এসো কল্পতরু বাঁচাই

তৃষা’দের বাড়িতে বেশ একটা হ‌ই-হ‌ই পরিবেশ, এখন স্কুলে ছুটি চলছে রেজাল্ট আউট হয়ে গেছে সেভেন থেকে এইটে উঠেও গেছে সে কিন্তু এখন‌ও নতুন ক্লাস চালু হয়নি। আর আজ নিউ ইয়ারের ছুটিতে বাড়িতে অনেক আত্মীয় এসেছে যাদের মধ‍্যে ওর খেলার সাথী অনেকগুলো আছে। দিপালী হলো তৃষার মায়ের বান্ধবীর মেয়ে, থাকে মালবাজার দুদিন হল সেও স্কুলের ছুটির কারণে মায়ের সাথে বেড়াতে এসেছে জলপাইগুড়ি তৃষাদের বাড়ি। তৃষার মামার বাড়ি এই শহরেই মামাতো দাদা আর্য ক্লাস টেন কিন্তু আজ নিউ ইয়ার তাই সেও পিসির বাড়ি চলে এসেছে। তৃষার বাবারা দুই ভাই এক‌ই বাড়িতে থাকেন। কাজেই জেঠতুতো বোন ঘল্টা (তৃষার মা’য়ের দেওয়া আদরের নাম) ও তার ছায়া সঙ্গী এই বাড়ির পরিচারিকার মেয়ে টুকাইও এই দলে যোগ দিয়েছে। ঘল্টা আর টুকাই সমবয়সী দুজনেই ক্লাস ফোর। আজ মার খাওয়ার কারোর‌ই কোনো চান্স নেই একের মা মারতে এলে অন‍্যের মা বাঁচিয়ে নেবে বড়দের এই দুর্বলতাটা এই বিট্‌কেল গুলো সবাই জানে, তাই চুটিয়ে দুষ্টুমি শুরু। ওদের খেলা করার নামে বাঁদড়ামির চূড়ান্ত পর্যায়ের আগেই পরিস্থিতি হাতের মুঠোয় করে ফেলল সুদীপ্তা মানে তৃষার মা, স্মার্টলি মিষ্টি হেঁসে বলল আমরা সকলে বিকেলে তিস্তা উদ‍্যানে যাবো লাফালাফি করতে কিন্তু শর্ত একটাই এখন হুটোপাটি নয়, চুপটি করে বসে বসে খেলতে হবে। তৃষা বলল তুমি যেমন বলছ তেমন‌ই হবে কিন্তু আমার‌ও একটা শর্ত আছে আমাদের তিস্তা উদ‍্যানের লেকে বোটিং করতে দিতে হবে। সুদীপ্তা রাজী হতে না হতেই দিপালী ওর গাল দুটো টিপে দিল তারপর সবাই মিলে বৈঠকখানা ঘরে গেল।

দিন আষ্টেক্ হয়ে গেল এঘরে ডেরা বেঁধেছে দাদা, যখন‌ই আসে এই বৈঠকখানা ঘরটার দখল নিয়ে নেয় আর একবার আসা মানেই কবে যাবে তার ঠিক থাকেনা দিন পনেরোর জন‍্য এখানেই গ‍্যারেজ হয়ে যায় শেষে কোনক্রমে সুদীপ্তাকেই পেস্ট কন্ট্রোল করতে হয় অর্থাৎ ঘাড় ধাক্কা না দিলে উনি এই বাড়ি থেকে যেতেই চান না বড্ড ঢ‍্যাটা। যাইহোক সুদীপ্তা তৃষাকে বলেছিল একে আঙ্কেল সম্বোধন করতে কিন্তু এই লোকটা ওকে দাদা বলতে বলেছে ক্লাস টু থেকেই তাই দাদা বলেই ডেকে আসছে। এই দাদা অনেকদিন ধরেই এবাড়িতে আসে। বেশ একটা আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে এর সাথে এইবাড়ির সকলের। পাঁচটা বিচ্ছু মিলে গোল করে ঘিরে বসেই আর্য বলল দাদা হ‍্যাপি নিউ ইয়ার, সাথে বাকিরাও উইশ করলো। দাদা খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে হেঁড়ে গলায় চিল্লে বলল কি ব‍্যাপার তোরা সব এখানে কি করবি? টুকাই বলল ছোটমামী আমাদের বলেছে চুপচাপ খেলা করতে। ঘল্টা আবদার করলো গল্প শোনার সাথে তৃষা আর দিপালীও জোর করলো। এদিকে দাদা ভাবছে এই ছেলেমেয়ে গুলো সবকটাই টেক্-স‍্যাভি এদেরকে কি গল্প শোনাবে ।

