এটা আর কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না যে, এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী এক অবিসংবাদী নেতা এবং অদূর ভবিষ্যতে রাজনীতির ময়দানে তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কোনো নেতার অভ্যুত্থান ঘটবে সে সম্ভাবনাও কম। পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকার পর দ্বিতীয়বার আরও বিপুল পরিমাণ জনাদেশ নিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের নজির ভারতে তো বটেই, সারা বিশ্বেও কম। ভারতে এর আগে একমাত্র ইন্দিরা গান্ধী পাঁচ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বকাল অতিক্রম করার পরও প্রথমবারের থেকেও বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় ফিরতে সফল হয়েছিলেন। তারপর নরেন্দ্র মোদী সেই দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি নিজেই নিজের অতীত রেকর্ডকে ভাঙলেন। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি এবার লোকসভায় একক শক্তিতে তিনশো পার; আর জোট হিসাবে এনডিএ সাড়ে তিনশো। বোঝাই যাচ্ছে, ২০১৪-য় যে মোদীঝড় সারা দেশে বয়ে গিয়েছিল, এবার সে ঝড় আরও প্রবল আকার ধারণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে যেখানে ২০১৪ সালে সে অর্থে মোদী ঝড় তেমন ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, এবার সেই রাজ্যও মোদী ঝড়ে গেরুয়াময়। পশ্চিমবঙ্গই এবার নরেন্দ্র মোদীকে ১৮ জন সাংসদ উপহার দিয়েছে। জনসঙ্ এবং তার পরে বিজেপির ইতিহাসে যা এই প্রথম। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন নিঃসন্দেহে ভারতীয় রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কিন্তু তার পাশাপাশি এই নির্বাচনই প্রমাণ করে দিয়েছে রাজনীতিবিদ হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর উচ্চতা এবং যোগ্যতা।
এবারের নির্বাচনই প্রথম, যেখানে কোনো রাজনৈতিক শক্তি নয়, একজন ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নেমেছিলেন কংগ্রেস সভাপতি-সহ দেশের তাবৎ বিরোধী নেতৃত্ব। রাহুল গান্ধী থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রবাবু নাইডু থেকে শারদ পাওয়ার, লালুপ্রসাদ থেকে মায়াবতী, অখিলেশ যাদব থেকে সীতারাম ইয়েচুরি— সকলের লক্ষ্য ছিল একটিই তা হলো নরেন্দ্র মোদী। সকলেরই মুখে ছিল একটিই হুংকার—মোদী হঠাও। বিগত পাঁচ বছরে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে এদের সুর ক্রমাগত চড়া হয়েছে। রাজনৈতিক বিতর্কের বদলে নিম্নমানের ব্যক্তিগত আক্রমণের পথকেই বেছে নিয়েছেন বিরোধী নেতা-নেত্রীরা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তো শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে ‘তুই তোকারি’ সম্বোধন করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে। চা-ওয়ালা থেকে ‘চোর’ কোনোরকম ব্যঙ্গ এবং কুৎসা নেই যা বর্ষিত হয়নি প্রধানমন্ত্রীর ওপর। একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এরকম লাগাতার কুৎসা প্রচার করা হয়েছে, এটিও কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে নজিরবিহীন।
অন্যদিকে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর বিগত পাঁচ বছর এই লাগাতার কুৎসা এবং মিথ্যাচারের সামনে দাঁড়িয়ে একদিনের জন্যও তার ধৈর্যের বাঁধে ফাটল ধরেনি বা একদিনের জন্যও তিনি আত্মবিশ্বাস হারাননি। সংবাদমাধ্যম যখন লাগাতারভাবে প্রচার করে গিয়েছে, এবারের নির্বাচনে মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতার পাবে না—তখনও নিজের আত্মবিশ্বাসের পরিচয় দিয়েছেন মোদী। বলেছেন, এবার মোদী ঝড় আরও ব্যাপক আকার ধারণ করবে দেশে। একজন আত্মবিশ্বাসী এবং নিজের লক্ষ্যে অবিচল রাজনীতিক কেমন হতে পারেন তা প্রমাণ করেছেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। অবশ্য তিনি পাশে পেয়েছেন অমিত শাহের মতো একজন যোগ্য সেনাপতিকে। ২০১৪-য় নরেন্দ্র মোদীর বিপুল জয়ের পিছনেও যেমন মূল কারিগর ছিলেন অমিত শাহ, ২০১৯-এও এই ঐতিহাসিক জয়ের পিছনেও মূল কারিগর তিনিই। গত পাঁচবছর ধরে দলের সংগঠনটি বিস্তার এবং সুদৃঢ় করার দিকে সতর্ক সৃষ্টি রেখেছেন অমিত শাহ। তবুও মাঝে এমন আওয়াজও উঠেছিল, মোদী এবং শাহের ম্যাজিক শেষ। