ভারতবর্ষ এমন এক পূন্যভূমি যেখানে ভগবান স্বয়ং আশ্বাসবানী দিয়েছেন ” সম্ভবামী যুগে যুগে”।সেই আশ্বাসের মর্যাদা রক্ষার জন্য ভগবান এই ধরাধামে বহুবার নানানরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন, এটা আমাদের বিশ্বাস করি। এই ভূমির বিশেষত্ব বোধহয় এটাই। অযোধ্যায় শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম বৃত্তান্ত কমবেশী আমাদের সকলের জানা। তাঁর জীবনযাপন থেকে শুরু করে প্রজাপালন, দান-ধ্যান সমস্ত কিছুই হিন্দুদের কাছে আদর্শ স্বরূপ। ভগবান রামের জাতিধর্ম, উচ্চ নীচ নির্বিশেষে প্রজাপালন বর্তমান সমাজের প্রতি এক বিশেষ বার্তা বহন করে।
প্রাচীন ভারতে বৈদিক মুনিঋষিরা তাই উদাত্ত কন্ঠে উচ্চারণ করতেন অহং ব্রহ্মাস্মি – “আমিই ব্রহ্ম”, বা “আমি দিব্য। এখানে দেহ পোশাক। বাকি সব পরমআত্মার অংশ। সবার মধ্যে পরমাত্মা রাম বাস করেন। জীবে প্রেম করেন যে সে
জন শিব সেবা করেন। এখানে কেউ ছোট বা বড় নয়।
সমাজ গড়ে উঠেছে কর্মের ভিত্তিতে। এখানে সবাই সবার মঙ্গল কামনা করেন।
সর্বে ভবন্তু সুখিন,
সর্বে সন্তু নিরাময়া,
সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু,
মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত,
ওম শান্তি শান্তি শান্তি।
অর্থাৎ সবাই যেন সুখী হয়, সকলে যেন নিরাময় হয়, সকল মানুষ পরম শান্তি লাভ করুক, কশ্মিনকালেও যেন কেহ দুঃখ বোধ না করেন। সকলের শান্তি লাভ করুন।
আমরাই বেদ মন্ত্র উচ্চারণ করে তাই বিশ্বের মঙ্গল কামনা করে বলতে পারি –
বসুধৈব কুটুম্বকম – অর্থাৎ গোটা বিশ্ব আমার আত্মীয়,আত্মীয়- অর্থাৎ আত্মার সাথে সম্পর্ক। একি কোন দেশের সার্বিক মন্ত্র??
গুরুগৃহে আমরা শিক্ষা পাই যে, ত্যাগ ও সেবাই জীবনের সূত্র। ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ থেকে এই রাষ্ট্র।
ধর্মে চ অর্থে চ কামে চ মোক্ষে চ ভরতর্ষভ|
যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নেহাস্তি ন তত্ক্বচিত্ ||
ভারতে রাজ্য অনেক রাষ্ট্র এক। মানুষ এক। এক রাষ্ট্র ,এক জন , এক সংস্কৃতি….
