লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে সন্ত্রাস ও হামলা চালানো হয়েছে তা পৃথিবীর কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যে কি কাম্য? এই প্রশ্ন বিভিন্ন মহল থেকে উঠে আসছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সব নির্বাচনেই গণতন্ত্র আক্রান্ত হয়েছে। লোকসভা থেকে বিধানসভা, পঞ্চায়েত, পুরসভা-সহ স্কুল-কলেজের নির্বাচনেও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি পদদলিত। আসলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে দুবৃত্তায়ন ঘটেছে। তৃণমূল ক্ষমতায় এসে জনগণকে শান্তি ও স্বস্তি দেওয়ার পবিবর্তে তাদের স্বাধীনতা হরণ করে নিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসা চলে আসছে বহুদিন থেকে। কিন্তু তৃণমূল সরকারের আমলে চরম আকার নিয়েছে। এই বাঙ্গলায় এখন গণতন্ত্রের নরকযাত্রা চলছে। পশ্চিমবঙ্গে এবারের লোকসভা নির্বাচন উপলক্ষ্যে আসা বিশেষ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক অজয় নায়েকের বক্তব্যেই তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তিনি দশ বছর আগের অশান্ত বিহারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তুলনা করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে ভোটকর্মীরা যে কতটা আতঙ্কিত তা তাদের কথাতেই বোঝা যায়। কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়া নির্বাচনের কাজে যেতে সরকারি চাকুরিজীবীরা ভয় পেয়েছেন। এজন্য বুথে সক্রিয় নিরাপত্তারক্ষী মোতায়নের জন্য ভোটকর্মীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। ২০১৬ সালে রায়গঞ্জে ভোটকর্মী রাজকুমার রায়ের পরিণতি এখনও তারা ভোলেননি। তাই কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব বারবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল বুথে বুথে সিভিক ভলেন্টিয়ারদের নিয়োগ করেছিল, যাদের চাকরি দেওয়া হয়। তৃণমূলের আমলে এবং তৃণমূলের ক্যাডার হওয়াই ছিল যাদের যোগ্যতার মাপকাঠি। তাদের নিরাপত্তায় রাজ্যের সাধারণ মানুষ গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিজের ভোট নিজে দিতে পারেনি। ফলে তৃণমূলের জল্লাদ ও হার্মাদবাহিনী অবাধে ভোট জালিয়াতি করেছিল। প্রায় অর্ধেক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং বাকিগুলিতে জনগণকে সার্বিকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না দিয়ে জিতে গিয়েছিল তৃণমূল।
২০১৬ সালে নির্বাচনের আগে কমরেডদের কায়দায় বিরোধী প্রার্থীর মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেওয়া, ব্যালট বাক্স লুট, নির্বাচনে জেতা প্রার্থীদের এলাকা ছাড়া করা প্রভৃতি ঘটনা ঘটতে থাকে রাজ্য জুড়ে। বিরোধী প্রার্থীদের বিশেষ করে মহিলা প্রার্থীদের অত্যাচারের ঘটনা সমস্ত রকম মানবিকতাকে লজ্জা দিয়েছে। রাজ্যের বহু জায়গায় বিরোধী প্রার্থীদের ভয় বা লোভ দেখিয়ে নিজেদের দলে টেনেছে শাসকদল। এমনকী জেতা প্রার্থীরাও এর থেকে রেহাই পায়নি। এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সহ বিভিন্ন বিরোধী দলকে নানা অজুহাতে সভা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। আর অনুমতি দিলেও শাসকদলের নির্দেশে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানাভাবে হেনস্থা করা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের হেলিকপ্টার নামার অনুমতি দেয়নি রাজ্য প্রশাসন। শাসকদল বিরোধীদের বহু সভা বানচালের কৌশল করেছে প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে নিয়ে। কুৎসিত ভাষায় বিরোধী নেতা-নেত্রীদের আক্রমণ, সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমণ ও