মাধ্যমিক পরীক্ষা ও সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রায় একই সময়ে ঘোষিত হয়েছে।
মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবার ফলাফল অন্যবারের তুলনায় বেশ ভালো। কলকাতা ও শহরতলিকে টেক্কা দিয়েছে মফঃস্বলের ছেলেমেয়েরা। এরপরই শুরু হয়ে গেছে তথাকথিত সুযোগ সুবিধে বেশি থাকা কলকাতার ছেলেমেয়েদের কিভাবে টেক্কা দেয় সুযোগ সুবিধা রহিত মফঃস্বল ও গ্রামাঞ্চলের ছেলেরা। এর সাথে সংবাদপত্রে তুলে আনা হয় প্রচুর সফল ছাত্রছাত্রীর কথা, যারা দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে ভালো ফল করে মাধ্যমিকে।
যারা দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে ভালো ফল করেন, তাদের অধিকাংশেরই কোনো রেফারেন্স বই থাকে না, প্রাইভেট টিউশনের খরচা দেবার মত ক্ষমতাও থাকে না দরিদ্র অভিভাবকদের। অনেকেরই বাবা মায়েরা সকাল হলেই বেরিয়ে পরেন জীবিকার জন্য, ফেরেন রাত্রে। খাওয়া দাওয়া ঠিক থাকে না, তো পড়াশুনোর সময়। অনকেকেই ঘরের কাজ করতে হয়। কারণ উপায় নেই, নাহলে হয়ত খাওয়া জুটবে না। অনেকের ছোটবেলার বন্ধুবান্ধব পড়াশুনো ছেড়ে কাজে ঢুকে পরেছে। তাদের হাতে কাঁচা পয়সা, নতুন নতুন জামাকাপড়। আরো অনেক প্রলোভন তো আছেই। তা সত্ত্বেও শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা পড়াশুনো চালিয়ে গেছে, এবং ভালো রেজাল্ট করে প্রমাণ করেছে নিজের মেধাকে। তার সহায় তার বাবা মায়ের স্নেহ ও দারিদ্র থেকে মুক্তির অদম্য ইচ্ছে কারণ সে জানে একমাত্র শিক্ষাই তাকে ও তার পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পারে। তাই সে হারতে চায়নি, ভালো ফলাফল করে হারাতে চেয়েছে তাদের দারিদ্র্যকে, তার সকল না পাওয়াকে।
অন্যদিকে যারা সচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন সুযোগ সুবিধে পেয়েছে, রেফারেন্স বই, প্রাইভেট টিউশন। বাড়ির প্রাত্যহিক কাজকর্ম কোনোদিন করতে হয়নি, সে জানে তার কোনোদিন খাওয়া দাওয়ার অভাব হবে না। কমপিউটার থেকে স্মার্টফোন থেকে নিত্য নতুন গেম, বছরে দুবার বাইরে ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা, কোচিং ক্যাম্প কোনো কিছুরই অভাব নেই। অনেকেই পেয়েছে বাবা মায়ের গাইডেন্স, তার পড়াশুনোর প্রতি তীক্ষ্ণ নজর। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের ফলাফল ভালো হবে সে বলাই বাহুল্য। বা অনেকে এরকম আছে যাদের বাবা মা এত ব্যস্ত যে সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধে দেওয়া সত্ত্বেও দিনের শেষে সময় হয় না, সন্তান খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করবার বা সারাদিন কি করলো তার খোঁজ নেওয়ার। তা সত্ত্বেও অনেকেই খুব ভালো রেজাল্ট করে।
কিন্তু অনেকে আছে, যারা রেজাল্ট ভালো না করা সত্ত্বেও তাদের বাবা মায়েরা নিজেদের ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে ভালো স্কুলে কলেজে ভর্তি করে দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেন। তারপর ছেলে বা মেয়ে কি করছে তার কোনো খোঁজ খবর রাখেন না। তার ফল আগের চেয়েও খারাপ।
এই ধরনের ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখ্য উদাহরণ হচ্ছেন রাহুল গান্ধী। উনি ‘সোনার চামচ’ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বললেও কম বলা হয়। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের তিন জন প্রধানমন্ত্রী তার পরিবার থেকেই। জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী ও পরবর্তীতে তার পিতা রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। মা সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী না হতে পারলেও ইউ পি এ সরকার তার অঙ্গুলিহেলনেই চলত সে আজকে পরিস্কার। ছোটবেলা থেকেই ভালো স্কুল, যখন ভারতের ৯০ শতাংশ মানুষ এরোপ্লেন দেখেনি তখন রাহুল গান্ধীর জন্মদিন এরোপ্লেনে পালন করা হত, তার ঠাকুমার সৌজন্যে। ছুটি কাটাতে ভারতীয় নৌবাহিনীর আই. এন. এস এয়ারক্রাফ্ট কেরিয়ারও পথ পরিবর্তন করে তাদের পৌঁছে দিত লাক্ষাদ্বীপে। দিল্লীর বিখ্যাত কলেজ বা ইংল্যান্ডের পৃথিবীবিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াও বাধা হয়নি ওনার জন্য। তা সত্ত্বেও ওনার ডিগ্রী নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা আছে। তারপর ওনার কংগ্রেস যোগ দেওয়া ও সাধারণ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়, তারপর কংগ্রেস সভাপতি হয়ে বর্তমান নির্বাচনে আবার শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানি বরণ করাটা লজ্জার নয়। লজ্জার কথা হচ্ছে দায়িত্বশীল বিরোধী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার ব্যর্থতা। মিডিয়া ও কংগ্রেসী ইকোসিস্টেমের বদান্যতায় রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হলেও মানুষের মনে ওনার স্থান পাপ্পু হিসেবেই, তার প্রমাণ দেশের মানুষ দিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু রাহুল গান্ধীর ছোটবেলা থেকেই যদি ওনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে সঠিকভাবে দিশা দেখানো হত, যদি নিজেদের ইনফ্লুয়েন্স ব্যবহার না করে বিভিন্ন কলেজে অন্যায়ভাবে সুযোগ পাইয়ে না দিয়ে ওনাকে প্রকৃত শিক্ষা দিতেন তবে কি উনি আজ যা, তার চাইতে কি ভালো মানুষ হতে পারতেন না। ওনার ব্যক্তিগত জীবনে পিতামহী ও পিতার হত্যা যে দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল সে বিষয়ে নিঃসন্দেহে বলা যায়, একটু সহমর্মিতা ও সহানুভূতি পেলে উনি হয়ত এক দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন।
তাই, আপনার সন্তানদের সব কিছুর সুযোগ সুবিধে দিতে পারবেন কি পারবেন না, সে আপনার অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে, কিন্তু আপনার সন্তানদের অবশ্যই দিন আপনাদের সান্নিধ্য ও ভালোবাসা। ভালো ছাত্র ও মানুষ তৈরী করতে অর্থের প্রয়োজনীয়তা আছে, কিন্তু সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ও সঠিক দিকনির্দেশ অপরিহার্য।