না। তার কোনও শার্লক হোমসকে ডাকার প্রয়োজন পড়ে না। ব্যোমকেশ বক্সী, ফেলুদা, কাকাবাবু, গার্গী, নিদেনপক্ষে ডাঃ বাসু কিংবা কিরীটি রায়কেও নয়। কারণ তিনি গন্ধ শুকে বলে দিতে পারেন, অপরাধের চরিত্র কেমন! কেই-ই বা অপরাধী! মুখ্যমন্ত্রী পদে বসার দিন। কয়েকের মধ্যেই যেমনটি বলেছিলেন পার্কস্ট্রিটে সুজেটনান্নী তরুণীর ধর্ষণের ঘটনায়—এরকম কিছুই ঘটেনি। খদ্দেরদের সঙ্গে ঝামেলা। যেমনটি কামদুনীর ‘নির্ভয়া’ ধর্ষণের পর বলেছিলেন—“সব মিথ্যা, সব সাজানো।কখনও বলেছেন— ‘বাচ্চা ছেলেরা করে ফেলেছে। কামদুনীর দুই গ্রামীণ মহিলা, মেদিনীপুরের এক নিতান্ত সাদামাটা পুরষ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণী ছাত্রীকে নির্দ্বিধায় সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন “মাওবাদী’ বলে। সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। এবারও তাই কয়েক মিনিটের জন্য বিদ্যাসাগর কলেজে ঢুকে বলে দিলেন — ‘বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে। বিজেপি। বাঙ্গলার ইতিহাস, বাঙ্গলার সংস্কৃতিকে কলুষিত করেছে।
আমাদের মুখ্যমন্ত্রী, মহান নেত্রী, সততার প্রতিমূর্তি, সদা সত্য কথা বলিবার মতো মহিলা-যুধিষ্ঠির মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কী অপার শক্তি! কী দৈব মহিমা! কী ধুরন্দর গোয়েন্দাসম অন্তর্ভেদী দৃষ্টি।
তা বেশ! কিন্তু গত ১৪ মে বিদ্যাসাগর কলেজে বিদ্যাসাগরের মূর্তি টুকরো টুকরো করার পর থেকেই জনগণের যেসব প্রশ্নের ঝড় সোশ্যাল মিডিয়ায় আছড়ে পড়ছে, বাসে ট্রামে। অবিরাম চলেছে প্রশ্নের তির, সন্দেহের ঘনঘটা মাকড়সার জালের মতো জড়িয়ে ধরছে মুখ্যমন্ত্রীর গোয়েন্দাগিরিকে, তার কোনও জবাব মিলছে না। যেমন—
প্রথমত, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহর রোড শো ছিল পূর্বঘোষিত এবং অনুমোদিত। কিন্তু রাতের অন্ধকারে তার রোড শো-র নির্দিষ্ট পথের দু-পাশ থেকে কেন খুলে দেওয়া হলো সব ফ্লেক্স, সব হোর্ডিং? কারা খুলল? গোয়েন্দা মুখ্যমন্ত্রী নির্বাক !
দ্বিতীয়ত, লক্ষ মানুষের উৎসাহ ও উদ্দীপনায় টগবগ করে ফোটা রোড শো যখন উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা, তখন কেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল প্রবেশপথে তৃণমূল কর্মীদের কালো পতাকা দেখানোর অনুমতি দেওয়া হলো ? কেনই বা মূল প্রবেশপথের প্রাচীর সম দরজা হাট করে খুলে রাখা হলো? কেনই বা এক কর্মীকে দেখা গেল কোমরে হাত দিয়ে ‘ডোন্ট কেয়ার’ বডি ল্যাঙ্গুয়েজের প্রদর্শন করতে ? কালো পতাকাধারীদের তো চিরকালই দূরে রাখাটাই নিয়ম।
তৃতীয়ত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরেই ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের গেট। প্রেসিডেন্সি যা মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় শহুরে মাওবাদীদের আখড়া সেখানে কেউ কালো পতাকা দেখাল না। একটা ছাত্র বা ছাত্রীকেও দেখা গেল না স্লোগান দিতে। আশ্চর্য লাগছে না? মুখ্যমন্ত্রী নির্বাক !!