*Shreeram Janmbhoomi Mandir Nirman Samarpan Karyakram at Bharat Sevashram Sangha Auditorium, Ballygunge, Kolkata – Pradip Joshi Ji’s speech*
প্রাচীন ভারতে ঋগ্বেদ, সংহিতা, ব্রাহ্মণ, মহাভারত এবং বৌদ্ধদের পালি শাস্ত্রে রাজনীতিবিদদের কথকতা উল্লেখ আছে। তক্ষশীলায় অবস্থানকারী চাণক্য ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক চিন্তাবিদ। তিনি অর্থশাস্ত্র রচনা করেন যাতে রাজনৈতিক চিন্তাধারা, অর্থনীতি এবং সামাজিক ভারসাম্যের কথা তুলে ধরেছেন। এতে মুদ্রা ব্যবস্থা ও আর্থিক নীতি, কল্যাণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, যুদ্ধের আত্মরক্ষামূলক কলাকৌশল-সহ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। চাণক্য যুগের অবসানের দুই শতক পরবর্তীকালে রচিত মনুস্মৃতি গ্রন্থেও ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম প্রামাণ্য বিষয় হিসেবে স্বীকৃত। যদিও বহু পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন যে, প্রাচীন ভারতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চা স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠে। প্রাচীন ভারতে ধর্ম কেবলমাত্র পূজাপার্বণ ছিলনা, বরং ধর্ম বলতে বোঝাত, একপ্রকার জীবনচর্যা, যা মানুষ এবং সমাজের উন্নতি সাধন করে। প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তার একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হল সপ্তাঙ্গ। কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে এবিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার মতে, কোন রাষ্ট্রের মোট উপাদান হল সাতটি। যথাঃ- স্বামী, অমাত্য, জনপদ, কোষ, দুর্গ, দূরগ, মিত্র। কৌটিল্যর এই সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব বর্তমান কালের বহু চিন্তাবিদকেও বিস্মিত করে।
: দুর্ভাগ্যজনক এটাই যে সনাতন ভারতীয় হিন্দুর বংশোদ্ভূত হয়েও রামের মাহাত্ম নিয়ে চর্চা করতে দ্বিধাবোধ করি ও নিজেদের পিছিয়ে পড়া হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির শরীক বলে ভাবি ! অথচ শ্রী রাম চরিত্র বা জীবনী শুধু যে ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক বা বাহক নয়, আপামর বিশ্বে মানবতার স্বার্থে, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে তার প্রভাব অনস্বীকার্য যার সীমারেখা উত্তরে অযোধ্যা থেকে সোনার লঙ্কা বা শ্রীলঙ্কার মধ্যে টানলে হয়তো ভূল হবে। প্রাসঙ্গিকভাবে এই লেখাটা তুলে ধরার প্রয়াস করছি সকলের মতামতের জন্য।
বৈদিক যুগে আনুমানিক সাত হাজার বছর আগে ত্রেতা যুগে বাল্মীকি মুনি রচিত রামের ঐতিহাসিক অস্তিত্ত্ব নিয়ে যে গবেষণা চলছে সেটা চলুক। তবে আবহমানকাল ধরে সেই অযোধ্যা, বয়ে চলা সরয়ূ নদী, চিত্রকূট, দন্ডকারন্য, রামসেতুর ভৌগলিক অবস্থান ও অস্তিত্ত্ব, সেই সোনার দ্বীপ লঙ্কা আজও স্থানমাহাত্বে অপরিবর্তিত হয়ে রয়েছে। কোনো মহম্মদ, খিলজি, তুঘলক বা আরংজেব তার নাম পরিবর্তনে সফল হন নি। মহমেডান প্রভাবে বাবর যে রামমন্দির ধ্বংশ করেই সেই ভিতএর উপরেই মসজিদ গড়ে রাম মাহাত্বকে খর্ব করার অপপ্রয়াস করেছিলেন সেটা এখন পুরাতাত্ত্বিক খননে প্রতীয়মান হয়েছে যার পুরোধা ছিলেন বিশেষজ্ঞ কে কে মহম্মদ যিনি এই নিরীক্ষনে বহূসংখ্যক মুসলমান লেবার নিযুক্ত করেন ধর্মনিরপেক্ষতার স্বার্থে। খননে যে মন্দিরের কমপক্ষে চৌদ্দটি থাম পাওয়া গিয়েছে শুধুু তাই নয়, রাবন বধের কাহিনীর ফলকের পূনরুদ্ধার করা গিয়েছে। মন্দিরের মকরমূখী পয়ঃপ্রনালীর অবস্থান বাবরি মসজিদের মধ্যে নজর করা গিয়েছে।
রামায়নের রচনাকার যে মহাকাব্য রচনা করেছিলেন সেটার প্রভাব যে পৃথিবীর অন্য দেশে বা মহাদেশে ছিল তার বহূ এমন অত্যাশ্চার্য নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে ভারতবর্ষের বাইরেও।
সাহিত্যে, ধর্মে ও সংস্কৃতিতে রামায়নের প্রতিফলন পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে পাওয়া যাওয়াতে এর জনপ্রিয়তা সম্বন্ধে এক সম্যক ধারনা পাওয়া যায়। হয়তো তার মধ্যে কিছু প্রাদেশিক প্রভাব থাকলেও থাকবে, কিন্ত রামায়নের উদ্ধৃতি রয়েছে তিব্বত, নেপাল, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, ক্যাম্বোডিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া, জাপান, সুমেরীয়, আজটেক, মায়া সভ্যতায়। রামায়ন থেকে কোথাও কোথাও কোনো বিশেষ ঘটনাবলী সেই দেশগুলোর কলা ও সংস্কৃতিতে পাওয়া গিয়েছে যেখানে রাম হল শ্রেষ্ঠ মানবাদর্শের প্রতীক।
তাঁর আদর্শ – সমাজ তথা মানবজাতির মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া এবং স্থায়ী করাই ছিল রামমন্দির নির্মাণের মুখ্য উদ্দেশ্য। মন্দিরে মম কে আসিলে হে!