কিছুক্ষণ মাথা চুলকে দাদা বলল, আচ্ছা শোন আজ তোদেরকে একশো পঁয়ত্রিশ বছর আগের সত‍্যি ঘটনা বলি। তৃষা বলল “দিস ইস টু ওল্ড দাদা” পাশ থেকে দিপালী বলল “সে সামথিং নিউ।” দাদা এমনিতে খুব খ‍্যাঁক্‌খ‍্যাঁকে কিন্তু এখন শান্ত হেঁসে বলল “দিস ইস অ্যা রিয়‍্যাল অ্যান্ড ইন্টারেস্টিং, আর তাছাড়া যা জীবনে কখন‌ও শুনিসনি এমন গল্প যত পুরনোই হোক তোদের কাছে তো তা নতুন‌ই হবার কথা। তাই তোরা চুপ করে মন দিয়ে শোন।” আর্য ওদের চুপ করতে ইশারা করলো।

দাদা শুরু করলো- সালটা ১৮৮৬ আজকের‌ই দিন অর্থাৎ পয়লা জানুয়ারী একটা বাগান বাড়িতে একজন দাড়িওয়ালা গুরুদেব অনেকদিন ধরে গলার ক‍্যান্সার নিয়ে অসুস্থ হয়ে ঘরে সেবা যত্নে রয়েছেন এখানে তাঁর সেবায় যুক্ত রয়েছেন তাঁর স্ত্রী ছাড়াও অনেক শিষ‍্য ও ভক্তবৃন্দ। আজ তাঁর শরীর টা একটু ভালো আছে, দুপুর তিনটে নাগাদ তিনি ঘর থেকে বেড়িয়ে বাগানের মধ‍্যে একটু পায়চারি করছেন আশেপাশে জনা তিরিশেক শিষ‍্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজেদের মত গল্পে মত্ত। এই ধর্মগুরুকে শিষ‍্যরা ঠাকুর বলে সম্বোধন করতেন। তাঁকে বাগানে বেড়াতে দেখে কিছু ভক্ত তাঁর কাছে এসে তাঁকে অভিবাদন জানাচ্ছে। ঠাকুর বাগানের মূল দরজার দিকে হাঁটতে থাকলেন এবং দেখলেন একটা গাছের নীচে গিরীশ, অতুল, রামচন্দ্র ও আরো কয়েকজন আড্ডা মারছে, তারা ঠাকুরকে দেখেই এগিয়ে এলেন অভিবাদন জানালেন। তখন তারা আরকিছু বলবে সে সুযোগ না দিয়েই ঠাকুর বললেন “আচ্ছা গিরীশ তুই বলতো তোর কি মনে হয় আমি কে ?” এই প্রসঙ্গে বলি কথিত আছে ক‍্যান্সার গিরীশের‌ই হয়েছিল এবং তার কষ্ট লাঘবের জন‍্য ঠাকুর নাকি সেটা নিজের গলায় ধারণ করেছিলেন। দিপালি বলে উঠলো এমন আবার হয় নাকি ? এটা বানানো গল্প। দাদা বলল পৃথিবীতে অনেক এমন অদ্ভূত কান্ডকারখানা আছে যা এখন‌ও বিজ্ঞান আবিস্কার করতে পারেনি। হয়তো একদিন হবে। তোরা যেমন করে মোবাইলে বিভিন্ন গেম একে অপরের সাথে শেয়ার করিস নানান অ্যাপ্লিকেশনের মাধ‍্যমে তেমন‌ই কোনোদিন দেখবি মানুষের ভালো খারাপ অনুভূতি এমনকী রোগ-বালাইও ট্রান্সফার করা যাচ্ছে। ঘল্টা খুব ভালো শ্রোতা সে দিপালী কে চুপ করালো কিন্তু দিপালীর মুখ দেখে মনে হলনা ও সন্তুষ্ট হয়েছে রোগ ট্রান্সফারের ব‍্যাপারটা নিয়ে ! দাদা আবার বলা শুরু করলো