চতুর্থ অঙ্ক
সীতাবেঙ্গরা সম্বন্ধে একটি প্রবাদ আছে যে , সীতাদেবী এখানে বাস করতেন। সীতাবেঙ্গরা গুহা ভিতরের দিকে ছয় ফুট উঁচু। মাঝে মাঝে ছয় ফুটেরও কম। গুহার একেবারে ভিতরে দেয়ালের চারিপাশে উঁচু বেদি দিয়ে ঘেরা। একটি বড় নালি ওই বেদির নিম্ন দিয়ে দেয়ালের দিকে চলে গেছে। মেঝের উপর কতকগুলি গর্ত বেশ যত্ন সহকারে কেটে প্রস্তুত করা হয়েছে। গুহার ভিতরে প্রবেশের পথ ১৭ ফুট চওড়া। গুহাটি সর্ব্বসমেত ৪৪১ ফুট। মধ্যভাগে ১২ ফুট ১০ ইঞ্চি চওড়া। আর প্রায় ৬ ফুট উঁচু। চারিদিকের দেওয়াল কেটে প্রস্তুত করা । দেয়ালের চারিদিকে পাথর কাটা উঁচু মঞ্চাসন। তিনদিকে দুই সারি মঞ্চাসন। ভিতরের বাইরের অংশের থেকে দু ইঞ্চি উচ্চ। যে দিকটার সম্মুখ প্রবেশ পথের দিকে, দুই সারি মঞ্চ । সেই স্থানের উচ্চতা ৮ ফুট ৬ ইঞ্চি চওড়া। প্রবেশ পথের পশ্চাদভাগের মঞ্চাসনগুলি অপেক্ষাকৃত নিচু। প্রাচীরের দিকে ছোট পাথর কাটা মঞ্চাসন আছে।
ব্লথ বলেন এই ক্ষুদ্র পাথরকাটা ডিম্বাকার নাট্যশালার সম্মুখে রঙ্গপীঠ স্থাপনের জন্য প্রচুর স্থান আছে। আর মঞ্চাসনগুলিতেও পঞ্চাশ ষাট জন দর্শকের বসবার জায়গা। অভ্যন্তর দেশ ৪৬ ফুট লম্বা ও ২৪ ফুট চওড়া একটি আয়ত চতুরাস্রাকৃতি বিশিষ্ট স্থান। তিনদিকে পাথর কাটা সুপ্রশস্ত বসবার জায়গা। সম্মুখভাগ কয়েক ইঞ্চি মাত্র নিচু করে আসনগুলি চাতালের আকৃতিবিশিষ্ট করা হয়েছে। প্রবেশ পথের নিকটস্থ ভূমি আসনের কোণের ভূমির চেয়ে কিছু নিচু।
১৯০৩- ৪ সালের Arch. Servey – Annual Report – এ ব্লথ সাহেব রামগড় নাট্যশালার সচিত্র বিবরণ দিয়েছেন। ব্লথ ১৯০৪ সালের ৩০ শে এপ্রিল তারিখে রামগড়ের রঙ্গালয় সম্বন্ধে একখানি পত্র E.Windish- কে লেখেন। এতে তিনি ভারতীয় নাট্যশালার উপর গ্রীক প্রভাব প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন। সেই পত্রখানি Zeischrift der Dentschen Morgenlandischen Gesellschaft নামক প্রসিদ্ধ জার্মান পত্রে প্রকাশিত হয়। Windish নানা যুক্তি সহকারে দেখাতে চেষ্টা করেন যে ভারতীয় নাট্যশালার উৎপত্তি গ্রীক আদর্শ হতে । কিন্তু তার যুক্তিতে আদৌ কোন সারবত্তা ছিল না । কেন ? সেই কথাও তাহলে কিছু বলতেএ হয়।
