এবারের লোকসভা নির্বাচনে মোদী-ঝড় উঠতে পারে এমন কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, বিরোধী শিবিরের নেতারা তো নয়ই। বরং তাঁরা এই বিশ্বাসে দৃঢ ছিল যে মোদী সরকার দ্বিতীয়বার কিছুতেই ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী হবার দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো শ্লোগান তুলেছিলেন, ‘‘দু’হাজার ঊনিশ, বিজেপি ফিনিস’’। কিন্তু বাস্তবে ঘটল ঠিক বিপরীত ঘটনা। নরেন্দ্র মোদী’র পক্ষে শুধু ঝড়ই ওঠেনি, এই নির্বাচনে উঠেছিল ‘ফোণীর মতো শক্তিশালী এক ঘুর্ণিঝড়, যে ঝড়ে বিরোধী শিবির উড়ে গেল প্রায় খড়কুটোর মতোই।
গতবারের চেয়েও বেশী আসন পেয়ে মোদীজি দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। গতবারের তুলনায় আরও ১৫টি বেশী আসন ঝুলিতে পুরে এনডিএ পৌঁছে গেছে ৩৫১-এ (৬৫%)। আর বিজেপি গতবারের চেয়ে আরও ২০টি বেশী আসনে জিতে ৩০২-এ (৫৬%) পৌঁছে গেছে। অন্যদিকে বিকল্প সরকার গড়ার দাবিদার ইউপিএ’র দৌঁড় থেমে গেছে ১০০-র নীচেই। আর ইউপিএ-র নেতা কংগ্রেস কোনও প্রকারে টেনেটুনে হাফ সেঞ্চুরী করেই আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেছে।
বিরোধীরা মোদী-সরকারকে পরাস্ত করতে মূলত তিনটি ইস্যুকে হাতিয়ার করেছিল- রাফায়েল দুর্নীতি, নোটবন্দি ও ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি। মোদীজি নিজেকে সবসময় দেশের চৌকিদার বলে দাবি করেছিলেন। কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী মোদীজির উক্ত দাবিকে কটাক্ষ ও ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’। অভিযোগ সত্যি, মিথ্যা যাই হোক না কেন প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি ‘চোর’ বলে দেগে দেওয়া ভীষণ অরুচিকর, অশোভন ও অশ্লীল। কিন্তু অন্য বিরোধী নেতারাও অনেকেই তাতে গলা মিলিয়েছিলেন। রাফায়েল দুর্নীতির অভিযোগ সত্যি না মিথ্যা তার ফয়সলা এখনও হয়নি, জনগণও কিন্তু ‘মোদী চোর হ্যায়’ এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
তামাম বিরোধীরা ‘নোটবন্দি’কে ভারতের ইতিহাসে বৃহত্তম আর্থিক কেলেঙ্কারি আখ্যা দিয়েছিল। ভারতবাসী এই গুরুতর অভিযোগটিকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। ‘রাফায়েল’ কেনায় ও নোটবন্দিতে দুর্নীতি হয়েছে কিনা তা নিয়ে সংশয় থাকতে পারে, কিন্তু বিজেপি ও তার সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির অভিযোগ সম্পর্কে সংশয়ের কোনও অবকাশ আছে বলে মনে করি না। তথাপি ভারতবাসী মোদীজিকে কেন পুনর্বার ঢেলে ভোট দিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়াল তা বিরোধী দলের নেতাদের ভেবে দেখা দরকার। কেবলমাত্র ধর্মের সুড়সুড়িতে হিন্দুরা দলে দলে বিজেপি’কে ভোট দিয়েছে, না কি অন্য কোনও কারণে তারা বিরোধীদের প্রত্যাখ্যান ও পরিত্যাগ করেছে, খোলা মনে তা অনুসন্ধান করা দরকার। দরকার আত্মানুসন্ধানও।
