মান হুঁশ তৈরির খরচ ২টাকা, ‘সদাই ফকিরের পাঠশালা’র কারিগর পাচ্ছেন পদ্মশ্রী

সকাল সন্ধ্যে বিরাম নেই তাঁর। চালিয়ে যাচ্ছেন মানুষ তৈরির কারখানা। মান হুঁশ তৈরি করে দেওয়ার খরচ? মাত্র দু’টাকা। হ্যাঁ, এটাই সুজিত চট্টোপাধ্যায়। তিনি তাঁর পাঠদানের কর্মসূচি বাবদ মাত্র দুটি টাকা নেন। চারিদিকে যখন শিক্ষাক্ষেত্র ব্যাবসায় রূপান্তরিত হচ্ছে। অতিমারির সুযোগ নিয়ে একের পর এক লার্নিং অ্যাপ মাথাচারা দিচ্ছে, যেখানে কত পড়াশোনা সত্যিই মগজে ঢোকানো যায় তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বলেই মনে করে শিক্ষা মহল এমন এক পরিস্থিতিতে একজন শিক্ষক বছরের পর বছর মাত্র দু’টাকা গুরু দক্ষিণায় বিলিয়ে চলেছেন শিক্ষা। এমন কাজের জন্যই বর্ধমানের আউশগ্রামের সুজিত চট্টোপাধ্যায় পাচ্ছেন ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান।

ঘর লাগোয়া লম্বা বারান্দা, টালির ছাদ। সেখানে সারি দিয়ে বসে আছে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা।  তাদের মাঝে এক বৃদ্ধ। পরনে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। শীতে বড়জোর একটা চাদর। চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষাদান পর্ব।

এক সময়ে রামনগর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন সুজিতবাবু। এখন তাঁর প্রকৃত মানুষ গড়ার স্থানে পড়ুয়ার সংখ্যা ৩৫০ জন। ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশই আদিবাসী সম্প্রদায়ের। আর তাদের ৮০ শতাংশই মেয়ে। সুজিতবাবুর এই যাত্রা শুরু হয়েছিল অবসর গ্রহণের পরে।

সালটা ২০০৪। একদিন তিনজন ছাত্রী এসে তাঁর কাছে পড়ার জন্য অনুরোধ করে। অনুরোধ ফেলতে পারেননি তিনি। সেই থেকেই শুরু ‘সদাই ফকিরের পাঠশালা’। ৩ থেকে আজ সংখ্যাটা ৩০০ পেরিয়েছে, কিন্তু, মাস্টারমশাই আগের মতোই আছেন। এখনও ক্লাস শুরু হয় সকাল ছ’টায়। শেষ হয় সন্ধে ছ’টায়। স্কুলের মতো নিয়মের কড়াকড়ি আছে এখানেও। আছে রেজিস্ট্রারের খাতা, হয় পেরেন্ট-টিচার মিটিংও। সুজিতবাবু বেতন নেন বছরে মাত্র দু’টাকা।

বেতন না বলে সাম্মানিক বলাই ভালো। ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। কেউ বা আসছেন নিতান্ত দুঃস্থ পরিবার থেকে। স্কুলেও যেতে পারে না কেউ কেউ। তাদের জন্যই সুজিতবাবুর এই প্রয়াস। বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৭ বছর। আউশগ্রামের সবথেকে কাছের কলেজ ৩২ কিলোমিটার দূরে। গ্রামে ভালো স্কুলেরও অভাব রয়েছে। এজন্য সরকারি আধিকারিকদের চিঠিপত্রও লিখেছেন বিস্তর। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এত কিছু সত্ত্বেও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষায় যথেষ্ট ভালো ফলাফল করে। সুজিতবাবু তাঁদের পড়ান বাংলা ও ভূগোল। কলেজ পড়ুয়াদের পড়ান বাংলা।

শুধু পড়ানোই নয়, থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের জন্য সুজিতবাবু অনুদানও সংগ্রহ করেন। এখনও অব্ধি তিনি ৬০টি শিশুর জন্য অনুদান তুলেছেন। আজকের এই অন্ধকার সময়ে দাঁড়িয়েও কেউ কেউ সমাজের স্বার্থে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। পালন করছেন সমাজের প্রতি তাঁদের কর্তব্য। সুজিত চট্টোপাধ্যায় তাঁদেরই একজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.