চতুর্থত, ঝামেলার শুরু বিদ্যাসাগর কলেজে সামনে দিয়ে ঢাক-ঢোল শঙ্খধ্বনিতে মাতোয়ারা রোড শো বেশ কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর পরই। আচমকাই মিছিলের ওপর শিলাবৃষ্টির মতো শুরু হলো ইটবৃষ্টি। ফটাফট ফাটল চারটি মাথা। হৈ হৈ ব্যাপার। রৈ রৈ কাণ্ড! সময়টা তো ‘ঠিক দুকুরবেলা ছিল না যে ভুতে ঢিল মারবে! কে মারল? কারা ছিল বিদ্যাসাগর কলেজের দোতলায়, তিনতলায় কিংবা ছাদে? মুখ্যমন্ত্রী নির্বাক! ইট মারলে পাটকেল খেতে হবে। কেউ তো রসগোল্লা ছুঁড়বে না! স্বাভাবিকভাবে প্রতি আক্রমণ হয়েছে। ভিডিয়োতে স্পষ্ট, রাস্তায় তখন বড়ো জোর গোটা ১০/১২ যুবক। কেউ ভিতরে ঢোকেনি। তৃণমূল বলছে, ভিতরে তখন ক্লাস চলছিল। তা বেশ! তাহলে অন্তত শ’ দুই-তিন ছাত্র-ছাত্রী তো ছিল ভিতরে। দশ-বারোটা ছেলে গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকল। বিদ্যাসাগরের মূর্তি কাচের বাক্স না ভেঙে বের করে বাইরে এনে আছাড় মেরে টুকরো টুকরো করে দিল। আর ছাত্র-ছাত্রীরা ভিতরে বসে তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল। অস্বাভাবিক লাগছে না? মুখ্যমন্ত্রী নির্বাক।
মনস্তত্ত্ব বলে, রাগের মাথায় কেউ যদি কিছু ভাঙে তো সে সেটা তৎক্ষণাৎ সেখানে দাঁড়িয়েই ভাঙবে। ঘাড়ে করে বাইরে বয়ে এনে লোকসমক্ষে ভাঙবে না। বিদ্যাসাগর কলেজে কিন্তু ঘটেছে উল্টোটাই। কাচের বাক্স ভাঙেনি। মূর্তি ভাঙা হয়েছে বাইরে এনে। মুখ্যমন্ত্রী কি গন্ধটা ঠিকমতো পাচ্ছেন না?
অত বড়ো রোড শো। পুলিশ কোথায় ? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন নিষ্কর্মা পুলিশ ছাড়া গোটা রাস্তায় পুলিশ ছিল না। বিদ্যাসাগর কলেজের সামনে তো নয়ই। কেন? পরিকল্পিত? মুখ্যমন্ত্রী স্পিকটি নট!
সরকার যে ভিডিয়ো দেখাচ্ছে না, তাতে দেখা যাচ্ছে মূর্তি ভাঙছে ব্লু শার্ট পরা এক যুবক আর হলুদ পঞ্জাবি পরা এক যুবক। কিছুক্ষণ পরে মুখ্যমন্ত্রী যখন সদলে তদন্তে এলেন বিদ্যাসাগর কলেজে, তখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওই দুই যুবককে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে। কেন? কারা ওরা? মুখ্যমন্ত্রীর ঠোটে তর্জনী!
রীতিমতো সাজানো চিত্রনাট্যের মতোই মুখ্যমন্ত্রীর পাশে এসে দাঁড়াল এক ছাত্রী। তার মাথায় একটা ব্যান্ডেজ। কিন্তু ক্ষতস্থানের ওপর জড়ানো ব্যান্ডেজের রক্তটা তো রক্তের রঙের নয়। বরং বেশি মিল আলতার সঙ্গে। কেন? তাছাড়া অতখানি রক্ত ছড়িয়ে পড়েছে ব্যান্ডেজে অথচ মেয়েটির চোখ মুখ ফোলেনি। কোনও উদ্বেগের চিহ্নও নেই। ব্যাপারটা কী? ছাত্রটি এল। ডান হাতে জড়ানো একটা নতুন স্লিং। কতক্ষণ আগে কেনা ? কলেজ স্ট্রিটের কোনো দোকান থেকে ? বিলটা আছে নিশ্চয়ই! মুখ্যমন্ত্রীর জবাব নেই!
