গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন – 

নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ ।

ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ ॥

অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশোষ্য এব চ ।

নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ ॥

সেই যে আত্মা যাকে কাটা যায় না , পোড়ানো যায় না , নষ্ট করা যায় না, যে শক্তিমান ও সর্বত্র বিরাজমান , যে পুরাতন হয়েও চিরনবীন সেই আত্মা । বাঙ্গালীর শৈশবের প্রিয় সুপারহিরো চরিত্রটিও কিন্তু এমনইভাবে নির্মাণ হয়েছে। সেই চরিত্র বাঙ্গালীর বড় আপনজন হয়ে গিয়েছিল সেই ষাটের দশক হতেই। হয়েগিয়েছিল ঘরের লোক। 

হ্যাঁ , আমি সেই গোলাপী রঙের গেঞ্জি আর কালো হাফ প্যান্ট পড়া , আমের মতো মাথাওলা,  খালি পায়ে ,ভীষণ শক্তিশালী , খাদ্য রসিক , এক ফুঁয়ে সাঁজোয়া গাড়ি উল্টে দেওয়া , গায়ের চামড়ায় গুলি লেগে ছিটকে যাওয়া, বুদ্ধিমান আমাদের বাঙ্গালী শৈশবের সুপারহিরো বাঁটুল দি গ্রেটের কথা বলছি। কতই তো কমিক্স পড়েছি না আমরা শৈশবে। তারপর কতশত সুপারহিরোর কমিক্স , এই যেমন ধরুন অরণ্যদেব, ম্যান্ড্রেক, সুপারম্যান, স্পাইডার ম্যান, বিল্লু , চাচা চৌধরী আর সাবু ইত্যাদি। এখন হাল আমলের ব্ল্যাক প্যান্থার, ক্যাপ্টেন আমেরিকা , ব্ল্যাক উইডো , আয়রন ম্যান এইসব অভ্যাঞ্জাররা আমাদের ঘরের দেরাজ ইত্যাদি আলো করে থাকে। কিন্তু বাঁটুলের মতো শৈশবের মনটাকে এখনও কেউ আলো করতে পারে নি। 

তো এহেন সুপারহিরো বাঁটুলের কাছে কিন্তু ভূত, প্রেতরাও অপরাগ। এমন মারটা মারে না , বা এমন করে ভূতের জ্বিহা দিয়ে ভূতকেই পেঁচিয়ে দেয় ,যে ভূতেও নিজের বাবার শ্রাদ্ধ করে পালিয়ে যায়। এক হাতে ল্যাম্পপোস্টটা উপ্রে নিয়ে তার উপর নিজের আরাম কেদারা খানা বসিয়ে ফুটবল খেলা দেখার ব্যবস্থা নিজেই করে নেয়। মাথায় বিরাট হাতুড়ি মারলে তার মনে হয় মাথায় এক ফোঁটা জল পড়ল, মাথায় নারকেল পড়লেও তার কিছু যায় আসে না। তবে কিনা রোজ সকালে একডজন ডিমের পোচ খাওয়া শক্তিশালী বাঁটুলের মনটা ভারী নরম। অন্যের বিপদে এবং আপন দেশমায়ের বিপদে  বাঁটুল সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। 

পাঁচ দশক ধরে বাঙ্গালী জীবন মতিয়ে রাখা এমন কমিক্স চরিত্রের স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথ কেন সৃষ্টি করলেন এমন এক মানব অথচ অতিমানবীয় চরিত্রের ? কার কথা মাথায় আসে আমাদের সুপারহিরো বাঁটুলকে দেখলে? কোন রাস্তা এখনো নস্টালজিক হয়ে আছে বাঁটুল চরিত্র সৃষ্টির জন্যে? আচ্ছা বাঁটুলের কি প্রথম থেকেই বাঁটুল অতিমানবীয় শক্তির অধিকারী ছিল?

বাঁটুল দি গ্রেট হল প্রথম বাঙ্গালা রঙিন কমিক স্ট্রিপ। ১৯৬৫ সালের মে মাসে (বাংলা ১৩৭২, জ্যৈষ্ঠ) প্রকাশিত হয় ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ কমিক্সের প্রথম কিস্তি। এরপর ধারাবাহিকভাবে এই কমিক্স প্রকাশিত হতে থাকে। বাঁটুলের কমিক্স প্রকাশের পর প্রথম চারটি সংখ্যা বাঙ্গালী পাঠকদের মনে খুব একটা রেখাপাত করেনি। কারন প্রথম দিকে নারায়ণ দেবনাথ বাঁটুলকে কিন্তু সুপার পাওয়ার দেননি। একবার কলকাতার কলেজ স্ট্রিট থেকে ফেরার পথে তিনি বাঁটুলের চরিত্রটি কল্পনা করেন ও তৎক্ষণাৎ তার প্রতিকৃতি এঁকে ফেলেন। বাঁটুলের কমিক্সের শেষ ছবির বক্সে শিল্পীর নামের আদ্যক্ষর পাওয়া যেত- ‘না’। সৃষ্টির সময় বাঁটুলের বয়স ছিল ১৭-১৮ বছর। আর ছাতি চল্লিশ ইঞ্চি! 