কুমন্তব্য করার ট্রাডিশন চালু করেছে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-নেত্রীরা। এখন এটাই যেন পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল তাদের গুণ্ডাবাহিনীকে জলপাই রংয়ের পোশাক পরিয়ে বুথে বুথে পাঠানোর কৌশল করে বলে অভিযোগ ওঠে। এই পোশাকের সঙ্গে কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনী ও জওয়ানদের পোশাকের সাদৃশ্য থাকায় সাধারণ ভোটাররা তাদের কেন্দ্রীয় বাহিনী বলে ভুল করবে। এর ফলে তৃণমূলের ওই গুন্ডাবাহিনী এলাকায় ছাপ্পা ভোট করানোয় সফল হবে। ভোটে হেরে যাওয়ার সম্ভাবনায় আতঙ্কিত হয়ে তৃণমূল তাদের জল্লাদবাহিনীকে ওই ধরনের পোশাক পরিয়ে ক্যামোফ্লেজ করতে চেয়েছিল। তাই কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকা সত্ত্বেও তৃণমূলের দাপটে বিফল হয়েছে কমিশনের মেশিনারি। সব মিলিয়ে জঙ্গল রাজে পরিণত পশ্চিমবঙ্গ। ব্যারাকপুর, হুগলি, ঘাটাল, কেশপুর, মেদিনীপুর, আরামবাগ, বনগাঁ, ধনেখালি, বীরভূম সহ বিভিন্ন জায়গায় বিরোধী দলের বুথ এজেন্টের বাড়িতে ভাঙচুর, বিজেপিকর্মীর বাড়ির সামনে বোমাবাজি, বিজেপির এজেন্টকে মারধর ও হামলা করার অভিযোগ ওঠে। এই লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিটি জেলাতেই হয়েছে। অশান্তি, হামলা, সন্ত্রাস ও বোমাবাজি। শুধু ভোটের দিনই নয়, ভোটের পরও জারি থেকেছে হিংসা।
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যজুড়ে যে অরাজকতা সৃষ্টি করেছিল এবং ২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচনে যে ছবি ফুটে উঠল— তা কোনও গণতান্ত্রিক দেশে কাম্য নয়। তবুও হয়েছে। বামেরা প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করত ঠিকই কিন্তু এতটা বেআব্রু দলদাস প্রশাসন তখন ছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে প্রশাসন দলদাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। প্রায় ১০০ কোটি মানুষ এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। কোথাও নির্বাচন ঘিরে বাঙ্গলার মতো এমন অশান্তির খবর আসেনি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে প্রথমদফা থেকে সপ্তম দফা পর্যন্ত প্রতিটিতেই অশান্তি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কঠোর অবস্থানের পরেও চিত্রটা বদলায়নি।
রাজনীতি থেকে অনেক আগেই সভ্যতা, ভদ্রতা নম্রতা, সততা, সৌজন্য, শিষ্টাচার ও শালীনতাবোেধ উধাও হয়ে গিয়েছে। রাজনীতিকরা সচেতনভাবেই তা বিসর্জন দিয়েছেন। গণতন্ত্র তাই আজ ক্রমশ পিছু হটছে। কিন্তু তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। যেন এমনটাই চান এই রাজ্যের শাসকদলের নেতারা। বাঙ্গলার জনগণও অনেকটা ‘সহনশীল হয়ে গিয়েছেন। তারা মেনে নিয়েছেন বা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন বাঙ্গলার রাজনৈতিক নেতাদের শিষ্টাচারহীনতা।
পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের মেরুদণ্ড আর শক্ত নেই। আজকে প্রতিবাদী চরিত্রের খুব প্রয়োজন। প্রকৃত পক্ষে গণতন্ত্র, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী আর সরকারের মধ্যে একটা ক্ষমতার ভারসাম্যের খেলা চলছে। এখন গণতন্ত্র প্রহসনে হয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গে মাটিতে। এখনকার কিছু বুদ্ধিজীবী যেন ‘Neither right nor left, but upright হয়ে পড়েছে। এই ‘upright’ থাকা একটি ‘ইউটোপিয়ান’ ধারণা। এটিও শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা গ্রহণ করছেন। এখান থেকে। বেরুতেই হবে। এজন্য প্রতিবাদ দরকার। সততার জন্য, আদর্শের জন্য লড়াইয়ে নামতে হবে জনসাধারণকেই।
