বাঘ মনুরোথ বা কপিলামঙ্গল: গোপূজন বেদ হতে লৌকিক সুপ্রাচীন সংস্কার – পর্ব ৮

পর্ব ৮

সংসারেতে হয় ভাই গরু বড় ধন।

যার ঘরে গরু নাঞি তার বিফল জীবন।।

গোধন সেবার ধর্ম কে কহিতে পারি।

আপনে সফল করি মানিলা শ্রীহরি।।

গোপকুলে জনমিয়া গোধন সেবিলা।

গোবিন্দ আপনে যার সঙ্গে করি লীলা।।

জড়ানো পটটি খুলতে খুলতে গান ধরেন পটুয়া মানুষটি।ছবি , গানের অনুষঙ্গে একটি বিশেষ আবহ রচিত হয়। গোরুর পটের ছবিগুলিও কোনো ধ্রুপদী আঙ্গিকের ছবি নয়। একেবারে লোকায়ত ভাবনায় তার চিত্ররূপ নির্মিত। এমনকী প্রত্যেকে পটুয়া চিত্রকরের ছবিও পৃথক। গানের কথাও বহু ক্ষেত্রেই অদল বদলও হয়ে যায়। তবে মূল কাহিনীটি সব ক্ষেত্রেই এক থাকে। তাতে ,শ্রোতা দর্শকের অসুবিধা হয় না ।

শ্রোতা , দর্শক গান শুনে , পট দেখে খুশি হয়ে পটুয়াকে #সিধে দেন। সিধে হল একজনের খাবার মতো সব কিছু। তাতে চাল , ডাল , আলু, সবজি, তেল ,নুন ইত্যাদি থাকে, আর থাকে টাকা পয়সা। যার যেমন ক্ষমতা সে তেমন দেয়।  আগে ষোলো আনা বা পাঁচ সিকে পয়সা দেওয়া হতো। যেসব চাষী, খেত মজুররা আরো দরিদ্র হতেন তাঁরা এক সিকিও দিতেন। পাটুয়ারা তাতেই খুশি হয়ে দুহাত ভরে আশীর্বাদ করতেন গৃহস্থকে।

অতি প্রাচীন কাল থেকেই আমরা পটের উল্লেখ পেয়ে যাই নানা ভাবে। পটশিল্প ভারত তথা বিশ্ব ইতিহাসের এক অন্যতম প্রাচীন অধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য তথা জেলার পট ও পট দেখানোর গানের মধ্যে পুরুলিয়া, বীরভূম, মেদিনীপুর জেলা বিশেষত্বের অধিকারী । আড়াই হাজার বছর আগে থেকে ভারতবর্ষের নানা জায়গায় জড়ানো পট, চৌক পট জনসাধারনের, শিক্ষা , চিত্তবিনোদন ও হিন্দু ধর্ম, মহাকাব্য, পুরান, লৌকিক প্রথাকে উজ্জ্বল করে তোলার উদ্দেশ্যে ব্যাপকহারে ব্যবহার করা হয়েছে ।হিন্দু ধর্ম ও তার থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন কাল্টকে প্রচার এবং লোক শিক্ষার এই বাহনটির আবির্ভাব সমাজের তাগিদেই ঘটে। ভারতে প্রায় সব এলাকাতেই পটুয়ার অস্তিত্ব ছিল।

 এরপর খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের #অষ্টাধ্যায়ী, খ্রিস্টাব্দ সপ্তম শতকে #হর্ষচরিত ,অষ্টম শতকে #উত্তররামচরিত, #মুদ্রারাক্ষস ইত্যাদি গ্রন্থে পটুয়া, পট, পটগীতির উল্লেখ পাই। কালিদাস ও ভবভূতির নাটকের আঁকা পট এবং পট দেখানোর উল্লেখ আছে। পটের বাস্তব উল্লেখ আছে বিশাখ দত্তের মুদ্রারাক্ষসে….এখানে পটুয়াদের যম পট্টিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মুদ্রারাক্ষসের রচনা কাল নিয়ে মতান্তর থাকলেও খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে যম পট্টিক বলে বিশেষ এক শ্রেণীর পটুয়ারা ছিল সেটি সর্বৈব সত্য। বাণভট্ট তাঁর হর্ষচরিত গ্রন্থে যম পট্টিকদের পট প্রদর্শন নিয়ে একটি সুন্দর দৃশ্য অবতারণা করেছেন।

