পর্ব ২
কাষ্ঠদহি ভিন্ন হুগলী জেলার গরলগাছা গ্রামে ভাবতারণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাটীর বিল্ববৃক্ষে “মহাপ্রভু” নামক ব্রহ্মদৈত্য দীর্ঘকাল বসবাস করছেন। জনশ্রুতি আছে রাতবিরেতে গৃহে কোনো অতিথি এসে দরজায় কড়া নেড়ে সময়মতো সাড়া না পেলে সেই মহাপ্রভু স্বয়ং দরজার খিল খুলে দেন। প্রতি সন্ধ্যায় সেই বেলগাছের গোড়ায় দুধ ঢেলে ধূপ দীপ জ্বেলে পূজা অনুষ্ঠান করা হয়। বিরলদর্শন সেই ব্রহ্মদৈত্যের রূপ – দন্ডধারী মুন্ডিত মস্তক খড়ম পরিহিত যঞ্জোবীতধারী ব্রাহ্মণকুমার। ললাট তিলক চর্চিত। গঙ্গামাটির তিলক। কাটোয়ার মা গঙ্গার তীরে মধু নাপিতের নিকট মস্তকমুন্ডন ও মাধবেন্দ্র পুরীর নিকট দীক্ষা নেবার পর শ্রী চৈতন্যদেব যে রূপে নবদ্বীপ প্রত্যাবর্তন করেন , অনেকটা সেই অপরূপ রূপের সঙ্গে তুলনীয়। তাই বিল্ববৃক্ষের অধিষ্ঠানকারী সেই ব্রাহ্মণ আত্মার নাম মহাপ্রভু।
এছাড়া হুগলীর দুধকুমার গ্রামে বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় গৃহসংলগ্ন বিল্ববিটপেও এমন এক ব্রাহ্মণ মহাপ্রভু র বাস ছিল বলে জানা। সেই ব্রহ্মরাক্ষসের ভয়ে অবস্থাসম্পন্ন মুখোপাধ্যায় বাড়িতে কোনোদিন ডাকাতি হয় নি বলে শোনা যায়। আবার চন্দ্রহাটী গ্রামে নির্জন নিম্ববৃক্ষতলে বাদ্যভান্ড বাজিয়ে ইটেল চণ্ডীর পূজা হতো। ফলে, ওই বৃক্ষে বসবাসকারী ব্রাহ্মণ আত্মার ভারী গোল হতো। তাই তাঁর অনুরোধে ইটেল চণ্ডী সেই স্থান পরিত্যাগ করে অন্যত্র যান। এইভাবেই লোকবিশ্বাসকে আশ্রয় করে মহাপ্রভুগণ মর্ত্যধামে সম্ভৎসর বিদ্যমান থাকেন।
কাষ্ঠদহি গ্রামে মহাপ্রভুর নিত্যপূজা হয় চাল, বাতাসা , ফলমূলাদি সহযোগে ঠিক দুপুর ১২টায়। শীতল পূজা নেই। সূর্যাস্তের পর সেই মহাপ্রভুর থানে কেউ যান না। লোকচলাচল যদিও হয় তা হতে গোনা। তাছাড়া লোকবিশ্বাস যে মহাপ্রভুর ত্রিশূল পোঁতা থানে অশুচি অবস্থায় প্রবেশ করলে বা মহাপ্রভুর থানে আবর্জনা নিক্ষেপ করলে ,মলমূত্র পরিত্যাগ করলে তার ক্ষতি হয়। রাতবিরেতে এই প্রেতভূমিতে যায় কারসাধ্য। যাত্রীসমাগম যা হয় সব দিনেরবেলা। মাঘ ফাল্গুন মাসে কাষ্ঠদহিতে শীতলা পূজা দিতে এসে ভক্তরা মহাপ্রভুর থানেও পূজা দিয়ে যান। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে সংলগ্ন বাঁশতলায় বসে ফলাহার করেন। পুরোহিত বা সেবক কাশ্যপ গোত্রধারী চক্রবর্তীরা। তাঁরা নানা দৈব ওষুধ , মাদুলি ইত্যাদি দেন। রোগ নিরাময় হলে মহাপ্রভুর থানে পূজা দিতে হয়। এখন পূজাস্থলে একটি তুলসী গাছ রোপণ করা হয়েছে।
আসলে জানেন তো –
ততোহখিলং লোকমাত্মদেহ সমুদ্ভবৈঃ
ভবিষ্যামি সুরাঃ শাকৈরা বৃষ্টৈ প্রাণ ধারকৈ।
শাকম্ভরী বিখ্যাতং তদা যাস্যমহং ভূষি।।