প্রাচীন গ্রীস ও রোমের দুটি সাধারণ স্থান বড় প্রিয় ছিল – একটি মন্দির, অপরটি নাট্যশালা। এই দুই স্থানে গ্রীক ও রোমানদের দুই রকম ক্ষুদা মিটত। প্রাচীন গ্রীক নাট্যশালার দুটি ভাগ ছিল। একটি Orchestra , অপরটি Theatron বা থিয়েটার। নাট্যশালা নির্মাণের জন্য প্রায়ই পাহাড়ের ঢালু জায়গা পছন্দ করা হতো। দর্শকদের বসবার আসন পাহাড় কেটে তৈরি করা হতো। আসনগুলি শ্রেণীবদ্ধভাবে সন্নিবিষ্ট থাকত। আসনগুলি এমন করে নির্মাণ হতো যে , একটি আসন শ্রেণী আরেকটির থেকে উঁচু। এতে দর্শকদের দেখবার সুবিধা হত। আসন শ্রেণীগুলি কেন্দ্র হতে আরম্ভ করে ক্রমশ চক্রাকারে বহমান ছিল। প্রত্যেক চক্রাংশের পরিমাণ একটি সম্পূর্ণ বৃত্তের ৩/৪ অংশ। এগুলোর মধ্যে মধ্যে আবার যাতায়াতের জন্য খানিকটা করে জায়গা ফাঁকা রাখা হতো। যাতায়াতের জন্য পথগুলির দুইপাশে বসবার আসনসগুলি পরস্পর সমান্তরাল রেখায় থাকত।
যখন রঙ্গালয়ে ভিড় হতো , দর্শকগণ অগত্যা যাতায়াতের পথ অধিকার করে দাঁড়িয়ে অভিনয় দেখতে বাধ্য হতো। সকলের নিচের বা সম্মুখের আসন শ্রেণীর হতে সকলের উঁচু বা একেবারে পিছনের আসন শ্রেণী মাঝে মাঝে সিঁড়ির ব্যবস্থা থাকত । দর্শকদের এই বসবার জায়গার সম্মুখেই একটি বৃত্তাকার ক্ষেত্র থাকত। এর নাম Orchestra। এই জায়গাটি ঐক্যতানবান্দন ও নৃত্য প্রভৃতির জন্য নির্দিষ্ট । এই ক্ষেত্রটি তক্তা দিয়ে ঢাকা ; এর মধ্যস্থলে একটি উচ্চ মঞ্চের উপর দেবতা Dionysus – এর বেদির স্থান। কখন – কখন এটি আবার সঙ্গীত সম্প্রদায়ের নেতা , বংশীবাদক বা উত্তর দ্বারা অধিকৃত হতো।
Orchestra-র পেছনেই নাট্যমঞ্চ বা stage। এটি কিঞ্চিৎ উচ্চতর ভূমির উপর অবস্থিত। সম্ভবতঃ বাদক – সম্প্রদায় Orchestra হতে নাট্যমঞ্চে আরোহণ করত। নাট্যমঞ্চের পিছনে কয়েকটি দ্বারযুক্ত একটি প্রাচীর থাকত। একে তারা Spene ( Last scaena) এবং Orchestra – র মধ্যবর্তী স্থানের নাম ছিল Proskenion ( Pros-cenium) । সংলাপের সময় এটি অভিনেতাদের দাঁড়ানোর স্থান। দৃশ্যপট বা Scene বলতে যা বোঝায় তখনকার গ্রীক বা রোমান থিয়েটারে তা ছিল না। তবে যে স্থান সম্পর্কে অভিনয় চলছে এইটুকু নির্দেশ করবার জন্য তখনকার Scaena কে চিত্র বিচিত্র করা হতো।
নাট্যশালার কোনো অংশ ছাদ দিয়ে ঢাকা ছিল না। কাজেই অভিনয়ের সময় বৃষ্টি হলে বাধ্য হয়ে দর্শকদের চারপাশে বারান্দায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হতো। অভিনয় প্রায় দিনের বেলায় হতো। সুতরাং কখনো কখনো রৌদ্র নিবারণের জন্য চাঁদোয়ার ব্যবস্থা থাকত ।