ব্রহ্মবৈর্ত পুরান অনুসারে জানা যায় বিশ্বকর্মা ও ঘৃতাচীর নয় জন পুত্র ছিলেন । তাঁরা হলেন মালাকার ,কর্মকার, শঙ্খকার, তন্তুবায় বা কুন্দিবক,  কুম্ভকার ,কাংস্যকার ,চিত্রকর অর্থাৎ পটুয়া এবং স্বর্ণকার ।এদিক থেকে বিবেচনা করলে সমাজের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো  পটুয়ারা অত্যন্ত সম্মানিত এক সম্প্রদায়।

পটিদারদের ভিতর হতে কুম্ভকার জাতির উদ্ভব।বঙ্গে অনেক পটিদার যেমন কুম্ভকারের কাজ করেন তেমনি বহু কুম্ভকার করেন পটিদারের কাজ। পট যারা করেন তাঁরাই তাই পটিদার। জাতিতত্বের বিচারে পটিদারদের সঙ্গে কুম্ভকার জাতি সংশ্লিষ্ট , মধ্যে সন্ধিরূপে গোপকন্যার অবস্থান।

ভার্গবরাম বলেছেন :

পট্টিকোৎ গোপকন্যায়ং কুলালো জায়তে ততঃ

মতান্তরে , পট্টকারচ্চ তৈলক্যাং কুম্ভকারো বভুব হ।

গুজরাট অঞ্চলেও একরকম পট আছে ,তাকে বলে চিত্রকথী।এঁরাও কিন্তু ঘুরে ঘুরে গান করে পট দেখিয়ে জীবন সংগ্রাম অতবাহিত করেন। কি অদ্ভুত? এক দেশ, নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান কিন্তু শিল্প , পেশায় ,মননে কেমন সব বিবিধের মাঝে মিলন মহান হয়ে উঠেছে….

এই পটুয়া সম্প্রদায় লোকশিক্ষার বিরাট এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রচারের অনুকূলে কাজ করতেন। প্রচারের সরস মাধ্যম ছিলেন। পরে বৌদ্ধ কাল্ট উদ্ভব ও বৃদ্ধি পেলে একটা সময় মানুষ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন। তারমধ্যে পটুয়ারাও ছিলেন। ওই সময় তাঁরা বৌদ্ধ কাল্ট নিয়র বেশ প্রচারও করেছিলেন।

বঙ্গ তথা ভারতের সুপ্রাচীন জনজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যেও পট আঁকা ও পট প্রদর্শন রীতি ছিল ও আছে। সুপ্রাচীন জনজাতি স সমাজে পটুয়ারা পটকিরি নামে পরিচিত। কবি চন্ডী তে সব থেকে বেশি পটের উল্লেখ আছে।

গো পটগান বা  গোমঙ্গল গান যাঁরা করেন তাঁরা অনেকেই গো চিকিৎসকও হন। চিকিৎসক মানে নামকরা কোনো ভেটারনিটি হসপিটাল থেকে পাশ করা পশু চিকিৎসক নয়, লোকায়ত ,ভেষজ প্রথায় চিকিৎসা। গরুর গায়ে হলুদ মাখানো, সাঁঝের ধোঁয়া দেওয়া এসবই সেসব প্রাচীন প্রথার অংশ বিশেষ। পটেরগান গেয়ে তো আর পেট চলে না। তাই, কেউ কেউ সাপ ধরেন, সাপের খেলা দেখান , সাপের বিষের চিকিৎসা করেন, জড়ি-বুটি- মাদুলি-দৈব ঔষধ দেন সর্প ভীতি নাশ করার জন্য। কেউ কেউ ভানুমতীর খেল ,তথা হাত সাফাই মূলক ভোজবাজি ভেল্কি দেখান। তবে বতর্মানে খুব কমজনই এসব করেন। 

