তুমি চলো ডালে ডালে

ডাল প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী শস্য হলেও সবুজ বিপ্লবে ধান-গমের মত একই গুরুত্ব পায়নি। সেটা স্বাভাবিক, কেননা নিরন্ন ভারতবাসীর হাহাকার প্রধানত ছিল ভাত-রুটির। স্বাধীনতার পর একটা নতুন দেশ ঘুম ভেঙে জেগে উঠছে, তার সামান্য ভাত-রুটির সংস্থান তো আগে করা দরকার।

একজন ভারতীয়ের দৈনিক পুষ্টির প্রয়োজন মেটাতে তার কার্বোহাইড্রেট-প্রোটিন-ফ্যাটের চাহিদা ও তা কোন কোন স্থানীয় খাদ্য দিয়ে পূরণ করা যায়, সে নিয়ে সেই আমলে ভারতীয় গবেষণাগারগুলোতে ভালো গবেষণা হয়েছিল। নিরামিষাশী ভারতবাসীর প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে দুধ ও ডালের প্রয়োজনীয়তা অনেকেই উপলব্ধি করেছিলেন এবং তার ভিত্তিতেই ভার্গিজ কুরিয়েনের নেতৃত্বে শুরু হয় আমূলের মতো কো-অপারেটিভ শ্বেত বিপ্লব। দুর্ভাগ্যক্রমে ডাল নিয়ে সে রকম উঠেপড়ে লাগা হয়নি। সয়াবিনের গুরুত্ব উপলব্ধি করা গেছে অনেক পরে।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিট্যুট অভ সায়েন্সে ডালের প্রোটিন ও তার অ্যামাইনো অ্যাসিড শৃঙ্খলের গঠন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছিলেন প্রফেসর গোপালসমুদ্রম নারায়ণন রামচন্দ্রন। স্টার্চের মত প্রোটিনের বিপাকও নির্ভর করে তার অণুগুলো কতটা গুটিয়ে থাকে বা খুলে যেতে পারে, যার পরিমাপ করতে গিয়ে রামচন্দ্রন আবিষ্কার করলেন এই পলিমারগুলো খোলা এবং লম্বা হবে না গোটানো হবে, তা নির্ভর করে তার মধ্যের অ্যামাইনো অ্যাসিডের সাইড চেইনের গঠনের ওপর। এর ভিত্তিতেই তিনি প্রকাশ করলেন এক সাধারণ প্লট, যাকে বলা হয় রামচন্দ্রন প্লট। প্রোটিন বায়োকেমিস্ট্রিতে এই রামচন্দ্রন প্লট খুব গুরুত্বপূর্ণ, যার জন্যে তাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের মনোনয়নও পেয়েছিল।

সে যাই হোক, উচ্চ ফলনশীল বীজ, সেচের জল, সার ও কীটনাশক ইত্যাদিতে গুরুত্ব দেওয়ায় ধান-গমের ফলন বেড়ে যেতে ডাল নিয়ে বেশি মাথা ঘামানো হয়নি। দেশের জনসংখ্যা যত বেড়েছে, ধীরে ধীরে দারিদ্র্যও কমেছে। অনাহারে মরে যাওয়ার ঘটনা এখন কদাচিৎ ঘটে। আর্থিক অবস্থা উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শুধু ভাতে চাহিদা মেটে না, তার সঙ্গে তার ডালও চাই। দাল-চাওল শুনতেই সামান্য, চালের সঙ্গে প্রয়োজনমত ডাল আমাদের দেশে উৎপন্ন হয় না। মোট যা শস্য উৎপাদন হয়, তার মাত্র আট শতাংশ হচ্ছে ডাল।

এর জন্যে দরকার চাষিদের ডাল চাষে উৎসাহী করা, প্রয়োজনে বাধ্য করা। কিন্তু সরকার গত বিশ বছর ধরে সহজতর পদ্ধতি নিয়েছে – ইমপোর্ট। পাশেই আমাদের ব্রহ্মদেশ যার বর্তমান নাম মায়ানমার, সেখানে ভালো ডাল চাষ হয়, সেখান থেকে কিছু। আর এক দেশ, যেটা অত কাছে নয়, সেখান থেকে বাকিটা।

কোন সেই দেশ? কানাডা। হোয়াই কানাডা? সেটা বেশ চিত্তাকর্ষক গল্প। কিছুদিন আগে খবরের কাগজে নিশ্চয় লক্ষ করে থাকবেন, ভারতীয় সরকার কেন চাষিদের ভর্তুকি দিচ্ছে, এই ভর্তুকি আন্তর্জাতিক ট্রেড রেগুলেশনের (ভারত যার স্বাক্ষরকারী দেশ) বিরুদ্ধে, ইত্যাদি নিয়ে কানাডা সরকার বেশ শোরগোল তুলেছিল। ভারতের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কানাডা সরকারের কেন মাথাব্যথা, তা নিয়ে আপনি নিশ্চয় কৌতূহলী হয়েছিলেন। আফটার অল, কানাডা তো আমেরিকার মতো দাদাগিরি করে না!

তার একটা কারণ হচ্ছে ডাল। ভারতের ডাল দরকার বলে কানাডার বিস্তীর্ণ জমিতে ডাল চাষ হচ্ছে। কানাডার জনসংখ্যার এক বড়সড় অংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূত, প্রধানত পাঞ্জাবি, কানাডা সরকারেও তাদের প্রভাব আছে। তারা বেশ ভালোরকম ইনভেস্ট করে কানাডায় ডালচাষ করছে। কয়েক বছর আগে কানাডার ডালচাষকে সেখানে ইয়েলো রেভলিউশন বলে অভিহিত করা হচ্ছিল।

এই ডাল কীভাবে ভারতে আসে? প্রাইভেট পার্টির মাধ্যমে। পাঞ্জাবের যে দরিদ্র চাষিরা বিপ্লব করছে, তাদের এক অংশ এই ডাল আমদানির সঙ্গেও যুক্ত। তারা দাবি করে ভারতে গুরদোয়ারার লঙ্গরে খিচুড়ি রান্নার প্রয়োজনে তারা এই আমদানি করে, কিন্তু আসল ব্যাপার অন্য। ডালের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে এদের হোর্ডিং-ও একটা ফ্যাক্টর। টাকা-পয়সার কোনো রং হয় না। সুযোগ পেলে তাকে কাজে লাগাতে হয়। এই সুযোগ তারা পেয়েছিল ইউ পি এ সরকারের আমলে। সে রকমই চলে আসছে।

এখন এই ‘আত্মনির্ভর ভারত’ নামক স্লোগান শুনতে যেমনই হোক, কাজে হয়ত তেমন কিছু হচ্ছে না, কিন্তু সরকার বলছে, নো মোর আমদানি, ডাল চাষ করো। কানাডার প্রভাবশালী পাঞ্জাবি কমিউনিটির ইনভেস্টমেন্ট এর ফলে কিছুটা বেকায়দায়। সুতরাং তারা আন্দোলন করছে, তাদের সরকারও চ্যাঁচাচ্ছে।

কত টাকার আমদানি? নীচে চার্ট দেওয়া থাকল, দেখে নিন। এক বিলিয়ন মানে একশো কোটি। ২০১৭ সালে সাড়ে আঠাশ হাজার কোটি টাকার ডাল আমদানি হয়েছিল। তারপর থেকেই আমদানি নিম্নমুখী। কাজেই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

✍ অমিতাভ প্রামাণিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.