প্রথম দফা থেকে শেষ দফা পর্যন্ত রাজ্যের ভোটের দিনে অশান্তির ঘটনার পাশাপাশি ক্ষীণ আলোর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সাধারণ মানুষ শাসকদলের সন্ত্রাস ও হামলাকে উপেক্ষা করে গণতন্ত্রকে কায়েম করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হচ্ছেন। এর ফলে নড়ে চড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে প্রশাসন। সাধারণ মানুষ যদি ঐক্যবদ্ধ ভাবে গণতন্ত্র রক্ষার দাবিতে সরব হন তাহলে বাঙ্গলার হৃতগৌরব আবার ফিরে আসবে—এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
এই প্রেক্ষাপটে হিন্দুত্ব পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে একটা ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। হিন্দুত্বের মধ্যে জ্ঞান, অনুভূতি ও ক্রিয়ার এক সার্থক সমন্বয় দেখা যায়। এই ধর্মের একটা সামাজিক প্রকাশ আছে। ধর্ম ব্যক্তি নির্ভর বিষয় নয়, ধর্ম হলো সামাজিক বিষয়। ধর্মের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ধর্মবোধের মননশীল ক্ষেত্রটি বিশেষভাবে ব্যাপক ও সমৃদ্ধ। কারণ ধর্মের ধারণার মধ্যে বিভিন্ন সদুপদেশ ও মননশীল পর্যায় রয়েছে। সামাজিক বিধি-নিষেধ মেনে চলতে ধর্ম মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সূত্রে এক ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এই পরিবেশের প্রভাবে মানুষের আচার ব্যবহার স্বভাবতই সংযত হয়ে পড়ে।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে গ্রামবাংলার মানুষ সেই ধর্মীয় বাতাবরণেই শান্তি খুঁজতে চেয়েছেন, সমাজের নীতি ও আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তারই প্রতিফলন ঘটেছে। ইভিএমে। যেহেতু বিজেপি এই ধর্মীয়। বাতাবরণে দেশবাসীকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাই এই লোকসভা নির্বাচনে গেরয়া শিবিরের উ পরই পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের জনগণ ভরসা রেখেছেন। এই রাজ্যে গেরুয়া শিবিরের জয়জয়কার দেখা গিয়েছে। ভারতবর্ষের জনগণ একটা আদর্শবান মজবুত সরকার চেয়েছিল, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে তারই বহিঃপ্রকাশ। ঘটেছে। বিপুলভাবে মোদীজীর পক্ষে দেশবাসী রায় দিয়েছে। এই জয়ের পর নরেন্দ্র মোদীজী বলেন, দেশের মানুষ ভারতের জন্য ভোট করেছেন। দেশের নাগরিকদের ভাবনা দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সূচিত করছে। এই ভোট কোনও দল লড়েনি। লড়েছে ভারতের জনতা। এই জয়। ভারতের জনতাকে সমর্পণ করলাম। কোটি কোটি দেশবাসী আমার মতো ফকিরের ঝোলা পূর্ণ করে দিয়েছেন। আমি ১৩০ কোটি জনতাকে প্রণাম জানাই। পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ইতিহাসে আজকের জয়ই সবথেকে বড়ো সাফল্য।
মহাভারতের যুদ্ধের পর শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, আমি কারও পক্ষে নয়, হস্তিনাপুরের উন্নতির পক্ষে ছিলাম। আজ ২০১৯ সালেও ভারতের ১৩০ কোটি মানুষ শ্রীকৃষ্ণের রূপেই ভারতের উন্নয়নের পক্ষে ছিলেন।
তাই আজ বিজয়ী হয়েছে ভারত। বিজয়ী হয়েছে জনতাজনার্দন। বিপুল জয়ের পর। এভাবেই প্রতিক্রিয়া দিলেন নরেন্দ্র মোদী। বললেন, আমি আজ প্রতিজ্ঞা করছি, আমি নিজের জন্য কিছুই করব না। আমার প্রতিটি মুহূর্তই হবে দেশবাসীর জন্য এ ধরনের ভাবনা একজন সৎ আদর্শবান ধার্মিকের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। তাই দেশে গণতন্ত্র। প্রতিষ্ঠা করতে হলে ধর্মীয় শৃঙ্খলা ও নীতি আদর্শ মেনে চলা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তবেই। দেশে সার্বিকভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বাস্তবায়িত হতে পারবে। হিন্দুত্বের এই জাগরণের পথ ধইে ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করবে।
সরোজ চক্রবর্তী
2019-05-31