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনেও দেশজুড়ে মোদী-ঝড় উঠেছিল। কিন্তু সেই ঝড় পশ্চিমবঙ্গের গায়ে বিশেষ আচড় কাটতে পারেনি, মাত্র দুটি আসনেই বিজেপি’কে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘‘২০১৯শে বিজেপি ফিনিশ’’ শ্লোগানকে ব্যঙ্গ করে বিজেপি এবার মমতার ঘাড়েই নিশ্বাস ফেলছে। ৪২-এ টিএমসি পেয়েছে মাত্র ২২ (গতবারের চেয়ে ১২টি কম) এবং বিজেপি পেয়েছে ১৮টি আসন, গতবারের চেয়ে নয়গুণ বা ৯০০ শতাংশ বেশী। শুধু আসন সংখ্যার নিরিখেই নয়, বিজেপি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে ভোটের শতাংশের হারেও। টিএমসি পেয়েছে ৪৩% আর বিজেপি পেয়েছে ৪০%। লোকসভার নির্বাচনের সঙ্গে রাজ্যের ৮টি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনও হয়েছে। এই উপনির্বাচনগুলিতে বিজেপি তো টিএমসি’কে পেছনে ফেলে দিয়েছে। বিজেপি পয়েছে ৪টি আসন, টিএমসি ৩টি এবং কংগ্রেস ১টি। ভোটের হারেও বিজেপি টেক্কা দিয়েছে টিএমসি’কে, বিজেপি পেয়েছে ৪০.৫%, টিএমসি পেয়েছে ৩৭%।
দিল্লি জয়ের দিবাস্বপ্ন তো ভাঙলই, এবার রাজ্যপাটও যাওয়ার জোগাড়। প্রবল মোদী-ঝড়ে টিএমসি নামক নৌকোটি গেছে ফুটো হয়ে। ফুটো নৌকোয় ইঁদুর থাকে না, অন্য নৌকোয় লাফ দেয়। টিএমসি’র বিধায়করা যে লাফ দিয়ে বিজেপি’র নৌকোয় উঠবে না, তা স্বয়ং মমতাও বিশ্বাস করেন না।
মোদী ঝড়ে খড়খুটোর মতো উড়ে না গেলেও টিএমসি যে রীতিমতো কুপোকাত হয়েছে তা বলা বাহুল্য। মোদী-ঝড়ে টিএমসি’র সাম্রাজ্য ‘ভূমিধ্বসে’ ধ্বস্ত, ২৯৪টি বিধানসভা ক্ষেত্রের ১২৭টি ক্ষেত্রে বিজেপি’র পতাকা পতপত করে উড়ছে। মমতা গর্বভরে বলেছিলেন পাহাড় হাসছে, জঙ্গল হাসছে। সেই পাহাড়ে ও জঙ্গলমহলে মোদী-ঝড় টিএমসি’কে সাফ করে দিয়েছে। গোটা উত্তরবঙ্গেও টিএমসি সাফ মোদী-ঝড়ে, উত্তরবঙ্গ মমতাকে ফিরিয়ে দিয়েছে একেবারে শূণ্য হাতে। মতুয়া ভোটে তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পেটেন্ট ছিল এতদিন। সেই মতুয়ারাও তাঁকে ত্যাগ করেছে। মমতা’কে নির্মমভাবে পরিত্যাগ করেছে আদিবাসী ও তপশিলীরাও।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাইপোকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাটে বসিয়ে দিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে বসার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এখন মোদী-ঝড়ে আম ও ছালা দুটোই যাওয়ার অবস্থা। দিল্লি জয়ের দিবাস্বপ্ন তো ভাঙলই, এবার রাজ্যপাটও যাওয়ার জোগাড়। প্রবল মোদী-ঝড়ে টিএমসি নামক নৌকোটি গেছে ফুটো হয়ে। ফুটো নৌকোয় ইঁদুর থাকে না, অন্য নৌকোয় লাফ দেয়। টিএমসি’র বিধায়করা যে লাফ দিয়ে বিজেপি’র নৌকোয় উঠবে না, তা স্বয়ং মমতাও বিশ্বাস করেন না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তো নির্বাচনের সময়েই বলেছেন যে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে টিএমসি’র ৪০ জন বিধায়কের। মকুল রায় বলেছেন ১০০জন। তাই ২০২১ সাল পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার টিকে থাকবে এমন কথা কেউ হলফ করে বলতে পারছে না।
বুথ ফেরৎ সমীক্ষায় এ রাজ্যে ফলাফলের পূর্বাভাস কম-বেশী ছিল এ রকম- টিএমসি-২৪, বিজেপি-১৬ এবং কংগ্রেস-২। মানুষ বিশ্বাস করেনি এমন পূর্বাভাস। টিএমসি’র নেতা, কর্মী, সমর্থকরা তো করেই নি। টিএমসি’র বিপর্যয় এবং বিজেপি’র রকেট গতিতে উথ্থান আমাকে মোটেই বিস্মিত করেনি। আমি মনে করি, এ ফলাফল বিস্ময়কর মনে হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। এ রাজ্যের মানুষ টিএমসি’র সরকারকে আর সইতে পারছিল না। সরকারের অপশাসনে মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাই কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রহরায় অধিকাংশ বুথে ভোট হওয়ায় এ নির্বাচনে শাসক দলের বিরুদ্ধে মানুষ মনের সুখে ভোট দিয়েছে। সারা রাজ্যে বিরোধীদের জন্য যদি অবাধে কাজ করার সুযোগ থাকত এবং সমস্ত বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলে শাসক দল বোধ হয় ২২টি আসনও পেত না। পোস্টাল ভোটের ফলাফল সে কথাই বলছে। ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৩৯টিতে বিজেপি বেশী ভোট পেয়েছে। মাত্র তিনটি আসনে (যাদবপুর, দক্ষিণ কলকাতা ও রায়গঞ্জ) টিএমসি’র ভোট বেশী। মোট পোস্টাল ভোট পড়েছে ১,০৯,৭০১টি। যার মধ্যে বিজেপি ও টিএমসি’র প্রাপ্ত ভোট যথাক্রমে ৬৮,৩৯৮ (৬২.৩৪%) ও ২৫৭৯১ (২৩.৫১%)। এটা প্রমাণ করে যে প্রায় ২/৩ অংশ মানুষ টিএমসি সরকারকে চায় না।
মমতা সরকারের কিছু হটকারি সিদ্ধান্ত হিন্দু ভাবাবেগকে প্রচন্ড রূপে আহত করেছে, কিন্তু তাতে মুসলিমদের কোনও কল্যাণ হয়নি। যেমন, মহরমের দিন দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। মহরমের মিছিলে অস্ত্রশস্ত্রের অনুমতি প্রদান, কিন্তু রামনবমীর মিছিলে অস্ত্রশস্ত্রে নিষেধাজ্ঞা। মমতা সরকারের এসব নীতি বিজেপি’কে হিন্দুত্ববাদী সাফল্য এনে দিতে সাহায্য করেছে। হিন্দুদের কাছে বিজেপি ক্রমে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, একমাত্র বিকল্প হয়ে উঠেছে।
মানুষ এই সরকারের প্রতি এত বিরূপ মনোভাবাপন্ন কন? হবেই বা না কেন? রাজ্যে আইনের শাসন বলতে অবশিষ্ট কিছুই নেই। শাসনের নামে যা চলছে তা অপশাসন ছাড়া কিছু নেই। জঙ্গলের শাসনকেও হার মানিয়েছে টিএমসি সরকার। সর্বত্র জাঁকিয়ে বসেছে পুলিশের মদতে গুন্ডারাজ, সিন্ডিকেট রাজ ও তোলাবাজদের রাজ। মাফিয়ারা করছে প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ। কয়লা খনিতে মাফিয়া, বালি খাদানে মাফিয়া, পাথর খাদানে মাফিয়া, বাংলাদেশে গরু পাচারে মাফিয়া, কোথায় নেই মাফিয়া রাজ? দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও দলবাজিরও সীমা-পরিসীমা নেই। কাটমানি ছাড়া কোনও কাজ হয় না। পঞ্চায়েত বা পৌরসভাই হোক, রাজ্য সরকার কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পই হোক, সর্বত্রই কাটমানি রাজ চালু হয়েছে। কাটমানি না দিলে ১০০ দিনের কাজ পাওয়া যায় না। সরকারি অর্থায়নে গৃহহীনরাও কাটমানি না দিলে গৃহ পায় না। চাকরি-বাকরি তো নেই, যৎসামান্য যা হয় তা মোটা টাকা ঘুষ ছাড়া হয় না। লুট চলছে সর্বত্র। সরকারি মদতে চলছে লুটের রাজত্ব।
অপশাসন ও গণতন্ত্র পাশাপাশি চলতে পারে না। তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার তাই শুরু থেকেই গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরেছে। বিরোধী দলের উপর বেলাগাম সন্ত্রাস চালানো হয়েছে। শত শত নেতা-কর্মীদের ঘর ছাড়া করা হয়েছে, জেলে পোরা হয়েছে এবং খুন-জখম করা হয়েছে। জেলের ভয় ও অর্থের লোভ দেখিয়ে বিরোধী জনপ্রতিনিধিদের ভাঙিয়ে এনে পঞ্চায়েত ও পৌরসভাগুলি একের পর এক দখল করা হয়েছে। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ নির্বাচন, যাকে ধ্বংস করা হয়েছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৩৪% আসনে বোমা-বন্দুক দেখিয়ে বিরোধী দলগুলোকে মনোনয়ন পত্রই জমা দিতে দেয়নি। বাকি আসনগুলি বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দিয়ে জয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। মানুষের ভোট দেবার অধিকারটুকু এভাবেই ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে যা শাসক দলের কর্মী ও সমর্থকদের বেজায় ক্ষুব্ধ করেছে। এরও প্রতিফলন পড়েছে ভোট বাক্সে।