আমি পূর্বেই বেশ কিছু পটুয়া এবং পট গায়েনদের নাম করেছি। বীরভূম , বর্ধমান , বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি অঞ্চলে বহু পটুয়া ছিল একসময়। বীরভূমের ষাটপলসা, ইটাগড়িয়া, সরধা , পাকুরহাঁস, শিবগ্রাম, পানুড়িয়া, আয়াস, চাঁদপাড়া, বিষ্ণুপুর, কানাচি, তারাচি, মোদিয়ান, তালোঞা, কুসুম যাত্রা, ভ্রমরকোল ইত্যাদি গ্রামে এবং সিউড়ি, রামপুরহাট, বোলপুর , মুর্শিদাবাদের দক্ষিণখণ্ড , ভরতপুর, গনকর, কাঁতুর, কান্দি, বড়োঞা , বর্ধমানের কাটোয়া ,বর্ধমান সংলগ্ন অঞ্চল, বাঁকুড়ার বেলিয়তোড়া এলাকায় এখনো বহু পাটুয়ারা বাস করেন। তবে কেউই আর গোপট দেখান না বা গোমঙ্গল গানও করেন না। সাপ ধরা, জড়িবুটি দেওয়া এসবেও তাঁদের আগ্রহ নেই। দিনমজুর খাটা, মুনিশখাটা , শহরে এসে রঙের মিস্ত্রি বা রাজমিস্ত্রির কাজ করাতেই আগ্রহ অধিক। এখন তো অনেকেই মানভূমের উচ্চারণে কথাও বলে না। আহা, সে উচ্চারণে কি যে মধু, কি প্রাণ তা তাঁরা হয়তো শহুরে হবার চাপে আর বুঝবেন না …।

কৃষি কেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় গোরু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জীব। তার ঘাড়েই তো সংসারের খাদ্য জোগানোর জন্য জমি চাষের জোয়াল। এখন ট্রাক্টর আছে, মুড়ি ভাজার মেশিন আছে, ধান গন ঝাড়াই মাড়াই করার যন্ত্রও আছে, কিন্তু গাভী বা গো সম্প্রদায়ের গুরুত্ব একেবারেই শেষ হয় নি। ভেজাল প্যাকেটের দুধে বা রান্নার ঘিটা এখনো একটু হলেও গো দুগ্ধ ব্যবহার করা হয়। এখন অনেকই রাসায়নিক সার ত্যাগ করে জৈব পদ্ধতিতে চাষের দিকে মনোনিবেশ করছেন। সেই পদ্ধতিতে চাষের অন্যতম মূল উপাদান গোবর। নানা প্রাকৃতিক উপাদানে পরিপূর্ণ গোবর গ্যাস বা জ্বালানীর জন্য ঘুঁটের কদর খুব অল্প মানুষই বুঝবেন। 

 দুগ্ধ উৎপাদনের মূল উৎস হল গাভী। সব মিলিয়ে গোরু ব্যতীত সেই সুপ্রাচীন কাল হতে মানুষের গতি ছিল না। গো মঙ্গল পটে পাটুয়ারা তাই গাঁ গঞ্জে মানুষের অবশ্যম্ভাবী বন্ধু গো সম্প্রদায়কে যত্নে রাখার কথা কপিলামঙ্গলের গান গেয়ে বলতে থাকেন। তাঁরা নিজেদের অজান্তেই হয়ে ওঠেন লোকশিক্ষক, সমাজ শিক্ষক এবং সনাতন ধর্ম ও ঐতিহ্যের রক্ষক। 