অভিষেক শর্মা নামক ‘ধর্ষক’ হিসেবে ইতিমধ্যেই সাজাপ্রাপ্ত এক স্থূলদেহী ভদ্রলোক (ছাত্র নয় নিঃসন্দেহে)-কে দেখা গেল টিভি চ্যানেলগুলিকে বাইট দিতে। কোন বিষয়ে কোন বর্ষের ছাত্র উনি? যদি ছাত্র না হন, তাহলে কী করছিলেন ওখানে?মুখ্যমন্ত্রীর কানে তুলো, মুখে মূলো। কোনোভাবেই জবাব দেন না সেই মহার্ঘ প্রশ্নটির-ম্যাডাম, একটু বলবেন, কেন বন্ধ করে রাখা ছিল কলেজের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা? আর সেদিন দুপুরে কলেজে ইউনিয়ন রুমের সভায় ঠিক কী কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল আপনার নির্দেশ মতো?
বাইরে মিছিলে যে অংশগ্রহণকারীদের মাথা ফাটল, তারা হিন্দিভাষী। সম্ভবত অন্য এলাকার তরুণ এরা। এরা বিদ্যাসাগর কলেজ চেনেন? বিদ্যাসাগরকে চেনেন ? তাহলে এরা মূর্তি ভাঙবেন কেন? মুখ্যমন্ত্রীর মুখে ভাষা নেই।
গত কদিন ধরেই ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ‘যুবরাজ’ প্রার্থীর নির্দেশে চলেছে হিন্দু বিতাড়ন। গ্রামের বাতাস কান্নায়, আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে। সংবাদমাধ্যমগুলিতে কোনও খবর নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেয়ে যাচ্ছে ভিডিয়ো। তাহলে কি বিদ্যাসাগরকে নিয়ে মাতামাতি আসলে মানুষের চোখ ডায়মন্ডহারবারের দিক থেকে অন্যদিকে ঘোরাতেই ? যাতে হিন্দু বিতাড়নের ঘটনা কোনওভাবেই রাজ্যে হৈ চৈ ফেলতে না পারে? বাঃ! চমৎকার মুখ্যমন্ত্রী! লা জবাব!
এই মূহুর্তে রাজ্যজুড়ে তৃণমূলী কর্মীবাহিনী, তৃণমুলি বুদ্ধিজীবীরা তৃণমূলি আমলাবাহিনী, তৃণমূলি পুলিশবাহিনী তৃণমূলি স্বৈরতান্ত্রিক নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কুমিরের কান্না কদচ্ছেন। বিদ্যাসাগরের ভাঙামূর্তিকে জড়িয়ে ধরে। অপদার্থ শিক্ষামন্ত্রী যিনি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্রম থেকে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়কে হঠিয়ে দিয়ে যিনি প্রথম শ্রেণীর বইতে ঢোকায় শরৎকালে চারিদিকে দুর্গাপুজো আর ঈদের খুশি’, দ্বিতীয় শ্রেণীর বইতে আমার মায়ের ছবিতে দেখানো হয় এক মুসলিম রীতিতে সাজানো মহিলার সাজ, পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে লেখাহয়, বাঙ্গালির সবচেয়ে বড়ো উৎসব দুর্গাপুজো আর ঈদ’, ষষ্ঠ শ্রেণীর বইতে পত্ররচনার নমুনা হিসেবে ছাপা হয় মুসলমান রীতিতে লেখা পত্র, অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে অদ্ভুত আতিথেয়তার নজির হিসেবে আরবি চরিত্রকে তুলে ধরা হয়, তারই লেজ ধরে গোবধে মাতোয়ারা অবোধ সুবোধের মতো কবিরা ‘বিদ্যাসাগর’কে নিয়ে নতুন রম্যরচনা সৃষ্টিকরেন কলকাতার পথসভায়। আর মুখ্যমন্ত্রী মুখে কুলুপ। এঁটে শুধু মোদীকে গালাগাল দেন। যেমন যুক্তিহীন ভাষায় বিকৃতমস্তিষ্কের মতো চীৎকার