শাসক দলের নজিরবিহীন সন্ত্রাসের সামনে দাঁড়াতে পারেনি কংগ্রেস ও বাম দলগুলি। তাসের ঘরের মতো বাম ও কংগ্রেস দলগুলি। একমাত্র বিজেপি’ই কিছুটা হলেও শাসক দলের সংগঠিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পেরেছে। তার ফলও তারা পেয়েছে। কংগ্রেস ও বাম কর্মীরা অনেকেই নীতি ও আদর্শের কথা ভুলে আত্মরক্ষার্থে ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বিজেপি’র পতাকা হাতে তুলে নিয়েছে।
টিএমসি সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রতিবাদ ও আন্দোলন এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করার পাশাপাশি ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিও রয়েছে বিজেপি’র বিস্ময়কর উথ্থানের পেছনে। বিজেপি’র ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির সাফল্যের পেছনেও রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত। তাঁর নগ্ন মোল্লাতোষণ নীতি বিজেপি’র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পথকে সুগম ও প্রশস্ত করে তুলতে সাহায্য করেছে। এই প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতি ও সরকারি পদক্ষেপ হিন্দুদের অসন্তুষ্ট করেছে, হিন্দু ভাবাবেগকে আহত করেছে এবং এমন কি বহু স্থানে, বিশেষ করে মিশ্র অঞ্চলগুলিতে নিজেদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে হিন্দুদের মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্কের আবহ সৃষ্টি হয়েছে।
মমতা সরকারের কিছু পদক্ষেপ সামগ্রিকভাবে মুসলিম সমাজের অকল্যাণ বৈ কল্যাণ করেনি, কিন্তু হিন্দুদের অসন্তুষ্ট করেছে, ক্রমে দূরে ঠেলে দিয়েছে। যেমন, ইমাম ও মোয়াজ্জিন ভাতা, ঝাঁ-চকচকে হজ হাউস নির্মাণ, মাদ্রাসা শিক্ষার বিপুল সম্প্রসারণ, ইত্যাদি।
মমতা সরকারের কিছু হটকারি সিদ্ধান্ত হিন্দু ভাবাবেগকে প্রচন্ড রূপে আহত করেছে, কিন্তু তাতে মুসলিমদের কোনও কল্যাণ হয়নি। যেমন, মহরমের দিন দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। মহরমের মিছিলে অস্ত্রশস্ত্রের অনুমতি প্রদান, কিন্তু রামনবমীর মিছিলে অস্ত্রশস্ত্রে নিষেধাজ্ঞা। মমতা সরকারের এসব নীতি বিজেপি’কে হিন্দুত্ববাদী সাফল্য এনে দিতে সাহায্য করেছে। হিন্দুদের কাছে বিজেপি ক্রমে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, একমাত্র বিকল্প হয়ে উঠেছে। কারণ, মমতা সরকারের মোল্লা সমাজের এই পদলেহনকারী নীতি ও পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়েছে একমাত্র বিজেপি দলই।