সকল গগন অমৃতগমন,
দিশি দিশি গেল মিশি
অমানিশি দূরে দূরে ॥
সকল দুয়ার আপনি খুলিল,
সকল প্রদীপ আপনি জ্বলিল,
সব বীণা বাজিল নব নব সুরে সুরে ॥
ভারতের মন্দিরগুলি শিল্পকলা, ধর্মীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও হিন্দু জীবনদর্শনের এক সংমিশ্রণ। এগুলি হল একটি পবিত্র ক্ষেত্রের মধ্যে মানুষ ও ব্রহ্মের মিলনকেন্দ্র।
ভারতীয় প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলিতে মন্দিরকে বলা হয়েছে ‘তীর্থ’। এটি একটি পবিত্র ক্ষেত্র যার পরিবেশ ও নকশা হিন্দু জীবনদর্শনের প্রতিটি ধারণাকে প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশ করে। জীবন সৃষ্টি ও রক্ষার প্রতিটি বিশ্বজনীন উপাদান হিন্দু মন্দিরে উপস্থিত – আগুন থেকে জল, দেবতার মূর্তি থেকে প্রকৃতি, পুরুষ থেকে নারীসত্ত্বা, অস্ফুট শব্দ ও ধূপের গন্ধের থেকে অনন্ত শূন্যতা ও বিশ্বজনীনতা – সবই মন্দিরের মূল আদর্শের অন্তর্গত।
কিন্তু এই মন্দির নির্মাণের পথ কখনই সুগম ছিল না, এর পিছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৮০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গুলজারি লাল নন্দ – তৎকালীন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সহ-সর-কার্যবাহ, পরবর্তী কালে যিনি সরসংঘচালকও হন, সেই প্রফেসর রাজেন্দ্র সিংহকে একবার রামজন্মভূমি বিষয়ক সংঘর্ষ নিয়ে কাজ করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু রামমন্দির নিয়ে তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার দরুণ তিনি প্রথমে এই বিষয়ে এগোতে না চাইলে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সমস্ত রকম নথি-পত্র দিয়ে সাহায্য করেন। পূর্ববর্তী সংঘর্ষের ইতিহাস জানার পর প্রফেসর রাজেন্দ্র সিংহ “রাম জন্ম ভূমি মুক্তি”- বিষয়ক একটা প্রস্তাব আধিকারিকদের সামনে উপস্থাপিত করেন এবং এই বিশেষ বিষয়ে সংঘ যুক্ত হয়ে পড়ে। তাঁর এই প্রস্তাব “বিশ্ব হিন্দু পরিষদ” -এর কাছেও গ্ৰহনযোগ্যতা পায়। আর এই ব্যাপারে অগ্ৰনী ভূমিকা পালন করেছিলেন অশোক সিংহল । রাজেন্দ্র সিংহের মতোই তিনিও রামজন্মভূমিতেই মন্দির গড়ার বিষয়ে সোচ্চার হন। তাঁর এই দাবি ধীরে ধীরে জনমানসেও প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু রাম জন্ম ভূমিতেই মন্দির কিভাবে বানানো সম্ভব সেটা নিয়েও অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এবং জলঘোলা হতে থাকে।