গ্রীক থিয়েটার নির্মাণ পদ্ধতির মধ্যে বিশেষ দোষ ছিল। দর্শকদের মধ্যে যাদের সকলের পিছনে বসতে হতো তারা সম্মুখের কিছুই দেখতে পেত না । তাদের নজর নাট্যমঞ্চের পাশের দিকে পড়ত। গ্রীক নাট্যশালাগুলি বিশাল ছিল। এত বড় করার উদ্দেশ্য শহরের সমস্ত অধিবাসীকে একসঙ্গে অভিনয় দেখার সুযোগ দেওয়া। বিরাট সেই নাট্যশালায় বহুলোকের স্থান সংকুলান হতো বটে, কিন্তু অতি অল্প লোকই অভিনেতাদের কথা শুনতে বা তাদের মুখের ভাব ভঙ্গি সুস্পষ্ট দেখতে পেত। অনেককেই এই সুখে বঞ্চিত থাকতে হতো।
তবে তাদের নাট্যশালার এই সমস্ত ত্রুটিকে আমাদের অর্থাৎ ভারতীয়দের যতটা অসুবিধাজনক বলে মনে হতো ,তাদে অতটা অসুবিধা জনক বলে বোধহয় মনে হতো না । কারন ভারতীয় নাট্যশালার নির্মাণ শৈলী সুপ্রাচীন কাল হতে কোনোদিনই উক্ত নানা দোষে দুষ্ট ছিল না। এর কারণেই, আমরা নাট্যকে যেভাবে বুঝতে অভ্যস্ত হয়েছি , তারা সেভাবে বুঝতে অভ্যস্ত ছিল না। প্রাচীনকালে অভিনেতৃগণ ধাতুনির্মিত একরকম মুখোশ পড়তো । এটি প্রকারান্তে Speaking trumpet -এর কাজ করতো ।। অত্যন্ত দূরের দর্শকগণ ছোট দেখবে বলে , একটু বড় দেখানোর জন্য তাদের খুব উঁচু গোড়ালীওয়ালা জুতো পায়ে দিয়ে, শরীরটাও প্যাডের সাহায্যে বৃহৎ করে নাট্যমঞ্চে নামত।
আধুনিক থিয়েটারের পূর্বাবস্থায় ভারতের বাইরে প্রায় সকল দেশেই অভিনেতারা সকলেই পুরুষ ছিল। সুবিশাল ভারতে কিন্তু সুদক্ষ অভিনেত্রীর কম ছিল না
সে কথা পূর্বেই বলেছি। পাশ্চাত্যে চিরকালই স্ত্রী লোকেরা অভিনয় দেখা থেকে বঞ্চিত থাকত। তবে বিয়োগান্তক নাটকের অভিনয় দেখতে যাবার বাধা ছিলো না । ভারতে এমন কোনো নিয়ম ছিল না। সেসব নিয়ম ভারতে বৈদেশিক আক্রমণের পর থেকে হয়। গ্রীক, রোম ইত্যাদি স্থানে খৃষ্টপূর্ব পঞ্চাশ শতকে স্ত্রী লোকেরা পৃথক স্থানে বসে অভিনয় দেখত।
অভিনয় প্রাতঃকালেই আরম্ভ হতো। পরপর দুটি তিনটি নাটকের অভিনয় হত। শেষে একটি প্রহসন হয়ে অভিনয় শেষ হত। সম্পূর্ণ অভিনয় শেষ হতে দশ-বারো ঘন্টা সময় লাগত।
সম্মুখের আসন শ্রেণীতে উচ্চপদস্থ ব্যক্তি, রাজকুলশ্রেণী , রাজদূত এবং পুরোহিতদের জন্য নির্দিষ্ট থাকত। তাছাড়াও যারা বেশি অর্থ খরচ করতে পারত , তারা অপেক্ষাকৃত উচ্চ আসনে বসবার ,অধিকারী হত। পেরিক্লিসের সময় থেকে দরিদ্ররা বিনা খরচে থিয়েটার দেখতে পেত। সাধারণ কোষাগার থেকে তাদের খরচ যোগান হত। শেষে নগরবাসী সকলেই সেই সুবিধা ভোগ করেছিল।