তাহলে কবে আর কেন দাগ কাটল জাতির জীবনে?কার্তিক ১৩৭২ সংখ্যায় প্রকাশিত হলো ১৯৬৫তে ভারত বনাম পাকিস্তানের যুদ্ধের ময়দানে বাঁটুলের বীরত্ব কাহিনী। তিনটি সংখ্যা জুড়ে প্রকাশিত হলো সেই গল্প! শত্রু সেনার কামানের গোলা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে বাঁটুল প্যাটন ট্যাঙ্ক হাতে তুলে তাড়া করছে, আর ভারতীয় বাহিনীর জন্য পাক সেনাদের বেঁধে উপহার নিয়ে আসছে। দেশপ্রেমে উদ্বেল বঙ্গবাসী পাঠক বাঁটুলের মধ্যে প্রথম নিজস্ব সুপার হিরো খুঁজে পেল। প্রবল জনপ্রিয় হয়ে গেল বাঁটুলের কমিকস। শুকতারায় প্রথমবার বাঁটুলের কমিকস প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে দেব সাহিত্য কুটির থেকে তা খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হতে থাকে।

অনেকেই ধারণা করতে থাকেন, পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত ব্যায়ামগীর মনোহর আইচের আদলে তৈরি করা হয়েছে বাঁটুলকে। হয়তো লেখকের চরিত্র অঙ্কনে কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও অকল্পনীয় শক্তি, বীরত্বে গাঁথা বাঁটুলের তুলনা একমাত্র সুপার হিরোদের সাথেই করা যায়। এখনো পর্যন্ত বাঙ্গালীর নিজস্ব সুপারহিরো কিন্তু বাঁটুলই। কেউই তার একনায়কত্বে ভাগ বসাতে আজও পারেনি।

বিজ্ঞাপনে লাল-কালো দু’রঙা এই কমিক্সকে বলা হত ‘ছবিতে মজার গল্প’। বাঁটুল কিন্তু এক্কেবারেই কমিক্সে একা নয়। বাঁটুলের এক বুড়ি পিসি আছে। বাঁটুল মাঝে মধ্যে লুকিয়ে রান্নাঘর থেকে খাবার খেতে গিয়ে ধরা পড়ে ভারী বকুনি খায় পিসির কাছে। বাঁটুলের দুই বিচ্চু স্যাঙাত ভজা ও গজা যারা সবসময় ব্যস্ত থাকে বাঁটুলকে কিভাবে জব্দ করা যায় তা নিয়ে। কিন্তু শেষে নিজেরাই জব্দ হয়। বাঁটুলের এক রান্নার ঠাকুরও আছে। বাঁটুলের প্রতিবেশী হল বটব্যাল বাবু ও তার চাকর। স্থানীয় পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গেও বাটুলের বন্ধুত্ব। বাঁটুলের প্রিয় বন্ধু লম্বকর্ণ, তার বড় বড় কান, সে বহুদূরের শব্দ শুনে বাঁটুলকে বলে দেয় কোথায় কোন ঘটনা ঘটছে।  আর বাঁটুলের পোষা কুকুরের নাম ভেদো, পোষা উটপাখির নাম উটো।

মাঝে মাঝেই সমসাময়িক বাস্তব ঘটনায় বাঁটুলকে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। তাকে দেখা গেছে অলিম্পিকে সোনার মেডেল জিততে। সে বেড়াতে ভালবাসে। একবার মিশর বেড়াতে গিয়ে বাঁটুল একটি যান্ত্রিক স্ফিংসকে জব্দ করেছিল।

 সৎ ও দেশপ্রেমিক বাঁটুল। ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঁটুলকে নামানো হল ওয়ার ফ্রন্টে। সে দেশের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। বাঁটুলের প্রচণ্ড শক্তি মাঝে মাঝেই তার প্রতিবেশীদের সমস্যার কারণ হয়। নারায়ণ দেবনাথ তার তুলির ছোঁয়ায় এই কমিক্সকে অসামান্য করে তুলেছেন। সমসাময়িক বিষয় থেকে শুরু করে নানা মজাদার বিষয় ছিল এই কমিক্সের প্রাণ। মজার ছলে লেখক অতি সিরিয়াস কথাকে সহজেই পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করতেন যা এক কথায় অনন্য।

ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে, পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় প্রকাশিত হয়ে চলেছে ‘বাঁটুল দি গ্রেট’। তবে সে এখনো চিরনবীন , অক্ষয় , অব্যয়। ২০১৪ সালে ছিল ‘বাটুল দ্য গ্রেট’ কমিক্সের সুবর্ণজয়ন্তী। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক বিরলতম ঘটনা। এক অনন্য রেকর্ড। এতো দীর্ঘদিন ধরে কোনো কমিক্স বেঁচে থাকার নজির কমিক্সের দুনিয়াতেও খুব বেশি একটা নেই। এই কমিক্সের বিভিন্ন বয়সীদের মাঝে এতই কদর যে, ‘বাঁটুল দ্য গ্রেট’ কমিক্স নিয়ে তৈরি হয়েছে এনিমেটেড কার্টুন এবং তা দেখার জন্য ছেলে-বুড়ো এখনো টেলিভিশনের পর্দা থেকে মুখ সরিয়ে রাখতে পারে না।

সমসাময়িক বিখ্যাত বিদেশী কমিকস অ্যাসটেরিক্স আজ প্রায় পঞ্চান্ন বছর বছর অতিক্রম করলেও তাতে কাহিনী ও চিত্ররূপ দিয়েছেন দুজন পৃথক শিল্পী। আর শুধু তাই নয়, অ্যাসটেরিক্স কমিকস একটানা পঞ্চাশ বছরও চলেনি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ কমিক্স সকলকে টেক্কা দিয়েছে ।

সৃজনশীল নারায়ণ দেবনাথের তুলিতে এবং কলমে আজও বাঁটুল সমানভাবে সাবলীল। বৃদ্ধ বয়সেও নারায়ণ দেবনাথ এখনো মেতে আছেন সৃষ্টির খেলায়। সেই জন্যই তিনিও বাঁটুলের মতো চিরনবীন। লেখক আজও নিরলসভাবে এঁকে চলার চেষ্টা করেন এই কমিক চরিত্র। তার হাতে ফুটে উঠেছে বাঁটুল , নন্টে ফন্টে, হাঁদা ভোঁদার মতো আজব সব কীর্তিকাহিনী। 

প্রজাতন্ত্র দিবসের আগের সন্ধ্যাতেই ২০২১ সালের পদ্ম সম্মান প্রাপকের তালিকা প্রকাশ করল কেন্দ্রীয় সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রকাশ করা এই তালিকায় রয়েছে একাধিক বাঙালি নাম। এবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে পদ্ম সম্মানে ভূষিত করা হচ্ছে ৭ জনকে। যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কার্টুনিস্ট নারায়ণ দেবনাথ। 

বয়স বেড়ে গেলেও আজও নস্ট্যালজিয়ায় সেই কমিকসের পাতায় ডুবে থাকেন অনেকেই ৷ আর তার স্রষ্টা তথা লেখক-চিত্রশিল্পী  নারায়ণ দেবনাথকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করছে ভারত সরকার। সোমবার দুপুরেই দিল্লি থেকে তাঁর বাড়িতে ফোন করে এই সুসংবাদ জানানো হয়। ৯৮ বছরের প্রবাদ প্রতীম এই ব্যক্তিত্ব বর্তমানে বার্দ্ধক্য জনিত নানা সমস্যা ভুগছেন। তাই ছবিও বিশেষ আর আঁকা হয়ে ওঠে না। তবে দেরিতে হলেও ভারত সরকার তাঁর গুণের স্বীকৃতি দেওয়ায় খুশি দেবনাথ পরিবার। 

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন ।

মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি।।

নারায়ণ দেবনাথ জানিয়েছেন,  দেরিতে এই সম্মান পাওয়ায় তাঁর কোনো দুঃখ নেই।যখন যেটা পাবার তখন পাবেন। তিনি নিরলস কর্ম করেছেন, তাই কর্মফলও প্রাপ্ত করেছেন। আসুন আমরাও তাঁর জন্য গর্ব বোধকরি। কারণ আমরা গর্বিত শৈশবের অধিরকারী। নারায়ণ দেবনাথ অবশ্যই আমাদের কিন্তু তাঁদের নন যাঁরা বাঙ্গালায় কথা বলতে হবে সেই লজ্জায় বাচ্চাকে অনেক দামী ইংরেজি স্কুলে দেয় , সমাজে ভুলভাল ইংরেজি বলে নিজের মান বাড়াতে চান এবং বাচ্চাকে বাঙ্গালা বই পড়তে দেন না। 

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.