অশোক সিংঘলের এই দাবির পর তাঁকে অনেক সমস্যা ও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু রাম জন্মভূমির প্রতি মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাসকে সাথে নিয়ে ওখানেই মন্দির বানানোর ব্যাপারে তিনি ছিলেন অনড়। রাম মন্দির নির্মাণ বিষয়ক এই আন্দোলন ধীরে ধীরে গন আন্দোলনের রূপ নেয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বেচ্ছায় এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্ৰহন করেন। ১৯৯২ সালে যখন রাম মন্দিরের কাঠামো ভাঙ্গা নিয়ে দেশ যখন উত্তাল তখন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মা সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে দু-লাইনের একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেখানে তিনি জানতে চেয়েছিলেন যে মন্দিরের এই ভাঙ্গা কাঠামোর নীচে কি ছিল সেটা কোনোভাবে জানা সম্ভব কিনা।রাষ্ট্রপতির এহেন চিঠির পর সুপ্রিমকোর্ট নির্দেশ দেন মন্দিরে রিমোট সেন্সিয়ের সুবিধা রাখার জন্য।
রিমোট সেন্সিং-এর পর মন্দির আরও মজবুত হয়ে ওঠে। পরে মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট হিন্দু বিশ্বাস, আস্থার পূর্ণ মর্যাদা রক্ষার জন্য দাবি করা জায়গায় রাম মন্দির গড়ে তোলার এবং সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ফলে মন্দিরের যে অংশ ধ্বংস হয়েছিল তাকে পূনঃ নির্মাণ করার রায় দেন।
সুপ্রীমকোর্টের এই ঐতিহাসিক রায়ের পর প্রধানমন্ত্রী শ্রী মোদী অযোধ্যায় “রাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র” গড়ে তোলার ডাক দেয়। সেই উদ্দেশ্যে ১২ সদস্যের একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়। রাম জন্ম ভূমির আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাননীয় মহন্ত নৃত্য গোপাল দাস এই ট্রাস্টের অধ্যক্ষ ছিলেন। সাথে রয়েছেন চম্পক রায়-এর মতো সদস্য যিনি ৪০ বছর ধরে নিরলসভাবে এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি এই ট্রাস্টের মহামন্ত্রী পদে অভিষিক্ত। এর পাশাপাশি নবীন প্রবীণ অনেক সদস্য যারা তাদের জীবনের মূল্যবান সময়ের প্রায় সবটাই এই লড়াইয়েই দিয়ে দিয়েছে। গত বছরের ৫ই আগষ্ট শ্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিতে ভূমিপূজা দিয়ে শুরু হয় মন্দির নির্মাণের কাজ। সুপ্রীমকোর্টের নির্দেশে তৈরি হওয়া এই ট্রাস্টের উদ্দেশ্য দেশের সব স্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে গড়ে উঠুক এই মন্দির। এইজন্য তারা ১০টাকা থেকে শুরু করে ১০০০টাকা পর্যন্ত কুপনের ব্যবস্থা করেছেন। তবে এই প্রকল্পে সরসংঘ বা ট্রাস্টের সদস্যরা টাকা অপেক্ষা মানুষের স্বেচ্ছায় যোগদানকে বেশী গুরুত্বপূর্ন বলে মনে করছেন। কারন রামমন্দির শুধু একটা সামান্য মন্দির নয় এটা হলো রাষ্ট্রের মন্দির। মানুষের মনের প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের আদর্শ, আস্থা দিয়ে মন্দির বানাতে হবে যা সমাজের জন্য একান্ত আবশ্যক। তাই অর্থ অপেক্ষা জনজাগরণ জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ। জয় শ্রী রাম।
শ্রী প্রদীপ জোশী