ঠাকুরের প্রশ্নের উত্তরে বিখ‍্যাত নাট‍্যকার গিরীশ ঘোষ হাঁটুগেড়ে বসে হাত জোড়া করে বললেন “স্বয়ং মহর্ষি ব‍্যাস ও বাল্মীকি যাঁর বর্ণনা দিতে হিমসিম খেয়েছিলেন সেই মহাপুরুষ সম্পর্কে মন্তব‍্য করার মত ধৃষ্টতা আমার নাই, তবে আমার মনে হয় আপনি ভগবানের‌ই অবতার রুপ।” ঠাকুর বললেন “আমি আর কি বলি, তোমাদের ভালো হোক্” এটা বলেই ঠাকুর সমাধিস্থ হলেন, তাঁর দেহ থেকে দিব‍্যজ‍্যোতি বের হচ্ছিল। দিপালী আর ঘল্টা একসাথেই জিজ্ঞাসা করলো সমাধিস্থ ব‍্যাপারটা কি ? তৃষা ওদেরকে দিদিমণি স্টাইলে বলল সমাধিস্থ হ‌ওয়া মানে ধ‍্যানস্থ হ‌ওয়া কোনো কিছুতে বিলীন হয়ে যাওয়া যাকে বলে ইংরাজীতে ট্র‍্যান্স (অ্যা ডীপ্ অফ্ কনসেন্‌ট্রেশন্)। সাথে সাথেই দাদা তৃষাকে চিপে ধরে চট্‌কে দিলো ! তৃষা তাকাতেই ওকে বলল তুই যে এটা এত ভালো করছ বোঝাতে পারবি আমার জানা ছিলনা। তৃষা বলল আমি আরো জানি তুমি যে ঠাকুরের কথা বলছ সে আর কেউ নয় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাই তো.? হ‍্যাঁ ! দাদা অবাক হতেই ও বলল আমি মাঝে মাঝে আগে সারদা মিশনের ক্লাসে যেতাম.. চেঁচিয়ে উঠলো এবার দাদা- যেতিস ! এখন আর যাস না কেন ? আবার যাওয়া শুরু কর। যাইহোক তোরা বুঝলি তৃষা কি বলল ওই অবস্থা হলো গভীরভাবে কোনো কিছুতে আচ্ছন্ন হ‌ওয়া। আর ওই ভদ্রলোক হলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, ওই বাগানবাড়ির নাম হল কাশীপুর উদ‍্যানবাটী, এরপর একে একে সব ভক্তরা ঠাকুরের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিতে থাকলেন এবং এই অবস্থায় যে যা চেয়েছিলেন তাই পেয়েছিলেন। এই বিষয়ে বলি কেউই কিন্তু নিজের জন‍্য কিছুই চাননি, সকলেই দেশ দশের মঙ্গল কামনা করেছিলেন। গিরীশ তো ঠাকুরের পায়ে পড়ে ‘জয় শ্রীরামকৃষ্ণ জয় শ্রীরামকৃষ্ণ’ বলে চিৎকার করে উঠলেন, অনেকেই ঠাকুর কে ওই অবস্থায় ছোঁয়ার পর চুপচাপ হয়ে গেছিলেন, কেউ কেউ ঠাকুরের স্তব করছিলেন, কেউ অন‍্য শিষ‍্যদের ডেকে আনছিলেন ঠাকুরের আশীর্বাদ গ্রহণের জন‍্য, সারদানন্দ, রামচন্দ্র প্রমুখ শিষ‍্যরা পরে লিখেছিলেন ‘সেদিন ঠাকুরকে স্পর্শ করে অদ্ভূত শান্তি পেয়েছিলাম।’

কাশীপুর উদ‍্যানবাটীর একটি আমগাছের নীচে এই ঘটনা ঘটেছিল। পরে সমাধি অবস্থা কাটার পর ঠাকুর সকলকে বলেছিলেন “আজ আমি তোদের জন‍্য কল্পতরু হয়েছিলাম। তোদের প্রত‍্যেকের চৈতন‍্য হোক” ; ঠাকুর নিজেই এই উৎসবের নাম দিয়েছিলেন কল্পতরু উৎসব। কিন্তু এই উৎসব পরের বছর আর তিনি করতে পারেননি কারণ সেই বছর‌ই কয়েক মাস পরে ঠাকুর এই কাশীপুরের বাগান