বইটির নাম “পূর্ণানন্দে পুণ্যানন্দ”। প্রকাশ করেছে খড়দহ সংস্কৃতি অঙ্গন। প্রকাশ কাল ১৫ জানুয়ারি, ২০১৮। কিন্তু সম্পাদক কে? সে সম্পর্কে একেবারেই নীরব বইটি। সম্পাদক কী সংস্কৃতি অঙ্গনের সম্পাদক নিজেই? নাকি অঙ্গনের সভাপতি ও সম্পাদক মিলে বইটির যৌথ সম্পাদক? উত্তর পাবার উপায় নেই এখন, যদি না পরবর্তী প্রকাশের সময় তা সংশোধন করে নেন তারা। সম্পাদক/সম্পাদক মণ্ডলীর উপস্থিতি ব্যতিরেকে এমন আঞ্চলিক ইতিহাসের বই সাধারণত দেখা যায় না। লেখকদের পরিচিতও দেওয়া হয় নি।
বইটি সম্পর্কে সবচেয়ে বড় অভিযোগ বইয়ের ভূমিকায় প্রথম পাতার সূত্রে। সেখানে খড়দহ সংস্কৃতি অঙ্গনের সভাপতি তথা তদানীন্তন খড়দহের পুরপ্রধান তাপস পালের মন্তব্য। তিনি রহড়া বালকাশ্রমের প্রথম কর্মসচিব স্বামী পুণ্যানন্দ সম্পর্কে লিখেছেন, “১৯৬৪ সালের রহড়ার উত্তাল পরিবেশ। দাঙ্গা পরিস্থিতি। তিনি নিজে মঠ-মিশনের কর্মকর্তাদের তোয়াক্কা না করে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন ।” এটা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের একজন প্রবীণ পুণ্যশ্লোক সন্যাসীর সম্পর্কে উপযুক্ত কথা নয়। তাঁকে ‘সাংগঠনিক অবাধ্য’ প্রমাণ করা হয়েছে বলে, অনেকে ব্যাখ্যা করেছেন। একটা বড় অভিযোগ করে বসেছেন তৃণমূলের প্রাক্তন পুরপ্রধান। এইরকমভাবে তাঁকে উপস্থাপনার প্রয়োজন ছিল না মনে করেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বহু সাধু এবং আশ্রমিক। প্রথম পাতায় এই মন্তব্যটি দেখার পর অনেকেই বইটির পরবর্তী পাতাগুলি আর খোলেন নি। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, এই নিয়ে।
অথচ ওই বইটির মধ্যে মূল লেখাটি যার (দ্বিতীয় প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ১১-৩০), বালকাশ্রমের প্রাক্তন আশ্রমিক কল্যাণ চক্রবর্তীর লেখা থেকে পাওয়া যায় (পৃষ্ঠা ১৬), “স্বামী পুণ্যানন্দের সঙ্গে মঠ ও মিশনের বহু প্রাচীন সাধুর গভীর যোগাযোগ ছিল। অনেকের কাছে তিনি ছোটো ভাই, অনেকের আধ্যাত্মিক বন্ধু, অনেকের স্নেহভাজন অনুজ।” ১৯ পৃষ্ঠায় কল্যাণ বাবু আরও লিখছেন, “মঠ ও মিশনের প্রায় সকল সঙ্ঘগুরু বালকাশ্রম পরিদর্শন করেছেন। স্বামী পুণ্যানন্দ সকলকে গভীর শ্রদ্ধা ভক্তি প্রদর্শন করে অভ্যর্থনা করেছিলেন। যেমন স্বামী শঙ্করানন্দ, স্বামী মাধবানন্দ, স্বামী বিরেশ্বরানন্দ প্রমুখ।… স্বামীজি তাঁদের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এছাড়াও মঠ মিশনের বহু পদাধিকারী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রহড়ায় এসেছেন। বালকাশ্রমে পালিত বাৎসরিক রামকৃষ্ণ, সারদা-বিবেকানন্দের জন্মোৎসবে বেলুড় মঠের সাধু ব্রহ্মচারীরা আসতেন। একদিন বরাদ্দ থাকত ‘সাধু ভাণ্ডারা’ দিবস উপলক্ষে।” কল্যাণ বাবুই স্বামী পুণ্যানন্দ সম্পর্কে সঠিক তথ্যটি পরিবেশন করে বইটির ভারসাম্য রচনা করে দিয়েছেন। রহড়া বালকাশ্রমের অনেক অজানা ইতিহাস কল্যাণ বাবু নানান সময়ে উপস্থাপন করে থাকেন এবং পুরোটাই ইতিহাস আশ্রিত ও রচনা সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। ফলে স্বামী পুণ্যানন্দজীকে নিয়ে কল্যাণ চক্রবর্তীর লেখাকে বিশেষ মান্যতা দেয় খড়দহ-রহড়ার মানুষ।
কাজেই তৎকালীন খড়দহের পুরপ্রধান অপাংক্তেয় কথা লিখে বইটির সৌকর্য বিনষ্ট করেছিলেন এবং স্বামী পুণ্যানন্দকে সঠিকভাবে বর্ণনা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পুণ্যানন্দকে স্তবের আড়ালে তিনি আগামী প্রজন্মের কাছে ভুল বার্তা পাঠিয়েছেন। মঠ মিশনের কর্মকর্তাদের তোয়াক্কা না করার কথাটা সত্য নয়। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধাচরণের ইমেজে স্বামী পুণ্যানন্দকে ধরা এক রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা কী? খড়দহের তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা তাপস পালকে নিয়ে তাই হাজারো প্রশ্ন উঠছে। তিনি প্রবন্ধের শেষে লেখেন, “এরকম হিন্দু সন্যাসীরই আজ দেশে বেশি করে প্রয়োজন।” রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন নিয়ে অযথা বিতর্কিত মন্তব্য পরিহার করা উচিত। এমন মত প্রকাশ করেছেন অনেকে।