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে অমিত শাহ প্রমাণ করে দিয়েছেন— ভোটযুদ্ধে তাঁর মতো দক্ষ সভাপতি বিজেপি ইতিপূর্বে পায়নি। ভবিষ্যতে পাবে কিনা— তা নিয়েও সংশয় আছে। ফলে, যে যাই বলুক না কেন এটা নিশ্চিত যে, বিজেপিতে মোদী-শাহ যুগ আরও বেশ কয়েকবছর অক্ষুণ্ণ থাকবে।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর জাতীয় রাজনীতির অভিমুখটাই অনেকটা বদলে গিয়েছে। প্রথমেই ধরা যাক কংগ্রেসের কথা। গান্ধী পরিবারের দুই সন্তান রাহুল ও প্রিয়াঙ্কার নেতৃত্বে কংগ্রেস এবার নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই কংগ্রেস বিশেষত রাহুল গান্ধী এবার নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে যথেষ্ট আক্রমণাত্মক ছিলেন। নোটবন্দি থেকে রাফাল— সব বিষয়েই নরেন্দ্র মোদীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে চৌকিদার চোর হ্যায়’ আওয়াজ তুলতেও তার দ্বিধা হয়নি। এবং এই নির্বাচনী যুদ্ধের আগে থেকেই মোদী বিরোধিতায় তিনি পাশে পেয়েছিলেন অখিলেশ যাদব, চন্দ্রবাবু নাইডু, শারদ পাওয়ার, মায়াবতী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ওমর আবদুল্লা, লালুপ্রসাদ, সীতারাম ইয়েচুরির মতো বিরোধী নেতাদের। নির্বাচনের মুখে মুখে অবশ্য তাকে সাহায্য করতে আসরে অবতীর্ণ হন ভগ্নী প্রিয়াঙ্কা। সংবাদমাধ্যমও সর্বশক্তি নিয়ে রাহুল গান্ধীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকে জনগণের সামনে। তুলে ধরতেও সংবাদমাধ্যমের কোনো কসুর ছিল না। কিন্তু এই নির্বাচন প্রমাণ করেছে, রাহুল ও প্রিয়াঙ্কার নেতৃত্ব দেশের দেশের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের কোনো বক্তব্যই দেশের বিশ্বাস করেনি। সেই সঙ্গে দেশের মানুষ এও বুঝিয়ে দিয়েছে, নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প হিসাবে রাহুল-প্রিয়াঙ্কা তাদের পছন্দ নয়। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এনডিএ জোট যখন সাড়ে তিনশো আসনসংখ্যা ছুঁয়েছে, তখন রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস জোটের আসনসংখ্যা মাত্র পঞ্চাশের কিছু বেশি। স্বাভাবিকভাবেই এই শোচনীয় ফলাফলের পর রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। বিজেপি বিরোধী দলগুলির অনেকের ভিতরই রাহুলের নেতৃত্ব সম্পর্কে আগেই কোনো আস্থা ছিল না। এই ফলাফলের পর রাহুল গান্ধীকে বিরোধী শিবিরের নেতা হিসাবে আর কেউই মানতে চাইবে না। শুধু তাই নয়, সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসও আর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকবে না। এই ফলাফলে এটাও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, নেহরু- গান্ধী পরিবারের পরিচয় ভাঙিয়ে কংগ্রেস আর নির্বাচনে জেতার অবস্থায় নেই। সেক্ষেত্রে, এরপর কংগ্রেসের ভিতরেও যদি নেহরুগান্ধী পরিবারের নেতৃত্ব অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায়, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। স্বাধীনতার পর থেকে এমন। শোচনীয় অবস্থার সম্মুখীন কংগ্রেস ইতিপূর্বে কখনো হয়নি।
এবারের নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে এনেছে। তাহলো, আঞ্চলিক দলগুলির ব্যক্তিস্বার্থ ভিত্তিক রাজনৈতিক রমরমার অবসানের ইঙ্গিত। আশির দশকের শুরু থেকে এই দেশে আঞ্চলিক দলগুলি যেভাবে জাতীয় রাজনীতির উপর প্রভাব বিস্তার করছিল, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর মনে হচ্ছে, সেই প্রভাব একেবারেই খর্ব হবে। এবার নির্বাচনের আগে উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী ও অখিলেশের জোট বিরোধী শিবিরে অনেকটাই আশার সঞ্চার করেছিল। এবং বিরোধী নেতা-নেত্রীরা ভেবেই নিয়েছিলেন