ভারতে গুহা বা পঞ্চমবেদ নাট্যশাস্ত্রোক্ত পাথর বা ইঁটের নাট্যশালা নির্মানের বহু পরে প্রায় ৪৯৬ খৃষ্টপূর্বাব্দে পাশ্চাত্যের এথেন্স নগরে প্রথম পাথরের থিয়েটার নির্মিত হয়। এর পর পাশ্চাত্য এবং এশিয়া মাইনরের নানা স্থানে নাট্যশালা নির্মাণের ধুম পড়ে যায়। গ্রীস, এশিয়া মাইনর ও সিসিলির সকল নাট্যশালা এথেন্সের অনুকরণে নির্মিত হয়েছিল। কারণ, ভারতীয় সূক্ষ্ম চারুশৈলী , শাস্ত্রীয় ও বৈজ্ঞানিক নিয়ম মেনে নাট্যশালা নির্মাণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল। এর বহু পূর্বে ভারত কিন্তু দ্বিতল নাট্যশালা নির্মাণ করতে সক্ষম ছিল।
রোমে ২৪০ খৃস্টাব্দের পূর্বে ঠিক অভিনয় হয় নি। এই সময় একটি কাঠের রঙ্গমঞ্চও তৈরি হয়। প্রত্যেকবার অভিনয়ের পর সে সব ভেঙে ফেলা হত। ১৯৪ খৃস্টপূর্বাব্দে সেনেটাররা নাট্যমঞ্চের পথের উপর বসতে পেত। কিন্তু তাদের নিরূপিত কোনো আসন ছিল না। যাদের বসবার দরকার পড়ত তারা নিজ নিজ চেয়ার আনত। কখন কখনও সরকারের হুকুমে বসে অভিনয় দেখা বন্ধ হত। ১৫৪ খৃষ্টপূর্বাব্দে নির্দিষ্ট আসন যুক্ত স্থায়ী থিয়েটার করবার চেষ্টা হয়। কিন্তু সেনেটের আদেশে সেই থিয়েটার ভেঙে ফেলতে হয়। ১৪৫ খৃষ্টপূর্বাব্দে গ্রীস বিজয়ের পর গ্রীকদের অনুকরণে থিয়েটার নির্মিত হয়। সেগুলিও কাঠের । একবারের অধিক তাতে অভিনয় হতো না । পাথরের নির্মিত প্রথম রোমান থিয়েটার ৫৪ খৃষ্টপূর্বাব্দে । Pompey এই থিয়েটার করেন। ১৭৫০০ বসবার আসন ছিল।
১৩ খৃষ্টপূর্বাব্দে Augustus তাঁর ভাইপো Marchellus – এর নামে একটি থিয়েটার নির্মাণ করেন। সেই থিয়েটারের ধ্বংসাবশেষ আজও বর্তমান।
গ্রীক এবং রোমান থিয়েটারে সাদৃশ্য যেমন ছিল , কিছু পার্থক্যও ছিল।
পার্থক্য ছিল দর্শকের স্থান নিয়ে। গ্রীকদের মতো এটিও সমান্তরাল পথ ও সিঁড়ি দিয়ে বিভক্ত ছিল। তবে এই স্থানগুলি সমান ভাবে গ্রীকদের মতো ছিল না। ছিল অৰ্ধবৃত্তাকারে। এর ব্যাসের শেষে রঙ্গমঞ্চের সম্মুখে ছিল প্রাচীর। গ্রীকরা অর্ধবৃত্তের অপেক্ষা বড় করে একটিকে নির্মাণ করত। রোমানদের থিয়েটারের সর্বোচ্চতলের স্তম্ভগুলির আবরণের উচ্চতা ছিল সমান।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. ভারতীয় নাট্যশালার গোড়ার কথা
২. কলকাতার সিনেমা হল