মাত্র আধ ঘণ্টার তফাতে দু’জনের দু’টি মন্তব্য। কিন্তু সেটাই আগামী দিনের রাজনীতির জন্য তুমুল বিতর্কের ইন্ধন দিয়ে গেল।
শনিবাসরীয় সন্ধ্যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন দলের ভোট বিপর্যয় সম্পর্কে সাংবাদিক বৈঠক করছিলেন, তখন দিল্লিতে সংসদের সেন্ট্রাল হলে নরেন্দ্র মোদীকে ঘিরে ভোট সাফল্যের উদযাপন চলছিল বিজেপি তথা এনডিএ-র। মমতা অভিযোগের সুরে বলেন, “বাংলার ভোটে এ বার টোটাল হিন্দু-মুসলমান হয়েছে”। তার পর পরই সাংবাদিকদের বলেন, “৩১ তারিখ আমাদের ইফতার আছে। আপনারা আসবেন। আমি যাব। হ্যাঁ আমি তো মুসলিম তোষণ করি। যে গরু দুধ দেয় তার লাথও খাব”। পর্যবেক্ষকদের অধিকাংশের মতে, সংখ্যালঘু ভোটই যে হেতু এ বার তৃণমূলের ত্রাতা হয়েছে, তাই তাঁদের প্রতি এ ভাবেই কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন মমতা।
এর কিছুক্ষণ পরই এনডিএ-র সংসদীয় দলের বৈঠকে বক্তৃতা দেন নরেন্দ্র মোদী। বলেন, “গত পাঁচ বছরের মেয়াদে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের উন্নয়নের জন্য কাজ করেছি। আমাদের স্লোগান ছিল, সবকা সাথ-সবকা বিকাশ। এ বার সবার বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের জন্যও কাজ করব”। তিনি বলেন, “যে ভাবে গরিবদের বোকা বানানো হয়েছে, সংখ্যালঘুদেরও এতোদিন সে ভাবেই ঠকানো হয়েছে। ওদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রতি যদি নজর দেওয়া হত তা হলে ভাল হতো। কিন্তু তা না করে স্রেফ ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতির জন্য সংখ্যালঘুদের ভয় দেখিয়ে রাখা হয়েছে”।
এনডিএ-র সাংসদদের উদ্দেশে মোদী পরামর্শ দেন, ২০১৯ সালে তাঁদের লক্ষ্যই হবে এই লোক ঠকানোর খেলা রুখে দেওয়া। এ ব্যাপারে সবার চোখ খুলে দেওয়া এবং গরিব ও সংখ্যালঘুদের আস্থা অর্জন করা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, মোদী-মমতার এই দুই মন্তব্যের মধ্যে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক লড়াইয়ের বৃহৎ ছবিটার ইঙ্গিত রয়েছে। বাংলায় ধর্মীয় মেরুকরণের পরিবেশ এখন ষোলো আনা। উনিশের ভোটই দেখিয়ে দিয়েছে যে, সংখ্যালঘু ভোটের তাকতেই মূলত অধিকাংশ আসনে জিতেছে তৃণমূল। সংখ্যাগুরুর ভোটে জিতেছে বিজেপি। ফলে মমতা চাইবেন, সংখ্যালঘুদের মধ্যে তাঁর এই জনভিত্তিটা আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখতে। তাই অকপটে স্বীকার করেছেন, যে গরু দুধ দেয় তার লাথি খেতেও তৃণমূল প্রস্তুত।
আবার মোদীর লক্ষ্য আরও বড়। তিনি কেন, গোটা দুনিয়া জানে কংগ্রেস ও তথাকথিত আঞ্চলিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির মূল ভোট ব্যাঙ্ক হল গরিব ও সংখ্যালঘুরা। জওহরলাল নেহরুর সময় থেকেই সামাজিক অধিকার ও সুরক্ষার প্রশ্নে গরিবদের বরাবর গুরুত্ব দিয়েছে কংগ্রেস। সংখ্যালঘুরা জাতীয় রাজনীতিতে সব সময়েই কংগ্রেসে আস্থা রেখেছে। এবং তাদের কাছে ধারণা গোড়া থেকেই ছিল যে জনসংঘ ও বিজেপি হিন্দুদেরই দল। গুজরাত দাঙ্গার পর বিজেপি-র প্রতি অধিকাংশ সংখ্যালঘুর শ্রদ্ধা প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু মোদী দেখছেন, কংগ্রেস ও আঞ্চলিক ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির এই ভোট ব্যাঙ্কে ফাটল ধরাতে পারলে আগামী দিনে বিজেপি আরও শক্তিশালী হবে। ফলে মনে করা যেতেই পারে যে, আগামী পাঁচ বছরে সংখ্যালঘুদের আস্থা অর্জনে তৎপর হবে মোদী সরকার।