“শার্লে হেবদো ” এই পত্রিকাটির নামের সাথে আমরা সবাই আশাকরি অল্প বিস্তর পরিচিত। ১৯৭০ সাল থেকে প্রকাশিত এই ফরাসী সাপ্তাহিক পত্রিকাটিতে মূলত বাঙ্গাত্তক কার্টুন, চুটকি বা লেখা প্রকাশ করা হয়। অতি বাম কেন্দ্রিক এই পত্রিকায় বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি বা রাজনীতি নিয়ে এই রচনা গুলো করা হয়ে।
২০১১, ২০১৫ এবং ২০২০ সালে এই পত্রিকাটি সন্ত্রাসবাদী হামলার শিকার হয়, যার মুল কারণ ছিল ইসলাম (মূলত নবী মুহাম্মদ) কে নিয়ে তৈরি করা কার্টুন। এই হামলা বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিলেও বহু ইসলামী দেশ বা সংঘটনের সমর্থনও পেয়েছে। তাদের যুক্তি ছিল, নিউটনের তৃতীয় সূত্রটি। যদিও এই সুদীর্ঘ চলার পথে শার্লে হেবদো বহুবার বহু বাধার সম্মুখীন হয়েছে। একবার রাজনৈতিক কারণে পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করাও হয়েছিল। কিন্তু এই রকম হিংস্র প্রতিবাদের সম্মুখীন তারা ইসলামী গোষ্ঠীর কাছে প্রথমবার হয়। অতি সম্প্রতি সামুয়েল প্যাঁটি নামক এক শিক্ষককে হত্যা করা হয় এই একই কারণে। এবং তারপর সারা পৃথিবীজুড়ে শুরু হয় ফ্রান্স বিরোধী এক রাজনীতি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী যদিও এই ঘটনায় ফ্রান্সের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের অতি বাম সংগঠন গুলো এই বিষয়ে বিশ্ব মানবতার খাতিরেও সেই অর্থে কোনও রকম বিরোধিতা জানায়নি।
আমাদের ভারতীয় লেখক সালমান রুশদির লেখা উপন্যাস “দি স্যাটানিক ভার্সেস” ইসলামী ধর্মানুভুতিতে আঘাত করার অপরাধে অপরাধী। বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত এই বইকে কেন্দ্র করে হারিয়েছে বহু নিরীহ প্রাণ। ১৯৮৮ সালে রাজীব গান্ধী সরকার ভারতে নিষিদ্ধ করে এই বইটি।
আমাদের বাঙালি লেখিকা তসলিমা নাসরিন সর্বপ্রথম নিন্দার মুখে পরেন “লজ্জা” উপন্যাস লিখে। যেই উপন্যাসে উনি বর্ণনা করেছেন ঢাকার একটি হিন্দু পরিবারের কাহিনী। এই উপন্যাসের মাধ্যমে উনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশে হিন্দুরা প্রতি মুহূর্তে কি পরিমাণ অত্যাচারের সম্মুখীন হয়, যা তাদের বাধ্য করে দেশত্যাগী হয়ে ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে আসতে। তারপর ইসলাম ধর্মের কিছু গোঁড়ামি বা সমাজে নারীর অবস্থানের কিছু চিত্র তুলে ধরার অপরাধে উনাকে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ থেকে বিতারিত করা হয়। এই বাংলায় উনি একটু আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে কলকাতার দরজাও চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় লেখিকার কাছে। যদিও ইউরোপের বহু দেশ উনাকে স্থায়ী নাগরিকত্ব দিতে খুবই আগ্রহী। কিন্তু আমাদের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার উনাকে এই রাজ্য থেকেও বিতারিত করে। পরবর্তীকালে আমাদের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীও এই নারীবাদী লেখিকাকে কলকাতাতে আসার কোনও রকম সুযোগই দেননি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য শার্লে হেবদো থেকে তসলিমা নাসরিন এরা কেউই শুধু মাত্র ইসলাম বিরোধী লেখাই লেখেন না। শার্লে হেবদো যেমন আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতি কে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করে কার্টুন বার করেছে, ঠিক সেই ভাবে তসলিমা নাসরিনও আমাদের হিন্দু বা ভারতীয় বহু রীতিনীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন এবং নিজের মত প্রকাশ করেছে। তাই বলে আমরা কেউ ভাবিনি যে তসলিমা নাসরিনকে ভারত ছাড়া করতে হবে। উনি ভারতেই থাকেন এখন। বা শার্লে হেবদো নিয়েও আমরা সেরকম একটা মাথা ঘামাই না।
অতি সম্প্রতি কলকাতার এক অভিনেত্রী একটি মিম শেয়ার করা নিয়ে চূড়ান্ত নিন্দার সম্মুখীন হয়েছেন। সেই মিমটি তে আছে শিবরাত্রিতে শিব লিঙ্গ কে কনডম পোরান হচ্ছে। এই অভিনেত্রীর ঈদ বা বড়দিন সংক্রান্ত পোস্ট গুলোতে আমার মিম পাইনা। পাই শুভেচ্ছা বার্তা। শুধু মাত্র শিবরাত্রিতেই উনার মুক্তমনা কৌতুক বোধ জেগে ওঠে। সুতরাং উনি কখনই শার্লে হেবদোর জায়গাতে পৌছনোর দাবিদার হতে পারেন না। উনার আচরণটা ইস্কুলের সেই জ্যাঠামো করা ছেলেটির মত, যে কোন শান্ত ছেলে পেলেই উৎপাত করা শুরু করে, কিন্তু হেড মাস্টারের ছেলের চূড়ান্ত বাঁদরামো দেখেও চুপ করে বসে থাকে।
এই অভিনেত্রী দাবী করছেন যে উনার এই পোস্টটির জন্য উনাকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। আমাদের দেশে মহিলারা বার বার সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছেন। এই ঘটনাটা সেটারই একটি উদাহরণ। কিন্তুু রাজনৈতিক ছত্রছায়ার তলে আরামে দাড়িয়ে উনি একিতি রাজনৈতিক গোষ্ঠীকেই দায়ী করছেন। অথচ উনি সেই দলের ছত্রছায়াতে দাড়িয়েই এই কথা গুলো বলছেন, যেই দলের প্রধান মুখ বহু দিন আগেই এই বাংলাতে ধর্ষণকে “ছোট্ট ঘটনা” বলে ধর্ষিতার “রেট” নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যেই নেত্রী তার দলের নেতা যখন প্রকাশ্য রাস্তায় “ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে দেব” হুমকি দিলে সেটা কে দুষ্টু ছেলের দুষ্টুমি হিসাবে দেখেছেন। সেখানে এই হুমকি নিয়ে প্রতিবাদ কি সত্যিই মানায়?
Satabdi Bhattacharya