বাড়িতেই দেহ রাখেন। শিষ‍্যরা কিন্তু প্রতিবছর‌ই এইদিনটি মহা ধুমধামের সাথে পালন করে আসছেন কল্পতরু উৎসব নামে আজ পর্যন্ত। টুকাই বলল এখন‌ও হয় দাদা ? হ‍্যা রে এখন‌ও হয় রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের প্রতিটি আশ্রমে এখন‌ও এই উৎসব পালন করা হয়। তোরা চাইলে আজ তোদের দেখাতেও পারি আমি, আজ বিকেলে তিস্তা উদ‍্যান ক‍্যান্সেল চল্ আজ আমরা সকলে মিলে জলপাইগুড়ির রামকৃষ্ণ আশ্রমে যাব তোরা রাজী উৎসব দেখতে.? সবাই দাদার উপর ঝাপিয়ে পড়লো ওদের সম্মতি জানানোর কায়দাটা দাদা বেশ উপভোগ করে।

আচ্ছা দাদা এই কল্পতরু জিনিসটা কি ? তরু মানে তো গাছ তাই না ? প্রশ্নটা করলো আর্য। একদম ঠিক ধরেছিস তরু মানে গাছ আর কল্পতরুর বিষয়টা আমি বলছি শোন- হিন্দু পূরাণ অনুযায়ী আমাদের স্বর্গে পাঁচ ধরণের গাছ আছে তার মধ‍্যে একটি হল কল্পতরু। এই গাছ সমুদ্রমন্থনের সময় সমুদ্র থেকে উঠেছিল তখন থেকেই দেবরাজ ইন্দ্রের স্বর্গীয় উদ্যানে এটি আছে। এই গাছের কাছে মনের কল্পনায় যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায় বলেই এই গাছের নাম কল্পতরু। মজার বিষয় হল এই গাছ পৃথিবীতেও আছে, কথিত আছে কৃষ্ণের ব‌উ রুক্মীনি মতান্তরে সত‍্যভামার আবদারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বর্গ থেকে এই গাছের একটি ডাল ভেঙে এনে তাঁর বাগানে বসিয়েছিলেন। জৈন ধর্মালম্বীদের বিশ্বতত্ত্ব আনুযায়ী, তিন আরা অর্থাৎ বছরের তিনটে আপৎকালীন পরিস্থিতি এই যেমন খরা, বন্যা, শীত প্রভৃতি সময় মানুষের যা যা প্রয়োজন কল্পতরু গুলি তাই তাই সরবরাহ করে থাকে। জৈন গ্রন্থগুলিতে এমন আট প্রকার গাছের উল্লেখ পাওয়া যায় যেমন, মধ্যাঙ্গ গাছের থেকে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর পানীয় আবার ভোজনাঙ্গ গাছ থেকে সুস্বাদু খাবার, জ্যোতিরাঙ্গ থেকে সুর্য চাঁদের চেয়ে বেশী জোরালো আলো, ভূষণাঙ্গ থেকে প্রয়োজনীয় পোশাক ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার বৌদ্ধ সংস্কৃতি তেও অমিতায়ুস ও উষ্ণিষবিজয় প্রভৃতি দীর্ঘায়ু দেবতাদের হাতে ধরা দীর্ঘজীবী ফুলদানির ভিতরেও ইচ্ছাপূরণের গাছ দেখানো আছে। প্রাচীনকালে মধ্যপ্রদেশের বিদিশা নামের এক জায়গা বিভিন্ন ভাস্কর্য বা স্টোন স্কাল্পচারের জন্য বিখ্যাত ছিল সেই সময়ের অর্থাৎ খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর এক বৌদ্ধ ভাস্কর্যে দেখানো আছে বটগাছ কে কল্পতরু রুপে পূজা করা। এই স্কাল্পচার কলকাতা যাদুঘরে গেলে এখন‌ও দেখতে পাবি তোরা।

