রামের নামে যে ভূত পালায়, সে তো কোন ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছি। এই একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে হোয়াটস অ্যাপ, টুইটার, ফেসবুকের যুগে অর্থাৎ প্রযুক্তিবিদ্যার এমন সর্বোত্তম যুগে পৌছিয়ে ভূত তাড়াতে ওঝার দরকার যে নেই, স্রেফ রাম নামই কাফি, সত্যি বলতে কী নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় না এলে বোঝার উপায় ছিল না। আচ্ছা, রাম কী বা কে? জানেন, নিজের মনে প্রশ্নটা বারবার করেছি সেই ছেলেবেলা থেকে। জন্মানো ইস্তক দেখে আসছি গুনতি থেকে শুরু করে শুভ কাজ, সবেরই সূচনা ‘রাম’ নামে। এখন ব্যবহার কমেছে। কিন্তু এককালে নামের ক্ষেত্রেও রামের ব্যবহার ছিল একামেবাদ্বিতীয়। হাতে গরমাগরম উদাহরণ রাজা রামমোহন রায় থেকে রামজয় বিদ্যালঙ্কার, মায় সীতারাম ইয়েচুরি পর্যন্ত এমনই অজস্র উদাহরণ।
রামমোহনের নাম নিতেই সাম্প্রতিক একটি বিতর্কের কথা মাথায় এল। পায়েল রোহতগি বলে এক অভিনেত্রী রামমোহনকে ব্রিটিশদের ‘চামচা’, সতীদাহ প্রথা নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করেছেন, তার টুইটারে। তার ন্যূনতম ইতিহাসবোধ নেই, ইতিহাস জানেনও না কিছু—এমন অর্বাচীনের মতো মন্তব্যে তার মূখামিই প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা অন্যত্র। সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং সংবাদমাধ্যমে পায়েলের এই বক্তব্য ভাইরাল হতেই ‘পলিটিক্স’ শুরু হয়ে গিয়েছে, চিরাচরিত ছকে। এই পলিটিক্স’-এর হিসেবে পায়েল নরেন্দ্র মোদীর ভক্ত’, ‘বিজেপি-আর এস এস অনুগামী। কেউ কেউ ‘মনুবাদী বলেও কটাক্ষ করেছে।
এসবের হিসেবনিকেশ পরে দিচ্ছি। কিন্তু পায়েলের এই মন্তব্য আসার দিনকতক আগেই, রাজা রামমোহনের জন্মদিন (২২ মে) উপলক্ষ্য করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল আধুনিক মহাপুরুষদের বাণী। যার মর্মার্থ হলো জয় শ্রীরাম না বলে বরং ‘জয় শ্রীরামমোহন’বলা হোক। কারণ রামমোহন সতীদাহ বন্ধ করে নারীজাতিকে উদ্ধার করেছিলেন, অন্যদিকে রাম সীতাকে অগ্নিপরীক্ষায় বাধ্য করে নারীজাতিকে অপমান করেছেন ইত্যাদি। সুতরাং প্ররোচনায় ইন্ধন শুরু হয়েছিল মোক্ষম। মুহূর্তে, আর পায়েল রোহতগির অনৈতিহাসিক মন্তব্যও ঠিক সেই মোক্ষম সময়ই। কেন জানি না, মোদীজী সেই ২০১৪-তে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দুয়ে দুয়ে চারের মতো পাটিগণিতের সব জটিল অঙ্ক কেমন করে যেন মিলে যায়। সে জেএনইউ -য়ে আফজল গুরুর জন্মদিন পালনই হোক, বা অতি সম্প্রতি বিদ্যাসাগর কলেজে মূর্তি ভাঙা। জয় বাঙ্গলা।
