ভারতের গণতন্ত্র রাস্তার মোড়ে নেমে এসেছে!

এই বছরের​ প্রজাতন্ত্র দিবস বিভিন্ন কারণে সমালোচনামূলকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের গনতন্ত্রের মূল ভিত্তি হল সংবিধান, কিন্তু এই মেরুদন্ডকেই বর্তমানে এমন এক পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে যা অতীতে কখনো ঘটেনি। গত কয়েক মাসের ঘটনাবলী দেখে সন্দেহ হচ্ছে যে জনতা শাসন না আবার গণতন্ত্রকে ছাড়িয়ে যায়। নৈরাজ্যবাদীদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে যেন নির্বাচনের আর কোনো দরকার নেই এবং ভারতের নাগরিক দ্বারা নির্বাচিত সরকারের থেকে রাস্তায় নেমে অরাজকতা সৃষ্টিকারী জনতার ক্ষমতা বেশী। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো যে গনতন্ত্রের অপব্যবহার করা এই জনতা কি ভারতের আইনের বলেই বলীয়ান হয়ে উঠেছে? ভিন্নমতাবলম্বীদের​ অধিকার কি তাহলে দেশের অন‍্যান‍্য আইনকে খর্ব করে ভারতীয় নাগরিকদের অসুবিধায় ফেলতে পারে? ধর্নার মতো একটা শক্তিশালী অস্ত্র যা মহাত্মা গান্ধী বিদেশী শাসনকে পরাভূত করার জন্য কাজে লাগিয়েছিলেন​, একটা স্বাধীন দেশে কি সেই নিয়ম বৈধ হতে পারে, যেখানে নির্দিষ্ট নির্বাচন পদ্ধতি এবং জনগণের সক্রিয় ভূমিকার​ মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত হন? বিভিন্ন ছোটখাটো রাজনৈতিক দলের তার্কিক রাজনীতিবিদ এবং তাদের প্রতিনিধিরা মতবিনিময়ের মাধ্যমে যেভাবে ভারতে শাসন করে চলেছে তাহলে কি সরকার নির্বাচনের​ ক্ষেত্রে নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠদের এইভাবেই অবহেলা সহ্য করতে হবে?

হ্যাঁ, এই প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতীয় গণতন্ত্র রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। এটা কোন ধরনের রাজনৈতিক সম্মেলন যেটা বামরা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে? কই এর আগে পর্যন্ত তো এমন কোনো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়নি। দুঃখের বিষয় হল এটাই, যে দলটি সংবিধান গঠনের সূচনা করেছিল এবং প্রায় ৬০ বছর ধরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতার লাগাম নিজেদের হাতে ধরে রেখেছিল, তারা আজ নৈরাজ্যবাদীদের পাশে দাঁড়াচ্ছে এবং গনতন্ত্রকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।

আমরা এমন এক সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি যেখানে ভারতের একটি ছোট অংশের কমসংখ্যক কৃষকরা এমন একটি কৃষি আইন বন্ধ করার চেষ্টা করছেন যেটা থেকে সারা ভারত জুড়ে কয়েক লক্ষ কৃষক উপকৃত হবে এবং সেই সব সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক যারা এই কৃষি আইনকে সমর্থন করছে তারা শুধুমাত্র​ রাস্তায় নামেনি বলে তাদের মতামতের কি কোনো গুরুত্ব থাকবে না। এই কৃষকরা সরকার, আদালত এবং আইন মেনে চলা নাগরিকদের ভয় দেখানোর পাশাপাশি তাদের বিচার করারও চেষ্টা করছে। মিথ্যে অপপ্রচারের মাধ্যমে তারা পুরো দেশকে আবেগতাড়িত করে বোঝাতে চাইছে যে এই নতুন কৃষি আইন তাদের অর্থ‍্যাৎ কৃষকদের এক ভয়াবহ পরিস্থিতির​ দিকে ঠেলে দেবে এবং তাদের লভ‍্যাংশের উপর থাবা বসাবে, যদিও আসল ঘটনা তার উল্টো। বর্তমান কৃষি আইন বিগত কৃষি আইনের থেকে শতগুণে ভালো। এই নতুন আইন আসলে তাদের জমির উপর অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে​ সুরক্ষিত করবে। যাইহোক, নতুন কৃষি আইন সম্পর্কে যথেষ্ট আলোচনা আগেই করেছি, আর নতুন করে আমি কিছু বলতে চাই না।

আমার​ মতো লক্ষ লক্ষ নাগরিককে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে হয়রানি করার পর, শাহীনবাগের ঐ জনতাদের সেখান থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ জানাতে যাওয়া পুলিশদের দুর্দশা আমরা দেখেছি। আইনশৃঙ্খলার​ দায়িত্ব কি আদালতের​ হাতে স্থানান্তরিত হতে পারে? সেটা হলে আমরাই​ আবার শাসনব্যবস্থায় অরাজকতা চলার জন্য আদালতকে দোষ দিতে​ থাকবো। কৃষকের আন্দোলনের ক্ষেত্রে এখন এই একই দৃশ‍্যের পুনরাবৃত্তি চলছে। আমি বহুবার যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছি যে শাহিনবাগ ঘটনার মাধ্যমে নৈরাজ্যবাদীদের বোঝানো হয়েছে যে সরকার হয়তো এই ব‍্যাপারে নিজের শাসন ক্ষমতার সাহায্য নেবে না, কারন অতীতে ইউপিএর-র সাথে জোট থাকার সময় মাঝরাতে দুর্নীতিবাজদের​ নির্মমভাবে দমন করার ঘটনায় ছোটখাটো রাজনৈতিক দলগুলি সেই ঘটনার সমালোচনা করেছিল। তারা এই ব‍্যাপারেও নিশ্চিত ছিল যে মহাত্মা গান্ধী যেমন বিদেশী শক্তিকে চ‍্যালেঞ্জ জানিয়ে আইন পাস করিয়েছিলেন ঠিক তেমন ভাবেই আদালত প্রতিবাদকারীদের সংখ‍্যা দেখে সেইরকমই কোনো ঐতিহাসিক রায় দেবে।