টিএমসি সরকারের আর একটি আত্মঘাতী নীতি হল মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ও মুসলিম জঙ্গিদের আড়াল করা। এ জিনিস দেখা গেছে বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে, যার সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জেএমবি (জামায়েতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ) যুক্ত ছিল। সে ঘটনায় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে পুরো ঘটনাটি ধামাচাপা দেবার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। রাজ্য সরকারের একই রকম ভূমিকা দেখা গেছে দেগঙ্গা, ধুলাগড়, কালিয়াচক, সমুদ্রগড়, বাদুড়িয়ার দাঙ্গার ক্ষেত্রেও। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আগ্রাসী ও আক্রমণকারী ছিল মুসলিম মৌলবাদীরা ও মুসলিম দুষ্কৃতিরা এবং আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল হিন্দুরা। এসব ভয়ঙ্কর কোনও ঘটনারই বিজেপি ছাড়া অন্য কোনও দল বা সংগঠনকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। এমন কি সামান্য নিন্দাটুকুও তারা করেনি। এরূপ ঘটনা যত ঘটেছে হিন্দুরা ততই নিরাপত্তার অভাব বোধ করেছে এবং নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য বিজেপি’র স্মরণাপন্ন হয়েছে। এভাবেই যে হিন্দুরা একদা ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবাপন্ন ছিল তারাও হিন্দু মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। বিজেপি’র এ রাজ্যে রকেটের গতিতে উত্থানের পেছনে এটাই প্রধান কারণ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নগ্ন মোল্লাতোষণ নীতি অনুসরণ করা, তাকে কংগ্রেস ও বামেদের সমর্থন করা, এসবই মুসলিম ভোট পাওয়ার জন্য। তার ফলও তারা পেয়েছে। বিজেপি’কে যে প্রার্থী হারাতে পারবে বলে মনে করে মুসলিমরা তাকে ঢেলে ভোট দিয়েছে। তারই ফলশ্রুতিতে ১২টি মুসলিম অধ্যুষিত কেন্দ্রের মধ্যে টিএমসি পেয়েছে নয়’টি এবং জাতীয় কংগ্রেস পেয়েছে দুটি। মুসলিম ভোট তিন ভাগে ভাগ হওয়ার ফলে বিজেপি’র ঝুলিতে গেছে রায়গঞ্জ কেন্দ্রটি।
শুধু মমতা বন্দ্যোপাধায় কি কেবল মোল্লাতোষণ নীতি নিয়ে চলেন? বামেরাও দীর্ঘ ৩৪ বছর মোল্লাতন্ত্রকে তোষণ করেছে। কংগ্রেসের সব প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীরাও ঐ তোষণ নীতির ধারক ও বাহক। লালু, মুলায়ম, মায়াবতী প্রমুখ নেতারাও এই তোষণ নীতির পৃষ্ঠপোষক। এ সবই করা হয় ধর্মনিরপেক্ষতার নামে। এ তো প্রকৃত ধর্ম-নিরপেক্ষতা নয়, এ হল মেকি ধর্মনিরপেক্ষতা (Pseudo Secularism)। এই মেকি ধর্মনিরপেক্ষবাজরা হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত, কিন্তু মুসলিম মৌলবাদীদের বেলায় বোবা-কালা। সংখ্যালঘুদের উপর হিন্দুত্ববাদীর আক্রমণে এঁরা প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। কিন্তু মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের হামলায় অমুসলিমরা শয়ে শয়ে হতাহত হলে, বাংলাদেশ-পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের উপর অকথ্য নির্যাতন-নিপীড়ন হলে, তাদের দেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসতে বাধ্য করলে এঁরা কানে তুলো গোজেন ও চোখে ঠুলি পড়েন। মেকি ধর্মনিরপেক্ষবাজদের এই নগ্ন ও নির্লজ্জ দ্বিচারিতাই ভারতভূমিকে ধীরে ধীরে হিন্দুত্ববাদীদের ঊর্বরভূমি করে তুলেছে। তাই তো আজ ভারত গেরুয়া রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে। এর কৃতিত্ব যত না মোদীজি’র, তার চেয়ে বেশী ঐ মেকি ধর্মনিরপেক্ষদের।