ছবি: রাজস্থানের মরু অঞ্চলে ছায়াপ্রদানকারী প্রসোসিস সিনেরারিয়া, কল্পতরু

তৃষা বলল- আচ্ছা দাদা তুমি যে একটু আগেই বললে পৃথিবীতে এই গাছ আছে শ্রীকৃষ্ণ এনেছিলেন। তাহলে সেই গাছ কোথায় ? দাদা বললো- হম্‌ম্ ভালো প্রশ্ন করেছিস। শোন- ভারতীয়রা চিরকাল‌ই প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতাশীল তাই প্রকৃতির পূজা যুগযুগ ধরে এই ভারতভূমিতে হয়ে আসছে। উত্তরপ্রদেশের কিন্তুর নামের এক গ্রামে একটি বহু প্রাচীন বাওবাব গাছ আছে যাকে কল্পতরু বলা হয়। কথিত আছে এটিই শ্রীকৃষ্ণ স্বর্গ থেকে এনেছিলেন। অপর একটি পৌরাণিক গল্প আছে এটি নাকি অর্জুন এনেছিলেন স্বর্গ থেকে তার মা কুন্তীর জন্য। মাতা কুন্তী এই গাছের ফুল দিয়ে শিবপূজা করতেন। এই গ্রামের নাম কিন্তুর হয়েছে কুন্তীর নাম অনুসরণ করে। কথা শেষ হতে না হতেই ঘল্টা বললো বাওবাব ট্রী তো আফ্রিকায় দেখা যায় আমি ডিসকভারী চ্যানেলে দেখেছি। দাদা বললো একদম ঠিক দেখেছিস। কিন্তু ভারতের এক এক জায়গায় এক একটি গাছকে কল্পতরু বিবেচনা করা হয়েছে তাদের উপকারিতা কে মাথায় রেখে। যেমন, দেশের দক্ষিণ অংশে কোথাও নারকেল গাছ কে কল্পতরু ভাবা হয় কারণ এই গাছের আগা গোড়া পুরোটাই কাজে লাগে। বটগাছ আর অশত্থ গাছ উভয় গাছকেই কল্পতরু বলা হয় এদের অসাধারণ গুণের কারণে আর এই গাছ দুটিই ভারতবর্ষের সর্বত্র‌ই সহজলভ্য। বনে জঙ্গলে বসবাসকারী জনজাতি মানুষদের কাছে মহুয়া গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। বনবাসীরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে এই গাছ থেকে অনেক রসদ সংগ্রহ করে থাকে তাই তাদের কাছে এটি কল্পতরু। রাজস্থানে তথা মরু অঞ্চলে একটি গাছ হয় বৈজ্ঞানিক নাম প্রসোপিস সিনেরারিয়া স্থানীয় ভাষায় বলে আজমির বা জান্ত। এই গাছের শিকড় ৮২ ফুট গভীরে গিয়ে মাটি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে যার ফলে এটা সবসময় সবুজ থাকে আবার ভূমিক্ষয় রোধ‌ও করে তাই রাজস্থানে এটিই কল্পতরু। হিমালয়ের ৫০০-১০০০ মিটার উঁচুতে পাওয়া যায় চিউর গাছ বা ভারতীয় মাখন (ডিপ্লোনেমা বুটিরাসিয়া)। স্থানীয় পার্বত্য মানুষের মাখন, গুড়, মধু ও ঘিয়ের প্রয়োজন মেটায় এটি তাই ওখানে এই বৃক্ষ কল্পতরু। উত্তরাখন্ডের যোশীমঠে একটি তুঁত গাছ আছে যা নাকি ২৪০০ বছরের পুরানো। কথিত আছে এই গাছের নীচে শঙ্করাচার্য্য প্রায়শ্চিত্ত সাধনা করেছিলেন। উনি এটিকে শিবের অবতার মানতেন। তামিলনাড়ুর সংস্কৃতিতে তাল গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। তালের‌ও নারকেলের মত‌ই পুরো শরীরের ব্যাবহার করা যায় আর এই গাছ দীর্ঘজীবীও হয়। তাই এই উপকারী গাছকে কল্পতরু ধরা হয়। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে বিভিন্ন গাছের গুনাগুণের উপর ভিত্তি করেই আমরা শুরু থেকে কল্পতরু বলে পূজা করে আসছি।