করেন— ‘অযোধ্যা পাহাড়, শুশুনিয়া পাহাড়, জয়চণ্ডী পাহাড়, দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির, তারাপীঠের কালী মন্দির, পাথরচাপড়ি, ঈদগাহ সব গড়ে দিয়েছি’, তেমনি গোয়েন্দা গিন্নির মতো লজিক বিহীন রক্তচক্ষু দেখিয়ে সব বিষয়েই পণ্ডিতিমতামত দিয়ে দেন সবজান্তা মুখ্যমন্ত্রী সেইমমতা ব্যানার্জি যিনি গণতন্ত্রের মন্দির রাজ্য বিধানসভার অ্যান্টিক আসবাবপত্রগুলি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভাঙিয়েছিলেন দলের ‘সুবোধ বালক’দের দিয়ে। রীতিমতো ধ্বংসলীলা চালিয়ে দিলেন এভারেস্ট-সম নির্লজ্জতার নজির রেখে। সেদিন তার ভয়ংকর রূপ কোনও অংশে ধ্বংসের প্রতীক নাদির শাহর চেয়ে কম কিছু ছিল না।
আজ যখন পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে চলছে ধ্বংসের রাজনীতি, লুট-রাহাজানির রাজনীতি, আজ যখন মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্য সমাবেশে বাড়ির লক্ষ্মীশ্রী গৃহবধূদের পরকীয়া করতে উপদেশ দিচ্ছেন, আজ যখন পশ্চিমবঙ্গের বুক থেকে হিন্দু ঐতিহ্য, হিন্দু সনাতনী ধারাকে চিরতরে মুছে দেবার জন্য ঘৃণ্য চক্রান্তের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী, যখন রাতদিন মিথ্যার পাহাড় গড়ে জনসমাবেশেদাঁড়িয়ে তাকে বারবার বলা হচ্ছে— আমি মিথ্যা কথা বলি না, আমি চোর নই, আমি হত্যাকারী নই’ এখন তিনি যতই চিৎকার করুন বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে বিজেপি–মানুষ তা বিশ্বাস করছে না। নাক থেকে নস্যির গুঁড়ো ঝেড়ে ফেলার মতোই ঘৃণার সঙ্গে ঝেড়ে ফেলেছে মুখ্যমন্ত্রীর অবান্তর গোয়েন্দা তত্ত্ব। কারণ মানুষ জানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঙ্গলার মনীষী-প্রীতি সীমাবদ্ধ কয়েকটি মেট্রো স্টেশনের নামকরণের মধ্যেই। শুধু রাজনৈতিক মঞ্চে কৃতিত্ব নেবার জন্যই মনীষীদের জীবন, কর্ম ও অবদান সম্পর্কে একজন ভালো মেধা স্কুল ছাত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াবার ক্ষমতাও তার নেই— তাও জানে বাঙ্গলার মানুষ। বাঙ্গলার ট্রাফিক সিগন্যালে রবীন্দ্রসংগীত বাজিয়ে তিনি বাঙ্গলার সংস্কৃতির কোনো উন্নয়ন ঘটাননি। বরং বাঙ্গলার সুস্থ সংস্কৃতিকে রাজপথের ধুলোয় টেনে এনেছেন। যেমনভাবে নিজের কর্মীবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তিকে গুড়িয়ে দিয়েছেন রাজপথে ফেলে। বাঙ্গলার সংস্কৃতি আজ অপমানিত, ধর্ষিতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এর জবাব দিতে হবে। দিতেই হবে। আজ না হয় কাল। কাল না হয় পরশু। পালিয়ে গিয়ে নিজেকে বাঁচাতে পারবেন না। বাঙ্গলার মানুষ প্রতিশোধ নেবেই। পরিবর্তনের মাধ্যমে। বদলের মাধ্যমে। সেদিন এসব প্রশ্নের জবাব মানুষকেইদিতেই হবে আপনাকে। এটাই হবে আপনার শেষ বিচার।
সনাতন রায়
2019-05-24