আটক ভারতীয় পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে মুক্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করে গত বৃহস্পতিবার ফের শান্তির বার্তা দিয়েছিলেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। কিন্তু সেই অন্তঃসারশূন্য শান্তির বার্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করল পাকিস্তানের শীর্ষ কূটনৈতিক স্তর থেকেই। যেমন আমেরিকায় নিযুক্ত প্রাক্তন পাক রাষ্ট্রদূত হুসেন হাক্কানি খোলাখুলিই জানিয়ে দিলেন, শান্তির কথা কেবল মুখে বললেই চলবে না। সন্ত্রাসবাদ দমনে তথা পাকিস্তানের মাটিতে জঙ্গি শিবিরগুলিকে মদত দেওয়া বন্ধ করতে হবে ইসলামাবাদকে। নইলে পাকিস্তানের কথা আর কেউ শুনবে না।
প্রাক্তন এই পাক রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, পাকিস্তানে জঙ্গি শিবিরগুলি কতটা সক্রিয়, গোটা দুনিয়া এখন জানে। পাকিস্তান সরকার মুখে যতই অস্বীকার করুক, এই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি নাশকতার ঘটনা ঘটিয়ে তার দায় নিতে সব সময়েই অতি উৎসাহী। ফলে অনেক পাকিস্তানির কাছে এ কথা তেতো লাগলেও বাস্তব হল, গত তিরিশ বছর ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদকে মদত দেওয়ার যে নীতি চালাচ্ছে ইসলামাবাদ, তা ডাহা ফেল করেছে। তাতে কাশ্মীরের জীবনযাপনের মান উন্নত হওয়ার পরিবর্তে আরও ভয়াবহ হয়েছে। আর তাই, কাশ্মীর নিয়ে পাক অজুহাতে কান পাততেও আর রাজি নয় আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল।
প্রসঙ্গত, দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনও দেশের আমেরিকা স্থিত রাষ্ট্রদূত কূটনৈতিক ভাবে অনেক উঁচু পদ। হুসেন হাক্কানির গুরুত্বও পাক কূটনীতিতে সর্বোচ্চ স্তরে ছিল। ইমরান তথা পাকিস্তানের অবস্থান নিয়ে তীব্র সমালোচনা করে গতকাল সেই হাক্কানিই তাঁর মত জানিয়েছেন মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্টে। যা তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। অনেকের মতে, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দৃশ্যতই ইসালামাবাদের উপর এখন চাপ বাড়াচ্ছে আমেরিকা। এটা অনেকাংশে নয়াদিল্লির কূটনৈতিক সাফল্যও বটে।
২০০৮ সালে লস্কর ই তইবা যখন মুম্বইতে সন্ত্রাসবাদী হামলা চালায়, সেই সময়ে আমেরিকায় পাক রাষ্ট্রদূত ছিলেন হুসেন হাক্কানি। তিনি জানিয়েছেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে এ বার মার্কিন কূটনীতিকদের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান মুখ বাঁচানোর সুযোগ পেল এবং সাময়িক ভাবে যুদ্ধ পরিস্থিতি এড়াতে পারল ইসলামাবাদ। অথচ পিছনে তাকালে দেখা যাবে, ২০০৮ সালেও মুম্বই সন্ত্রাসের পর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছিল। তাঁর কথায়, “সে বার খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, বিদেশ সচিব কন্ডোলিজা রাইজ, এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্টিফেন হ্যাডলি বার বার দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে উত্তেজনা প্রশমিত করেছিলেন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তখন মুম্বই সন্ত্রাস নিয়ে ইসলামাবাদকে গোয়েন্দা তথ্য দিয়েছিল। কিন্তু তা নিয়ে গোড়ায় কিছুটা পদক্ষেপ করেছিল পাকিস্তান। তার পর ফের যে কে সেই।”
হাক্কানির মতে, ২০১৬ সাল থেকে কৌশল বদলায় নয়াদিল্লি। নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে জঙ্গি শিবির ভাঙতে সার্জিকাল স্ট্রাইক করে। কিন্তু আদৌ কিছু হয়নি দাবি করে সে বারও উত্তেজনা এড়ানোর চেষ্টা করেছিল পাকিস্তান। এ বার ফের ভারত যখন জঙ্গি শিবির ভাঙতে বিমান হানা চালায়, তার পর পাল্টা বিমান হানা চালায় পাক বায়ুসেনা। ভারতীয় পাইলট তাতে আটকও হয়ে যান।
প্রাক্তন পাক রাষ্ট্রদূতের মতে, পাকিস্তানি সেনা গোয়েন্দারা শুধু এটা বোঝার চেষ্টা করছেন যে ভারত কোনওরকম পারমাণবিক অস্ত্রের হানা নিয়ে কতটা আশঙ্কায় রয়েছে। ভারতের মনে সেই ভয় ও আশঙ্কা জিইরে রেখে জঙ্গি কার্যকলাপে মদত চালিয়ে যেতে চান ওঁরা। কারণ, তাঁরা মনে করছেন, এতে খরচ কম, অথচ ধারাবাহিক ক্ষতি সাধনের ক্ষমতাও বেশি। সুতরাং ভারতের বিরুদ্ধে মৌলবাদী সন্ত্রাসে ইন্ধন দেওয়া চলুক। এই মোদ্দা কথাটা বুঝে ফেলেই আসলে ভারতও কৌশল বদলেছে। পুরোদস্তুর যুদ্ধ ঘোষণা না করেও, জঙ্গি শিবির ভাঙতে আঘাত হানছে। কখনও সার্জিকাল স্ট্রাইক হচ্ছে, কখনও জঙ্গি শিবির ভাঙতে বিমান হানা। এবং পাকিস্তানকেও বুঝতে হবে গোটা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল কিন্তু এ ব্যাপারে নয়াদিল্লির পাশেই রয়েছে। এমনকী সৌদি আরব, চিনের মতো পাকিস্তানের তথাকথিত বন্ধুরাও আর সন্ত্রাসবাদকে পাকিস্তান সমস্যার সঙ্গে জুড়ে দেখতে রাজি হচ্ছে না। মার্কিন বিদেশ সচিব মাইক পম্পেও স্পষ্ট ভাবে ইসলামাবাদকে জানিয়ে দিয়েছেন, জঙ্গি ঘাঁটিগুলো ভাঙতেই হবে পাকিস্তানকে। ফ্রান্স, জার্মানির বক্তব্যও তাই। ফলে ইসলামাবাদকে বুঝতে হবে মুখে শুধু শান্তির কথা বললেই হবে না, সন্ত্রাস দমনে ইসলামাবাদের কাছে আরও সদর্থক পদক্ষেপ আশা করছে আন্তর্জাতিক মহল।