ভারতবর্ষে বৃক্ষলতা উর্বরতা বর্ধনে সহায়ক এবং তা কেবল শস্যাদি , খাদ্য প্রদানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না। অক্সিজেন, ওষধি , জ্বালানী , বাসগৃহ, বস্ত্র, বিদ্যা লাভের জন্য উপযোগী বস্তু সমূহ, সকল কিছু একটি বৃক্ষ প্রদান করতে পারে। তাই ধনজনসন্তান কামনা, রোগশোকপাপ দূরীকরণ ইত্যাদি পার্থিব ও পার্থিব আকাঙ্খা পূরণের জন্যও বটে। তাই নিরাকার পরম ব্রহ্ম রূপে বৃক্ষকে সেই প্রাচীন কাল হতে পূজা করে আসছে সনাতনী মানব। তাই দারুব্রহ্ম রূপে জগন্নাথ পুরীতে অবস্থান করেন । তাই ব্রহ্ম স্বরূপ নিরাকার প্রকৃতি মহামায়া মা দুর্গা বোধন হয় নবপত্রিকায়। ওই নবপত্রিকা এবং ঘটই পূজা মুখ্য বিষয়। আজও তাই বহু স্থানে নবপত্রিকার সম্মুখে ঘটেপটে পূজা হয়। নবপত্রিকার নয়টি বৃক্ষ হল কদলী, কচ্চি, হরিদ্রা , জয়ন্তী, শ্রীফল, দাড়িম্ব, অশোক, মান্য ও ধান্য। পূজা মন্ত্রগুলোতে দেখা যায় একটি বৃক্ষ বা পত্রিকাকে দেবতা বা তাঁর প্রতীক বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাঁদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য অনুসারে যথোচিত প্রার্থনা জানানো হয়েছে।
ঠিক একই ভাবে লক্ষ্মী পূজায়ও মহাদেবীকে শ্ৰী হিসাবে এবং ভূমাতা হিসাবে, ধনদায়ীনি হিসাবে পূজার সময় ধান, আখ, সরিষা, নানা প্রকার শাক , কলার ভেলা ইত্যাদি পূজার উপকরণ হিসাবে প্রদান করা হয়। সনাতনী সমাজে মহাবিষ্ণু সংক্রান্তিতে #ফলদান_সংক্রান্তি ব্রত পালন করা হয়। উক্ত দিনে সবস্ত্র , সপাত্র নারিকেল ফল বিষ্ণুকে দান করলে নিখিল পাতক দূর হয়। পুরোহিত দর্পন, ক্রিয়াকান্ড বারিধি ইত্যাদি নানা গ্রন্থে সে কথা উল্লেখ আছে। এই রূপে একেকটি মাসের সংক্রান্তির দিন বিশেষ বিশেষ ফল দান করলে মোক্ষলাভ হয়। সুতরাং, জনধনউৎপাদন , পাপ দূরীকরণ , মোক্ষ প্রাপ্তি প্রভৃতি জাতীয় কামনা বাসনা বৃক্ষ উপাসনার নেপথ্যলোকে বিরাজিত থাকে। এই সকল কারনে বৃক্ষরোপণ সনাতনী প্রথায় একটি পবিত্র কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়।
মৎস্য পুরাণে বলা হয় ” একটি বৃক্ষ দশজন সন্তানের সমান। ” বরাহ পুরাণে বলা হয়েছে , ” একজন সুসন্তান যেমন তাঁর পরিবারকে রক্ষা করে তেমনই পুষ্প ও ফলশোভিত একটি বৃক্ষ তাঁর পিতা সমান রোপনকারীকে নরকগামীতা হতে রক্ষা করে এবং যে ব্যক্তি পাঁচটি আম্রবৃক্ষ রোপন করেন তিনি নরকে যান না।” অর্থাৎ , বৃক্ষ রোপণের পুণ্যফল নরকগমনহতে রোধ করতে পারে।
বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণের মন্তব্য এইরূপ ” একটি সন্তান যা সম্পাদন করে , কোন ব্যক্তি দ্বারা পরিচর্যাকৃত একটি বৃক্ষও সেইরূপ করে, কেন না এটি তার ফুল দ্বারা দেবতাকে , ছায়া দ্বারা পথচারীকে এবং ফলের দ্বারা ক্ষুধার্তকে তুষ্টি দান করে। ফলে, বৃক্ষ রোপণকারীর নরকগমন হয় না।” সন্তানের চাইতেও বৃক্ষরোপন কর্মটিকে অধিক গুরুত্ব সনাতনী শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে।
