জ্ঞানদানন্দিনী ঠাকুর ( ২৬ জুলাই ১৮৫০ – ১ অক্টোবর ১৯৪১) ১৯ শতকের একজন সমাজ সংস্কারক যিনি বাংলার নারীদের ক্ষমতায়ন ও বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব-এর জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
যশোরের নরেন্দ্রপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন জ্ঞানদানন্দিনী । বাবা অভয়চরণ মুখোপাধ্যায় এবং মা নিস্তারিনী দেবী। তার বাবা তাকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। সে সময়কার রীতি অনুসারে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর বিয়ে হযে যায় খুবই অল্পবয়সে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে ১৮৫৭ সালে যখন তার যখন বিয়ে হয় তখন সে সাত বছরের শিশু। পিতা অভয়চরণ কুলীন ব্রাহ্মণ বংশের হওয়া সত্ত্বেও পিরালি পরিবারের একজনকে বিয়ে করার কারণে তাকে সমাজচ্যূত করা হয়।
যশোরের শান্তু ও মনোরোম পরিবেশের বিপরীতে কলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে নিজেকে তিনি আবিষ্কার করলেন কঠোর পর্দার মাঝে। ১৮৬২ সালে সত্যেন্দ্রনাথ যখন তার প্রবেশনারি ট্রেনিং এর জন্য ইংল্যান্ডে যান তখন জ্ঞানদানন্দিনীকেও সাথে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু পিতা দেবেন্দ্রনাথ সেটি মানলেন না। পরে জ্ঞানদানন্দিনীর দেবর হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখাপড়ার দায়িত্ব নিলেন। তিনি বিখ্যাত ব্রাহ্ম শিক্সাবিদ আয়াধ্যনাথ পাকরাশির কাছেও শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮৬৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন প্রথম ভারতীয় সিভিল সার্ভিস সদস্য হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে ফিরলেন তখন জ্ঞানদানন্দিনী তার স্বামীর সাথে বোম্বেতে গিয়ে বসবাস শুরু করলেন।
১৮৭৭ সালে গর্ভবতী অবস্থায় জ্ঞানদান্দিনী ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন তার তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে। সেই সময় একদিকে কোনও ভারতীয় নারীর সাগর পাড়ি দেয়ার কথা শোনা যেতনা, সে সঙ্গে তিনি ছিলেন আবার কোনও পুরুষ সঙ্গীবিহীন । তার এই সাহসিকতা সেসময় সামাজিকভাবে আলোড়ন তৈরি করে। তার স্বামীর কাকা জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর তাকে লন্ডনে স্বাগত জানান। তিনি প্রথম এশিয়ান ব্যারিস্টার ছাড়াও ছিলেন খ্রীস্ট ধর্মে দীক্ষিত একজন ব্যক্তি। কিংসটন গার্ডেনসে তার বাড়িতে কিছুদিন থাকার পরে জ্ঞানদানন্দিনী সাসেস্কের ব্রাইটনে মদীনা ভিলায় একটি বাড়িতে চলে যান। ১৮৭৮ সালের অক্টোবরে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছুটিতে ছোটভাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে সেখানে আসেন। মৃত সন্তানের জন্মদান এবং কণিষ্ঠ পুত্র কবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কারণে ইংল্যান্ডে তার প্রথম বছরটি ছিল বিষাদে পূর্ণ। লন্ডনের কেনসাল গ্রিন সিমেট্রিতে দ্বারকানাথ ঠাকুরের সমাধির পাশে কবীন্দ্রনাথকে সমাহিত করার ব্যবস্থা করেন তিনি। শিগগিরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তার এবং তার সন্তানদের সখ্য গড়ে ওঠে। তার কন্যা ইন্দিরা পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দীর্ঘদিনের অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে ওঠেন। সত্যেন্দ্রনাথের ছুটি শেষে সুরাটে বদলী হয়ে যান এবং জ্ঞানদানন্দিনী সন্তানদের নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন।
কলকাতায় লোয়ার সার্কুলার রোডে বাংলোতে বসবাস শুরু করেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। ইন্দিরা এবং ভাইঝি সরলার স্মৃতি থেকে জানা যায়, জ্ঞানদানন্দিণী দেবী কখনোই জোড়াসাঁকোর সাথে তার সম্পর্ক কখনো পরিত্যাগ করেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়েতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং তরুনী বধূ মৃনালিণীর পরামর্শক হিসেবে ছিলেন তিনি। সময়ের সাথে সাথে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতার রাজ্যেও বিস্তৃত হয়। রবীন্দ্রনাথের নাটকের পারফর্মেন্সেও সহযোগিতা শুরু করেন তিনি। বাড়ির অন্যান্য মেয়েদেরও উৎসাহিত করতেন মাঝে মাঝেই। এভাবেই তেরি হয় বাল্মিকী প্রতিভা, কালমৃগয়া, রাজা ও রানী, মায়ার খেলা এবং বিসর্জন। ইন্দিরা দেবীর স্মৃতি থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে, জ্ঞানদানন্দিনী তার উঁচু অবস্থানের পরও সেসময়কার কলকাতার গ্লামারাস জগতের বাসিন্দাদের সাথে মেলামেশা করেননি।
কলকাতার সমাজ তার প্রতি ততটা সহানুভূতিশীল ছিল না। ১৮৮৯ সালে রাজা ও রাণী নাটকে তার অভিনয়ের নিন্দা তুলে ধরা হয় জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা বঙ্গবাসীতে। হাস্যকরভাবে ঠাকুরবাড়ির যেখানে এই নাটক মঞ্চস্থ হতো সেখানে এখন একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
“আমার মামী জ্ঞানদা ব্রিটেন থেকে নতুন একটি প্রথা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। সেটি হল “জন্মদিন”। এর আগে এই ধরনের অদ্ভুত উদযাপনের সম্পর্কে আমাদের জানা ছিল না। প্রকৃতপক্ষে আমরা এমনকি কবে জন্ম নিয়েছি সেটাই তো জানতাম না। একবার সুরেনের জন্মদিনের উৎসব থেকে ফেরার পর জোড়াসাঁকোর শিশুদের মাঝে যে উন্মাদনা দেখেছিলাম তা এখনো নির্দিস্টভাবে স্মরণ করতে পারি। এবং শুধু তাই না শিশুরা তাদের জন্ম কবে হয়েছিল তার খোঁজ নিতে শুরু করলো। আমাদের পশ্চিমামনস্ক পরিবার নিশ্চিতভাবেই দ্রুত এই ধারনা গ্রহণ করে, যা ব্রাহ্ম সমাজও যা করেছিল। এখন দেখুন সারা দেশেই জন্মদিন উদযান করা হচ্ছে”।
সূত্র: সরলা দেবী চৌধুরানী, জীবনের ঝরাপাতা।
১৯০৭ সালে তিনি এবং সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রাঁচিতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে যানে এবং ১৯১১ সাল থেকে সেখানেই স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৪১ সালে মারা যান জ্ঞানদানন্দিনী দেবী।
BengalRising