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, ‘জয় বাঙ্গলা’বাদীরা অপেক্ষার সদ্ব্যবহার করতে বিশেষ দেরি করেননি। সত্যি কথা বলতে কী, মোদী কেবল ভারতবর্ষে জিতলে তাদের বুকে এতটা শক্তিশেল বিত না, যতটা বিধেছে তাদের পৈতৃক সম্পত্তি বাঙ্গলায় রমরম করে (ওটা বোধহয় রামরামই হবে) মোদীর দল জিতে যাওয়ায়। যে বাঙ্গলার জন্য তাদের প্রাণ সর্বদা কেঁদে-ককিয়ে ওঠে, মুসলমান সমাজ যেমন আরবীয় থেকে দিব্যি বাঙালি হয়ে গিয়েছে, অনেকটা সেই বাংলাদেশীয় কায়দায়। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক হিন্দুগুলো বুঝলে হয়। এঁদের মহীয়সী নেত্রী জয়শ্রীরাম’ধ্বনি শুনে তেড়ে উঠে বলেছিলেন, ‘গালাগাল দিচ্ছিস কেন?” ভোটবাক্সে বোঝা গেল গ্রামবাঙ্গলা তার শাশ্বত চিরন্তন রূপটি আজও ধরে রাখতে পেরেছে।
রামের নাম এখনও যে কোনও শুভ কাজে সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়। তাই গৰ্জ্জু (অর্থাৎ গুজরাটি নরেন্দ্র মোদীর বিরোধিতা কেবল ব্যক্তি বিরোধিতাতেই হিসাব চোকায়নি, একটি সমগ্র জাতি-সম্প্রদায়কেও অপমান করতে শিখিয়েছে) গুটকাখোরের দলের সংস্কৃতি হিন্দু বাঙ্গালি নির্দ্বিধায় মেনে নিচ্ছে এমন দিন দেখার আগেইমরে যাওয়াই ভালো বোধহয়!
আসলে বাঙ্গলা-পক্ষ বুঝতে পারেনি রামের নাম বাঙ্গলার সনাতন পরম্পরাই অঙ্গ। আরবি সংস্কৃতিকে চাপানোর চেষ্টা বাঙ্গালি ভালো চোখে নেবে না। আজ রাজা রামমোহন রায় যদি দেখতেন তার নাম করে বাঙ্গলাকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার মতলব হচ্ছে তবে তিনিই সবচেয়ে বেশি দুঃখ পেতেন। অবশ্য বাঙ্গালির গত সাতের দশক থেকে যে হাল আমরা দেখেছি, মনীষীরা দেখলে তাঁদের হৃদয় বিদীর্ণ হতো। আজ ঠেলায় পড়ে যারা বিদ্যাসাগর, রামমোহন প্রেমী হয়েছে তাদের সাংস্কৃতিক পূর্বজরাই সাতের দশকে বিদ্যাসাগরেরমূর্তি ভেঙেছিল, রামমোহনকে ‘বুর্জোয়া’, ‘ব্রিটিশের দালাল’ বলেছিল।
প্রশ্নটা শুরু হয়েছিল রাম কী বা কে দিয়ে। রামায়ণকে যাঁরা অস্বীকার করেছে, ইতিহাস বলে মানতে চায়নি সেই ভারত-বিদ্বেষী বামপন্থী ঐতিহাসিকদের আমরা সবাই চিনি। এরাই জনজীবনে রামের অবিসংবাদিত প্রভাব দেখে কখনো রাম-রাবণের যুদ্ধে আর্য অনার্য থিয়োরি এনেছে, কখনও রামকে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিভূ, কখনও বা তাকে শূদ্র শম্বুক হত্যার দায়ে জনজাতি বিরোধী বলেও মন্তব্য করেছে। রামায়ণের ঐতিহাসিকতাতেও রামকে ঠাহর করা। অসম্ভব। ভারতবর্ষের জনজীবনেও তার প্রভাব অপরিসীম।
ভারত আর বাঙ্গলাকে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আটকে রেখেছে, বাঙ্গলাকে আরবীয় সংস্কৃতিতে লীন হয়ে যেতে দেয়নি। সুতরাং বিপদে পড়লেই রামের নাম নিন, ভূত পালাবেই। সে পুরুষোত্তম রামচন্দ্রই হোন, কিংবা রাজা রামমোহন।
বিশ্বামিত্রের কলম
2019-05-31