কপিলামঙ্গল পুঁথি শুনে যেই জন।

তাঁর ঘর ভগবতী না ছাড়ে কখন।।

ব্যাঘ্রের সমান শত্রু পরাভব হব।

অচলা যে লক্ষ্মী দেবী তার ঘরে রব।।

নির্ধনার ধন প্রাপ্তি অপুত্যার সন্তান।

যদি একভাবে শুনে এ সব কথন।।

সুবলে অনন্ত ফল নাহ অগণন।

গোধনের সেবা ভাই করে যেই জন।।

সর্ব্ব পাপে মুক্ত হয় সেই মহাজন।।

কপিলামঙ্গল বা গো মঙ্গল পট দেখিয়ে গান শেষে পটুয়ারা দেখান যমপট। এটি প্রাচীন নিয়ম। জীবন, পাপ ,পুণ্য ,অনিত্যতাকে প্রকাশ করাই এর উদ্দেশ্য ছিল। তাই নাম হল যমপট্টিক। গো রক্ষা , গো পালন না করলে বা গো হত্যা করলে কি হবে সেই কথাই যম পট দেখিয়ে গান গেয়ে বলতে থাকেন। বর্ণিত হয় নরক শাস্তির কথা।ইহলোকের করা পাপের শাস্তি পেতে হবে পরলোকেও এবং সেই শাস্তি কেমন , সে সব ছবি এঁকে গান শুনিয়ে বলেন পটুয়ারা। তাই পটুয়া সম্প্রদায় অবশ্যই সমাজের #বিবেক স্বরূপ। ন্যায় অন্যায়ের দ্বন্দ্বে অবশ্য অন্যায়কে চিরদিনই তাঁরা পরাজিতের দলে রেখেছেন। যা ন্যায় , যা সত্য তার জয় ঘোষণা করেছেন দৃপ্ত কন্ঠে। রামায়ণের কৃত্তিবাস কবি দশানন রাবণকে পাপের পরিণামে নরক দর্শন করিয়েছিলেন – 

অন্ধকারে চৌরাশিটা নরকের কুণ্ড

তা হাতে ডুবায়ে ধরে পাতকীর মুণ্ড।।

বিবস্বানের পুত্র যমের ভাবনা প্রাচীন। তবে যিনি সৃষ্টি তিনিই লয়। তিনি ব্রহ্ম ও ব্রহ্মময়ী। তাই মহাকাল শিব লয়ের মাধ্যমে, নারায়ণ ধর্ম দণ্ডের মাধ্যমে পাপের বিনাশ করছেন। যিনি ব্রহ্ম তিনিই ধর্ম তিনিই যম। গান গেয়ে সেসব কথা সোজা করে বলেন পটুয়ারা ।

রবির পুত্র যমরাজ যমন নাম ধরে।

বিনা অপরাধে কারু দণ্ড নাহি করে।।

জীব, জড় সকলের মধ্যেই তো ব্রহ্ম আর আদ্যাশক্তি অবস্থান করেন। তাই সকলের মঙ্গলের নিমিত্ত , পরমা প্রকৃতিকে সুন্দর রাখার নিমিত্ত , মানুষের মধ্যে সকলকে সেবার ভালোবাসার বোধ জাগিয়ে তোলার নিমিত্ত এই পটুয়াদের গান। বেদ ,উপনিষদ, পুরানের খুব শক্ত কথাগুলি পটুয়ারা সহজ বাঙ্গালা ভাষায় ,লোক উচ্চারণে সাধারণ মানুষের কাছে সেই কোন কাল হতে গান গেয়ে গেয়ে বলে আসছেন। জীব সেবাই পরম ধর্ম। জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। লোকায়ত দরিদ্র মাধুকরী মানুষের কন্ঠে এসব যখন গীত হয় তখন তার মর্ম শহুরে সেকুলার বাবুলোগ না বুঝলেও গাঁ ঘরের মানুষ বোঝে। 

সমং সর্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্তং পরমেশ্বরম্ ,

বিনশ্বৎস্ববিনশ্যন্তং যঃ পশ্যতি স পশ্যতি !! 

সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্ ,

ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্ !! 

