কুচকুচের মতো হাতে পেনসিল অবস্থা। রাফায়েল, পুলওয়ামা থেকে হাজারো অস্ত্র ব্যবহার করেও মোদী নামক ব্রহ্মাস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত রাগ উপড়ে দিতে শুরু করেছে ইভিএম আর ভিভি প্যাটের ওপর। তার কী হাস্যকর প্রস্তাব ভিভি প্যাটের সব স্লিপ গুনতে হবে। ইভিএম নাকি ট্যাম্পারিং হয়েছে।
নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা। কিংবা সব শালাকে ছেড়ে দিয়ে বেঁটে শালাকে ধর। প্রবাদবাক্যগুলির বাস্তবিক প্রয়োগ দেখিয়ে চুনোপুঁটিরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন— তারা হেরেছেন বাস্তববোধের অভাব থেকে। ভবিষ্যতেও হারবেন মতিভ্রমের কারণেই।
ভারতবর্ষে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন প্রথম ব্যবহার হয়েছিল ১৯৮২ সালে কেরলের পারাভুর বিধানসভা ক্ষেত্রের উ পনির্বাচনে। এটা ছিল অনেকটাই পরীক্ষামূলক। পরে ১৯৮৯ থেকে বৃহৎ সংখ্যায় ইভিএম ব্যবহার শুরু হয় স্বচ্ছ ভোটদানের তাগিদেই। কারণ ইভিএম চালু হওয়ার পর ব্যালট পেপারে ছাপ্পা ভোট দেওয়ার যে বৃহত্তর চক্রান্ত রাজ্যে রাজ্যে রাজ করে বেড়াত, তা ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। ছোটো ছোটো রাজ্যভিত্তিক শক্তিগুলি সেদিনই বুঝে গিয়েছিল— ছাপ্পা ভোটের যুগ শেষ। তাই প্রায় প্রতিটা নির্বাচনের আগেই ইভিএমকে ভিলেন সাজানোর চেষ্টা করেছে আঞ্চলিক দলগুলি। তারপর ভোটের ফলাফলে যখন জিতেছেন, মুখে কুলুপ এঁটেছেন। আর হারলেই চিৎকার করে গগন ফাটিয়েছেন যে সায়েন্টিফিক রিগিং হয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মনোবিদরা বলেন, মানুষ যখন ব্যর্থতার সাগরে হাবুডুবু খায়, তখন সে ঘুমের মধ্যে নানা দুঃস্বপ্ন দেখে।
অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে হয় এমন সব আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলি (২/৪টি দল ছাড়া) হতাশাজাত দুঃস্বপ্নের শিকার হয়েই হযবরল-র হিজবিজবিজের মতো আচরণ করেছে। ভুলভাল বকে ভোটারদের কাছে নিজেদের হাস্যাস্পদ করে তুলেছে আর অদূর ভবিষ্যতে কোমর সোজা করে দাঁড়াবার মতোশক্তিটাও বৃথাই ব্যয় করেছে। এই বিরোধী দলগুলিই ২০১৮-য় রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ আর ছত্তিশগড়ের বিধানসভা নির্বাচনে ইভিএমের বদলে ব্যালটে ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়েছিল। তিনটি বিধানসভাতেই জেতার পর আর কেউ রা কাড়েনি।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন আসলে একটি বিশেষ ধরনের যন্ত্র যা পুরোপুরি ওয়েব-লিঙ্ক বহির্ভূত। এই মেশিনগুলি তৈরি হয় বিভিন্ন রাজ্যে সরকারের তত্ত্বাবধানে রাজ্যে রাজ্যেই এবং তা মজুতও করা হয় রাজ্য স্তরেই। ভোটের প্রার্থীদের নামগুলি যুক্ত হয় প্রার্থীপদ জমা পড়ার পর। তার আগে নয়। সুতরাং ইভিএম আগেভাগে কারচুপির তত্ত্বটা একটা অলীক কল্পনা মাত্র। কারণ প্রার্থীদের নামের তালিকা থাকে নামের আদ্যক্ষরের ভিতিতে ক্রমানুযায়ী। সেক্ষেত্রে তাহলে প্রতিটি মেশিনে আলাদা ভাবে কারচুপি করতে হয় যা একেবারেই অসম্ভব। নামের তালিকা আদ্যক্ষরের ক্রমানুযায়ী লাগানোর পরই প্রতিটি মেশিন সিল করে দেওয়া হয়। সেই সিল খোলা হয় নির্বাচনী বুথে ভোট নেবার সময়। যা করা হয় সব রাজনৈতিক দলের এজেন্টদের সামনে। তারপর হয় মক টেস্ট যা নিশ্চিত করে মেশিনের কার্যকারিতা।