২০১৪ সালের পর থেকে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের প্রতিটি আইনের বিরুদ্ধেই​ আদালতে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে বা জনসমক্ষে প্রশ্নবানে বিদ্ধ করা হয়েছে, এমনকি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপের ব‍্যাপারেও। সরকারের তরফে নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আদালতে বা রাস্তায় চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। আদালতের রায় বামপন্থী এবং সঙ্কীর্ণ উদারপন্থীদের স্বপক্ষে হলে তখন তাকে স্বাগত জানানো হয় কিন্তু যদি এর উল্টোটা হয় তখন শুরু হয় তিরষ্কার এবং গালাগালি দেওয়া। রাম মন্দিরের​ ঘটনা তো শুধু একটা উদাহরণ মাত্র। সুতরাং, নির্বাচিত সংসদ এবং আইন আদালতের পবিত্রতা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাম নৈরাজ্যবাদী এবং তাদের সাথে জড়িত ইসলামপন্থীদের ক্রোধ ও হতাশা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে সারা বিশ্ব এবং বিখ্যাত বিদেশী জার্নাল দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত কোভিড ভ্যাকসিনকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টা ও চিকিৎসা শাস্ত্রের​ ভ্রাতৃত্ববোধের কঠোর পরিশ্রমকে ক্ষুন্ন করতেও তারা দ্বিধা বোধ করছে না। এইভাবেই আমাদের গণতান্ত্রিক সমাজে বিশ্বাসের শিকড় আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রতি তোলা এই প্রশ্নচিহ্ন সভ‍্যতা ধীরে ধীরে পতনের মুখে যাবে। ইতিহাসে এইভাবেই​ গুপ্ত সাম্রাজ্যের​ পতন হয়েছিল। আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী পঞ্চায়েত ব‍্যবস্থা দেশের গনতন্ত্রের ভিত্তিকে মজবুত করে এসেছে সেই অনাদিকাল থেকে। দেশের সম্পদ এবং প্রযুক্তিকে নষ্ট করার জন্য বিদেশী শক্তি হানা দিয়েছে বারবার, কিন্তু আমাদের একতা আর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য তাদের সেই আশা পূর্ণ হয়নি।

যেসব বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদরা আইনের শাসনকে ক্ষুণ্ন করার নোংরা চেষ্টা চালাচ্ছে এবং নিজেদের শক্তির অপব্যবহার করে আনন্দিত হচ্ছে, তারা এটুকু বুঝতে পারছেনা যে তারাও একদিন এই অশুভ শক্তির শিকার হতে পারে। ঠিক যেমন বলশেভিক বিপ্লব তার নিজের​ সন্তান, লেখক থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী, সহযোগী এবং নেতাদের গ্রাস করেছিল। গণতন্ত্রকে উপেক্ষা করে জনতা- শাসন সমর্থনকারীরা​ হলেন কমিউনিজমের পূজারী এবং যারা মার্কসকে সঠিক বলে প্রমাণ করার জন্য প্রায় ১০০ লক্ষ অসহায় মানুষের হত্যা করেছিলেন। তারা প্রতিবেশী দেশগুলির সমাজের উপর নিজেদের মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার জন্য ধ্বংস করেছে তাদের সভ্যতা, তাদের সংস্কৃতি এবং তাদের মানবিক অস্তিত্বকে। অতীতের কথা ভুলে যান, এমন লোকেরা আছেন যারা ভারতে উত্তর কোরিয়ার কিম জংয়ের মতো পাগল স্বৈরচারীশাসকদের​ প্রশংসা করেন!

প্রশাসনের প্রতিটি পদক্ষেপেই ত্রুটি রয়েছে। তবে, আরএসএসের প্রধান শ্রী গুরুজি সহ প্রায় সমস্ত চিন্তাবিদরা​ উল্লেখ করেছেন যে, গণতন্ত্রই হল সর্বোত্তম। এই জন‍্যই আমাদের সংবিধানের রচয়িতা কখনও গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব‍্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেন নি। তিনি সমস্ত রকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব সরিয়ে রেখে গণতান্ত্রিক দেশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছে। ডঃ আম্বেদকারের স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের অনুপ্রেরণা হলেন তথাগত বুদ্ধ, ফরাসী বিপ্লব নয়। আমরা আমাদের এই মহান জাতির মূল্যবান ঐতিহ্য হারাতে পারি না। এইজন্য আমাদের দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং আমাদের প্রজাতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্থ করার জন্য সৃষ্টি হওয়া নৈরাজ্যবাদী শক্তিকে শক্ত হাতে দমন করার দায়িত্ব আমাদের ই নিতে হবে। ভারতের জন্ম হয়েছে ১৯৪৭ সালে। আমাদের ভারত অমর এবং চিরন্তন। আসুন আমরা ভারতকে রক্ষা এবং সুষ্ঠভাবে পরিচালনায় কাজে অগ্ৰসর হই।

https://www.newsbharati.com/Encyc/2021/1/26/Republic-Day-India-.html

রতন শারদা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.