#অর্থঃ- অবিনাশী ঈশ্বরকে যে সাধক বিনাশশীল সর্বভূতে (জীব জগত সর্বত্র) সমভাবে দেখেন তিনিই যথার্থ দর্শন করেন; সর্বত্র সমভাবে সেই ঈশ্বর অবস্থিত দেখে সেই সমদর্শী আর কাউকে হিংসা করতে পারেন না।সেইজন্য তিনি পরম গতি প্রাপ্ত হন।

এসব পটুয়া , গায়েনরা একসময় মহামতি চাণক্যের গুপ্তচর ছিলেন। পুজোর আগে আগমনী হিসাবে পটুয়ারা গেরস্থ বাড়ি ঘুরে ঘুরে পটুয়ারা নানা পট দেখাতেন। মাদুর্গা আসছেন, সুর করে দেবীর শঙ্খ পরা, শিবের চাষ করা, মাছ ধরা , বেতের ঝুড়ি বোনা, শিব বাগদিনীর সংবাদ ইত্যাদি গাইতেন আর পটগুলি পাট পাট করে খুলতেন। মায়ের খবর অসৎ পটশিল্পীর গানে গানে। তবে, এখন পিতৃপুরুষের পেশায় আর করো পেট ভরে না ।

সুবিশাল ভারত তথা বঙ্গের লোকসমাজে দেবদেবীগণ হয়ে উঠেছেন আপনার জন, মাটির খেটে খাওয়া ব্যক্তি। পটগানগুলি , মঙ্গলকাব্যগুলি কৃষি, শিকার, শিল্প সংস্কৃতিকে নিয়ে কেন্দ্র করে লিখিত হয়েছে। শিব দেবতা কিন্তু মানব কল্যাণে তিনি কৃষক, দেবী আদিশক্তি ভগবতী কৃষক ঘরণী স্বামীর কৃষি কাজে সাহায্য করছেন , মাঠে খাবার নিয়ে যাচ্ছেন।  তাঁদের দেবত্ব থেকে তাঁদের রক্ত মাংসের মনুষ্যত্ব অনেক বেশি। দরিদ্র পীড়িত মানুষের লড়াইয়ের প্রতিনিধি তাঁরা। তাই সত্য বচন যে , গো ধন সহায় হলে , সুস্থ সুন্দর থাকলে গৃহস্থের চাষ হবে, দুধ পাবে, পুষ্টি হবে , সবে মিলে পরিবারটি থাকবে দুধে ভাতে। 

বৃত্তি নির্ভর ছবি ও গানের উপস্থাপক পটুয়া সম্প্রদায় এবং তাঁদের লোকায়ত শিল্পকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। তাঁরা বিশ্বকর্মার পুত্র থেকে গুপ্তচর হয়ে সমাজের বিবেক , সনাতনী লোকসমাজের শরিক স্বরূপ। সুপ্রাচীন কাল থেকেই এমন ভ্রাম্যমাণ চিত্রকর ও গাইয়ে বৃত্তি ভারতীয় সমাজে ছিল। দেবমূর্তি, পট ইত্যাদি দেখিয়ে দেব মাহাত্ম্য শুনিয়ে চিত্রকরগণ মাধুকরী জীবিকা নির্বাহ আগেও করেছেন, এখনো করছেন।ফলে, লোকায়ত ধারাকে তাঁরা অনেকক্ষেত্রেই ধরে রেখেছেন। দুর্ভিক্ষে, যুদ্ধে, মন্বন্তরে তাঁরা গান গেয়ে গেছেন ,দেবতার কথা শুনিয়েছেন দেবতার পট দেখিয়ে, মানুষকে দেখিয়েছেন বাঁচার জন্য নতুন আলো।

শ্রুতি নির্ভর গাঁথা গীতিকা বংশ পরম্পরায় চলে আসে। এর সঙ্গে মিশে থাকে মানুষের জীবন, বিশ্বাস , লড়াই , ফসল, পশুপালনের কথা , নিয়মের কথা, সামাজিক আচাররীতির কথা। মিশে থাকে সর্বপ্রাণবাদ।