বুয়া-ভাতিজার এই জোট উত্তরপ্রদেশে বিজেপির আসন কমিয়ে দেবে এবং বিরোধী জোটের সরকার গড়ার পথ প্রশস্ত করবে। এ ব্যাপারে বিরোধী নেতা-নেত্রীরা এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে, লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরদিন তারা দিল্লিতে বৈঠকে বসার প্রস্তুতিও নিতে চেয়েছিলেন। ফল বেরতে অবশ্য দেখা গেল উত্তরপ্রদেশে বুয়া-ভাতিজা কুপোকাত হয়েছেন। এবং সেই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন-সমাজবাদী পার্টির ছড়ি ঘোরানোর আশাও ধূলিসাৎ হয়েছে। একই অবস্থা। অন্ধ্র প্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডুরও। একদা এনডিএ শরিক এই নেতাটি এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে এসে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কাজেমনপ্রাণ দিয়ে ঝাপিয়েছিলেন। বিরোধী জোট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন। প্রধান উদ্যোক্তা। ফলাফল বেরনোর পর দেখা গেল, লোকসভা তো অধরাই, রাজ্য। বিধানসভাও হাতছাড়া হয়েছে চন্দ্রবাবুর। একেই বলে ঘটি-বাটি চাটি হওয়া। বিহারের লালুপ্রসাদ ও তার পরিবারেরও এবার ভোটযুদ্ধে সর্বস্ব খুইয়ে পথে বসার জোগাড়। কর্ণাটকের দেবেগৌড়ার জেটিএস এখন অস্তিত্ব সংকটের মুখে। আর রইলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সদর্পে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, এই রাজ্যের ৪২টার ভিতর ৪২টা আসনই তার দল তৃণমূল কংগ্রেস দখলে রাখবে। নির্বাচনী যুদ্ধে তিনি নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীকে ‘এক্সপায়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ব্যঙ্গ করতেও ছাড়েননি। এমনকী, নির্বাচনের পর তিনিই হবেন বিরোধী জোটের প্রধানমন্ত্রী — এমন স্বপ্নও দেখছিলেন। ফল বেরতে দেখা গেল, ৪২ তো দূরের কথা, তার দলের আসন সংখ্যা নেমে। এসেছে ২২-এ। আর বিজেপি লাভ করেছে ১৮টি আসন। জাতীয় রাজনীতিতে কোনোরকম প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা এখন আর নেই তৃণমূল নেত্রীর। বরং, এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির পশ্চিমবঙ্গে নিজের দলের অস্তিত্ব রক্ষা করাই তার সামনে এক বড়ো পরীক্ষা। কেননা, ইতিমধ্যেই শোনা যাচ্ছে, তাঁর দল ভেঙে এক বড়ো সংখ্যক বিধায়ক বিজেপির দিকে পা বাড়াতে পারেন। তাছাড়া জেলায় জেলায় ইতিমধ্যেই দল বদলের একটি হিড়িকও উঠেছে।
আঞ্চলিক দলগুলির এই সর্বনাশ জাতীয় রাজনীতিকে অনেক স্বচ্ছ এবং সাবলীল রাখতে সক্ষম হবে। ব্যক্তি স্বার্থে পরিচালিত এই আঞ্চলিক দলগুলি মূলত ব্ল্যাকমেলিংয়ের রাজনীতি করত। সেই ব্ল্যাকমেলিংয়ের রাজনীতিটি এবার বন্ধ হবে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকারও অনেক সাবলীল ভাবে কাজ করার সুযোগ পাবে। অন্তত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কোনো আঞ্চলিক নেত্রী কেন্দ্রীয় প্রকল্প রাজ্যে কার্যকর করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারবেন না। কোনো অন্যায্য চাপের কাছে নরেন্দ্র মোদীকেও মাথা নোয়াতে হবে না।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে এক আকাশছোঁয়া সাফল্য লাভ করেছে বিজেপি। এই সাফল্যের পাশাপাশি বিজেপিকে মনে রাখতে হবে, আগামী পাঁচ বছর বিজেপিকে। সেইসব প্রতিশ্রুতি পালন করতে হবে, যে প্রতিশ্রুতি নির্বাচনের প্রচার পর্বে তারা দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে এসে অমিত শাহ বলে গিয়েছিলেন, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি মনুসলমানদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিতাড়িত করা হবে। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে বিজেপিকে। সেই সঙ্গে আরও দুটি আশু কর্তব্য— ৩৭০ ধারা বিলোপ এবং অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু এই কাজগুলির এবার করে দেখাতে হবে বিজেপিকে। তাহলেই এই বিপুল জনাদেশের মর্যাদা দিতে পারবে বিজেপি। নচেৎ নয়।
রন্তিদেব সেনগুপ্ত
2019-05-31