আজ রবীন্দ্র সদনে আমাদের গানের স্কুলের অনুষ্ঠান ছিল।  অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে প্রায় ৯টা বেজে গেলো। তারপর ক্যাব করে সোনারপুরে বাড়ি ফিরতে  ফিরতে  ১০টা পেরিয়ে গেল। বাড়ি ঢুকতেই আমার শাশুড়ি বিশাল চীৎকার চেচামেচি শুরু করে দিল। আমি নাকি মহাপাপী। জাহান্নামের আগুনে জ্বলব আমি ইত্যাদি  ইত্যাদি । আমার বড় দুই জা রান্নাঘরে কাজ করতে করতে তামাশা দেখল। আর আমার বর মশাইও চুপচাপ বাধ্য ছেলের মত বসে থাকল, কারণ তার বিশ্বাস আমিই মানিয়ে চলি না, বিয়ে যখন করেছি মানিয়ে চলার দায় টাও আমার। আমিও আমার ঘরে ঢুকে আমার নিজের কাজ শুরু করলাম। 

          আমি মধুমিতা চক্রবর্তী, আমার বাবা বিখ্যাত বাংলার অধ্যাপক সুবিমল  চক্রবর্তী, আমার মা স্কুল শিক্ষিকা সুচিত্রা  চক্রবর্তী। বরাবরই মুক্তমনা,  শিক্ষিত পরিবারে বেড়ে ওঠা আমি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে আধিকারিক। ছোটবেলা থেকে গান আমার সাথী। যাদবপুরে পড়ার সময় আমার পরিচয় হয় আনিসুরের সাথে। আমি ছিলাম একনমিক্স বিভাগে আর আনিসুর ছিল বাংলায়। ছাত্র রাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র আনিসুর ছিল সুবক্তা, সুগায়ক। গণসংগীতের রিহার্সাল আনিসুরকে ছাড়া ভাবাই যেত না। ফ্যাসিবাদ, পুঁজিবাদ এইসবের খারাপ দিকগুলো দারুণ  ভাবে বুঝিয়ে দলে অনেক নতুন ছেলে মেয়ে এনেছিল আনিসুর। আনিসুর আর আমি শুধু এক্ টাই স্বপ্ন দেখতাম, শ্রেণিহীন এক সমাজ। খুব ভাল বন্ধু ছিলাম আমরা। সেই বন্ধুত্ব কবে ভালবাসা হয়ে গেল আমি টেরই পেলাম না। 

          আমার বাড়ির অমতেই আমি আনিসুরকে বিয়ে করি। আনিসুর বলে “আমরা সবাই সংগ্রামী মানুষ, এটাই আমাদের পরিচয়। ধর্মান্ধ পাষণ্ডের দল, যারা ধর্মের নামে মানুষ মারে, তারাই পারে ভালবাসাকে ‘জিহাদ’ বলতে। আর তাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ হল এই বিয়ে।” আনিসুর বলেছিল, “আমার মা-বাবার কাছে আমার সুখ টাই সব, ছেলে জাকে ভালবেসে ঘরে আনবে, তাকেই মা- বাবা নিজের মেয়ের মত ভালবাসবে।আমার মা বাবাও পাঁচ বার নামাজ পরেন, কিন্তু এটা উনাদের ইচ্ছা। ঠিক সেই রকম তুমি তোমার ইচ্ছে মত থাকবে।”

         আনিসুররা তিন ভাই, দুই বোন। আমার বড় দুই ভাসুর মিলে হোটেলের ব্যবসা করেন, আর দুই ননদের বিয়ে হয়েছে মালদা। আনিসুর ছাত্র জীবনেই ঠিক করেছিল এই পচা সমাজটা ঠিক করার জন্য লড়বে, তাইতো আমি মাস্টার্স করেই চাকরীর চেষ্টা শুরু করি। বছর তিনেকের মধ্যে চাকরীটা পেয়েই বিয়ে করি। কোর্ট ম্যারেজ হয় আমাদের। বন্ধুরা সবাই খুব মজা করেছিল আমাদের বিয়েতে।  

           আমার বিয়ের এক মাস পরেই এল বকরী ঈদ। খুব ধুমধাম করে আমার শ্বশুরবাড়িতে এই পরব পালন করা হল। চিরকাল কালী পুজাতে নিরীহ পাঁঠা বলি দেওয়া রীতির তীব্র প্রতিবাদী আনিসুর দেখলাম কেমন নির্বিকার ভাবে দেখল  নিরীহ গরুর জবাই। হিন্দু বাড়িতে জন্মেছি বলে আমি কোনোদিন গরুর মাংস খাইনি, যদিও আমি এই সব ফালতু কুসংস্কার আর মানিনা। তাই বাড়ির মেয়েদের সাথে খেতে বসে আমিও এক টুকরো গোস্ত খেলাম। খেতেই দেখি আমার দুই জা আর শাশুড়ি নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে।