নির্বাচন শেষ হওয়ার পরে প্রার্থীদের এজেন্টদের সামনেই মেশিনগুলি পুনরায় সিল করা হয়। তারপর তা পাঠানো হয় স্ট্রংরুমে যা সংরক্ষিত থাকে কড়া পুলিশি প্রহরায়। স্ট্রংরম থাকে সম্পূর্ণ ভাবে তালাবন্দি। এমনকী তালার কি-হোলটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। পুনরায় মেশিনগুলি প্রকাশ্যে খোলা হয় ভোট গণনার দিন। এবার ভোটে ভিভি প্যাট ব্যবস্থায় প্রত্যেক ভোটার দেখে নিতে পেরেছেন, তার ভোট সঠিক প্রার্থীপদে পড়ল কিনা। তার পরেও বিরোধীদের সন্দেহ প্রকাশ ভিমরতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
মোদীকে শায়েস্তা করতে না পেরে বিরোধীরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। এও এক অবান্তর প্রচেষ্টা। কারণ ভারতবর্ষের নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে তুলেছেন ভারতের এ যাবৎ সবচেয়ে দৃঢ়মনা সৎ চরিত্রের নমুনা নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী যিনি তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গড়ে ছিলেন দুর্নীতি থেকে নির্বাচন কমিশনকে মুক্ত করতেই। এবার শক্তসমর্থ। নির্বাচন কমিশন যখন স্বচ্ছ নির্বাচনের স্বার্থে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে, তখনই গোঁসা হয়েছে ছোটো ছোটো আঞ্চলিক দলগুলির। কারণ ভোটবাজারে করে খাওয়ার রাস্তা বন্ধ। করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। মোদীর যোগসাজস! ‘বলবেন না কত্তা। বেড়ালে। হাসব। মনে রাখা দরকার, নির্বাচন চলাকালীন সবচেয়ে বেশি টাকা নির্বাচন কমিশন উদ্ধার করেছে বিজেপির কাছ । থেকেই। এই নির্বাচন কমিশনই বিজেপি শাসিত ত্রিপুরা রাজ্যে একটি লোকসভা কেন্দ্রের ১৫ শতাংশ বুথে পুনর্নির্বাচনের আদেশ দিয়েছেন। যদি সত্যিই মোদী-ভালোবাসায় নির্বাচন কমিশন আপ্লুত হতেন, তাহলে কি এমন বিজেপি বিরোধী। পদক্ষেপ নিতেন?
মনে আছে গোপাল ভাঁড়ের সেই গল্পটা? যেখানে গোরু হারিয়ে গোপাল নিজের বউকেও মা বলে ডেকে ফেলায় কৈফিয়ত দিয়েছিলেন গোরু হারালে এমনই হয় গো! বিরোধীরা এখন সব গোরু হারিয়ে ছন্নছাড়া। অতএব আগামী কয়েকমাস তারা ভুলভাল বকবেন। তারপর যখন দেখবেন, হালে পানি পাচ্ছেন না, নিজেরাই খোলসের মধ্যে শীতঘুমে চলে যাবেন সাপের মতো।
প্রবন্ধটি শুরু করেছিলাম হযবরল-র গল্প দিয়ে। শেষও করি তাহলে ওই হযবরল দিয়েই। কারণ বিরোধীদের ভোট পরবর্তী আচরণে হযবরল-র চেয়ে ভালো অনুষঙ্গ আর খুঁজে পাচ্ছি না।
সেই বেড়ালছানাটার কথা মনে করুন, যে রুমাল থেকে বেড়ালে রূপান্তর হয়েছিল আর তার নাম জিজ্ঞাসা করলে সে পায়ের থাবা চাটতে চাটতে বলেছিল— বেড়ালও বলতে পারো, রুমালও বলতে পারো। আবার চন্দ্রবিন্দুও বলতে পারো। ভোটের ফলাফল মোদী বিরোধীদের নামের আগে একটা করে চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে দিয়েছে। ভারতীয় রাজনীতিতে ওই বিরোধীরা এখন স্বর্গত, প্রয়াত। প্রয়াত মানুষের ওপর রাগ পুষে রাখবেন না। মৃতের সঙ্গে শত্রুতা করতে নেই। অতএব ওদের সব বিরোধিতা, সব মূর্খামি, সব ঔদ্ধত্য, সব হাস্যকর আচরণ ভুলে গিয়ে ওঁদের আত্মার শান্তি কামনা করুন।
সৃজিত রায়
2019-05-31