ভাদ্রমাসে যেজন গোয়ালে মাটি দেয়,

বছর বছর পাল তার মাটি হয়ে যায়।

পান খেয়ে যে জন গোহালেতে যায়

রক্ত পিনাস হয়ে ঘরে বাছুর মারা যায়।।

একইভাবে কার্তিক মাসে উত্তরবঙ্গের গাঁ ঘরে হয় গরুচুমা উৎসব । দুগ্ধ এবং বল প্রদানকারীনী গরুকে মাতা রূপে পূজা এক অতি সুপ্রাচীন প্রথা । গরুচুমা অনুষ্ঠানের দিন সাত সকালে বাড়ি ঘর দুয়ার পরিষ্কার করে কাঁচা হলুদ ও দুর্বা ঢেঁকিতে কুটে সর্ষের তেল দিয়ে কলার ঢনায় মাখে। তারপর বাড়ির মেয়েরা সব্বাই দল বেঁধে গোয়াল ঘরে গিয়ে গরুর কপালে তা মাখিয়ে দেয়। তার সঙ্গে সিঁদুরও মাখায় । এরই নাম গরুচুমা। গরুর গলায় সেদিন শোলার ফুল বেঁধে দেওয়া হয়। আর কলার পাতা ও কলার #ঢাভি  দিয়ে তৈরি #চটপুটিয়া গোয়ালঘরে রেখে দেওয়া হয়। 

মহারাষ্ট্রে দীপাবলির দিন কয়েক আগেই পালিত হয় ‘গোবৎস দ্বাদর্শী’। একে বলে ‘বাসু বরস’ উৎসব। এ ক্ষেত্রে ‘গো’ অর্থাৎ ‘গাভী’ এবং ‘বৎস’ অর্থাৎ ‘বাছুর’। মরাঠি ভাষায় ‘দ্বাদর্শী’ বা ‘বরস’ মানে চন্দ্রমাসের দ্বাদশ দিন। এই ‘বাসু বরস’ দিনে মরাঠি সম্প্রদায়ের মানুষজন গরু-বাছুরের পুজো করে। পুরাকালে রাজা ভিনা ছিলেন একজন খুবই অত্যাচারী শাসক। তাঁর অসৎ রাজ্যশাসনে ও প্রজাদের ওপর অত্যাচারে পৃথিবী ক্রমশ নিষ্ফলা হয়ে পড়েছিল। রাজা ভিনার পুত্র পৃথু এই পৃথিবীকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করতেন। পৃথিবী তখন গাভীর রূপ ধারণ করে অনর্গল দুগ্ধদানে রাজ্যকে আবার সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা করে তোলেন। সমগ্র মহারাষ্ট্রবাসী তাই কৃষ্ণপক্ষের দ্বাদশীর দিনটিতে গো-মাতার পুজো করে ।

হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে।
গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে ।। 
ওঁ ব্রহ্মণ্য দেবায় গো ব্রহ্মণ্য হিতায় চ।
জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় বাসুদেবায় নমো নমঃ ।।

স্বভাবগতভাবেই সব লোক সাধারণত ধর্ম প্রবণ হয়ে থাকে। পল্লী সমাজের বুকে আজও অতীত স্মৃতি সত্তা লুকিয়ে আছে অনুসন্ধান, প্রকাশের অপেক্ষায় ।  যার যথাযথ অনুসন্ধান ও প্রকাশের ফলে যা ইতিহাসের নতুন অধ্যায় উন্মোচন করে দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে শ্রী রাধাগোবিন্দ বসাক মহাশয় এর মন্তব্য , তিনি বলেন যে  , ” যে পর্যন্ত না কেউ  এই দেশের লৌকিক দেবতা বিষয়ে লিখেছেন সে পর্যন্ত বঙ্গের সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অলিখিত থেকে যাবে। “

  শ্রদ্ধেয় গুরুসদয় দত্ত মহাশয় বহু অজানা তথ্য আবিষ্কার করেছেন । বর্তমানেও বহু তথ্য সন্ধানী লোকসংস্কৃতি গবেষক এই কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তুলে ধরেছেন জেলাগুলির সুমহান ঐতিহ্য । আমার বর্তমান আলোচনা সেই বহমান লোকসংস্কৃতির একটি ক্ষুদ্র অংশ। গাভীকে কেন্দ্র করে নানা লোকাচারের মাধ্যমে সনাতনী বঙ্গ তথা ভারত এক হয়ে যায়।

#সমাপ্ত

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঋণ স্বীকার : ১. পানুয়ার ইতিকথা

২. কপিলামঙ্গল

৩. বাংলার পট ও পটুয়া

৪. ঋগ্বেদ

৫. মনুসংহিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.