        তারপর ধীরে ধীরে সব কেমন পাল্টে যেতে লাগল। ওরা আমায়  মধুমিতা রহমান হওয়ার জন্য বলতে লাগল। আমি বিরক্ত হয়ে আনিসুরকে বললাম, “এই সব কি বলছে তোমার বাড়ির লোক? আমি কেন নিজের পরিচয় বদলাবো?” আনিসুর বলল, “শ্রেণী বিভক্ত সমাজে তুমি  চক্রবর্তী  হও কি রহমান কি আসে যায়? আসলে তুমি একজন শ্রমিক। এই সব বোকা বোকা সেন্টিমেনট নিয়ে কান্নাকাটি কি আমাদের মানায় কমরেড? “

          আজকাল আনিসুর শুক্রবার করে ওর বাবার সাথে মসজিদ যায়। কিছু বললে বলবে, “একটু সোশালাইজেশন করছি,এতে ভুল টা কি?” আনিসুরের সাথে তর্কে কে বা পারবে? অথচ দুর্গা পূজার দশমীতে আমি সিঁদুর খেলেছিলাম বলে আনিসুরের সে কি হাসি। আমি নাকি প্রাচীন পন্থী, ধর্মান্ধ দের মত আচরণ করছি।

           তবে সব থেকে বড় ধাক্কা টা খেলাম পরশুদিন। আমি গানের অনুস্থানের জন্য ঘরে বসে রেওয়াজ করছিলাম। হঠাৎ আমার শাশুড়ি এসে আমায় নোংরা গালাগাল দিতে শুরু করল। আমি কাফের, তাই গানের মত হারাম জিনিষের চর্চা করছি। উনাদের নামাজ নষ্ট করছি গান করে। আমি বেশরমের মত ঘুরে বেড়াই, অন্য বউদের মত পর্দা করিনা। আর কত কি। আমার মাথা গেল গরম হয়ে, আমি আনিসুরকে ডেকে বললাম, “আমার সহ্যের একটা সীমা আছে আনিসুর। আমি আর পারছিনা। চলো আমরা আলাদা থাকি।” আনিসুর যথারীতি ওর ওই সব শ্রেণী শত্রু, সমাজ ইত্যাদি মার্কা বাতেলা শুরু করল। আমার ধৈর্যের বাধ সেদিন ভেঙ্গে গেল, আমিও বললাম, “বন্ধ কর তোমার দ্বিচারিতা। নামাজ ,রোজা , হালাল, হারাম সব মানো, বাড়ির মেয়েদের হিজাবের মধ্যে রাখো আর বড় বড় বাতেলা মারো? আমাদের পূজা নিয়ে হাসাহাসি কর আর নিজে তো যাও নামাজ পরতে। ওই পরে কি হয়? আল্লাহ মহান, হজরত মহান এই ছাতার মাথা তো খুব বিশ্বাস কর।তুমি একটা…” ব্যাস এর মধ্যেই ঠাস ঠাস করে দুটো থাপ্পর পরল আমার গালে। আমি তাকিয়ে দেখি এক অন্য আনিসুর। সে আমায় বলল, “চুপ কর হারামজাদি, তোর ওই নাপাক মুখে আমার নবীজীর নাম নিলে জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব। যতসব কাফেরে দল।”

          গত দুদিন আমি সারা কলকাতা জুড়ে একটা সস্তা ফ্ল্যাট খুজেছি, আজ সকালে একটা পেয়েও গেছি। বাইরে ক্যাবটা দাড় করানোই ছিল । আমি ও  চুপচাপ আমার জিনিষপত্র গুছিয়ে ক্যাবে এসে বসলাম। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বেড়িয়ে এলাম। গান আমার প্রান। আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির প্রান এই গান, তাই আমি এই বর্বরগুলোর জন্য আমার গানের অনুষ্ঠান বাদ দেইনি। মা বাবার কাছে ফিরে যাবার মুখ আমার নেই। কারণ, আমি খবর পেয়েছি যে আমার বিয়ের পরপরই মা স্ট্রোক করে। একটা দিক পরে গেছে মায়ের। বাবাও শরীর, মন সব দিক থেকেই ভেঙ্গে পরেছে। আপাতত একা থেকে মা-বাবার প্রতি যে অন্যায় আমি করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত আমি করব। গভীর তপস্যা করে যেমন  ঈশ্বরের দর্শন পাওয়া যায়। আমিও আমার ঈশ্বর আমার মা-বাবার  দর্শন প্রার্থনায় করব  তপস্যা।

শতাব্দী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.