বৃক্ষই সব , তাই তাঁকেই পূজা কর, সেই কারণেই মহাকালী মহামায়া মহালক্ষ্মী মহাবিদ্যা দেবী দুর্গা শাকম্ভরী রূপেও পূজিতা। সুপ্রাচীন গ্রন্থাবলী সমূহ যথা – বেদ, রামায়ণ, মহাভারত , গীতা, নানা পুরাণাদি হতে কালিদাসের রচনাবলী , বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাবলী , সকল স্থানে বৃক্ষের প্রশস্তি হতে এই উপলোব্ধি করা যায় যে, ভারতে বৃক্ষোপসনা অতি প্রাচীন আচার ছিল। এই আচার কোনো কালেই লুপ্ত হয়ে নি। পদ্মপুরাণ এবং মৎস্য পুরাণে #বৃক্ষোৎসব বিধি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিবৃত হয়েছে।
বটের ফলে আরতি তার ,
রয়েছে লোভ নিমের তরে,
বনজামেরে চঞ্চু তার
অচেনা ব”লে দোষী না করে ।
শরতে যবে শিশির বায়ে
উচ্ছ্বসিত শিউলিবীথি,
বাণীরে তার করে না ম্লান
কুহেলিঘন পুরানো স্মৃতি ।
শালের ফুল-ফোটার বেলা
মধুকাঙালী লোভীর মেলা,
চিরমধুর বঁধুর মতো
সে ফুল তার হৃদয় হরে ।
সিন্ধু সভ্যতা অঙ্কিত নানা মূর্তি এবং পরবর্তী পর্যায়ে নানা ভাস্কর্যাদিতে বৃক্ষোপসনার প্রমাণ প্রাপ্ত হয়। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী র ভারত স্তূপে বোধি বৃক্ষ, কদলী, ন্যাদ্রোধ , উদুম্বর, শিরীষ, শাল , আম্র, তাল, অশোক , পাটলি , নাগকেশর ,পিপল প্রভৃতি বৃক্ষের পূজার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। আবার খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের সাঁচী ও অমরাবতী এবং খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের নাগার্জুন কোন্ডার ভাস্কর্যে পিপল ও বোধিবৃক্ষ পূজার দৃশ্য আছে। এছাড়াও খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মথুরা , খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের গুপ্তযুগের দেওঘর, খ্রিস্টীয় সপ্তম হতে নবম শতকের ইলোরা এবং অন্যান্য স্থানের ভাস্কর্যে বৃক্ষের নিম্নে দেবী মূর্তি, ভগবান মহাদেব ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। ভাস্কর্যগুলি প্রমাণ করে বৃক্ষকে পূজা বহু অতীত কাল হতে সুবিশাল ভারতে প্রচলিত হয়ে আসছে।
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি ।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া ॥
তিনি সর্বভূতে , সর্ব জীবে বিরাজমান। তাই বৃক্ষের মাঝে কোনো আত্মা আছে এই ভেবে যদি কেউ বৃক্ষ উপাসনা করেন তবে সে তো পরমব্রহ্ম ও শক্তির উপাসনা। সেই কারণে না জানি এই অত্যাধুনিক যুগে কত বৃক্ষ জীবিত থেকে যায় আর নিঃশব্দে দিয়ে যায় সঞ্জীবনী স্বরূপ অরণ্য সংরক্ষণের বার্তা। এখানেই তো জয় হয় সনাতনের । বেদ ,পুরাণ, উপনিষদ ,লৌকিকতা ,ভাষা, বর্ণ, সব মিলে এক হয়ে এক অখন্ড সনাতনী ভারতবর্ষ গঠিত হয়।
সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. হুগলী জেলার লৌকিক দেবদেবী
২. ঋগ্বেদ