আর্য বলে উঠলো আমি বটগাছের কাছে গিয়ে প্রণাম করে বলবো আমাকে মাধ‍্যমিকে যেন ভালো নম্বর পাইয়ে দেয়, তৃষা বলল আমি চাইবো যেন বড় ফ‍্যাশন ডিজাইনার হতে পারি, টুকাই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখন‌ই দিপালী ওকে থামিয়ে বলল হোয়াট্ রাবিশ ? যা চাইব তাই দেবে নাকি ওই গাছ ? দাদা এবার বলল হুম্‌ম্ তোরা সব কটা এক একটা গাধা। দিপালী ঠিক ভেবেছিস এখনকার যুগে ওসব হয়না শোন এই বিষয়ে রামকৃষ্ণের‌ই একটা গল্প আছে একবার একটা পথিক রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে একটা গাছের ছায়ায় বসলো বসে সে মনে মনে কল্পনা করলো এখানে যদি একটা খাটিয়া থাকতো তো একটু জিরিয়ে নেওয়া যেত। যেমন ভাবা তেমন কাজ সাথে সাথে ওখানে একটা খাট চলে এলো। তখন পথিক বুঝলো সে একটা কল্পবৃক্ষের তলায় আছে, সে খুশি হয়ে খাবার চাইলো সঙ্গে সঙ্গে চলে এলো, এরপর সে তাকে হাওয়া করার জন‍্য একটি মেয়ে চাইলো সঙ্গে সঙ্গে একটি মেয়ে এসে তাকে হাওয়া করতে থাকলো। কিছুক্ষণ পরেই লোকটার আর এসব ভালো লাগছিল না সে মজা করার জন‍্য মনে মনে কল্পনা করলো এসব চলে গিয়ে যদি এখন এখানে একটা বাঘ চলে আসে তো কেমন হয়? এটা ভাবতেই খাট, খাবার, পাখা নিয়ে হাওয়া করা মেয়ে সবাই উধাও হলো আর একটা ক্ষুধার্ত বনের বাঘ সেই গাছতলায় এলো আর লোকটা অন‍্য কিছু চাওয়ার আগেই…. — ঘল্টা চিল্লে উঠলো বাঘটা মানুষটাকে খেয়ে নিলো ! দাদা ঘল্টাকে একটা চুমু দিয়ে বলল ঠিক বলেছিস পাকাবুড়ি। তাহলে এই গল্পের শিক্ষা হলো- ভগবানের কাছে নিজের সুখের কোনো বস্তু চাইতে নেই আসলে নিজের সুখের জিনিস চাইতে চাইতে মানুষ লোভী হয়ে যায় আর তখন মানুষের মাথার ঠিক থাকেনা আর সেই বেঠিক বা বেহুশ অবস্থায় মানুষ নিজের অজান্তেই নিজের অথবা অন‍্যদের ক্ষতি করে বসে যেমন ওই লোকটা করে ফেলল। তাই আর্য তুই মাধ‍্যমিকে ভালো নম্বর পেতে হলে মোবাইলের গেম বাদ দিয়ে ঠিক করে পড়াশোনা কর আর তৃষা তুই ফ‍্যাশন ডিজাইনার হতে গেলে ভালো করে আগে উচ্চমাধ‍্যমিক পর্যন্ত পড় তারপর তোর পছন্দের বিষয়ের উপর পড়াশোনা হয় সেটা কর। আর টুকাই, ঘল্টা, দিপালী তোরাও তাই করবি কিন্তু। সকলেই সুবোধের মত ঘাড় কাৎ করলো।

দাদা আবার শুরু হলো, [ আসলে এই লোকটা ফ্রী তে জ্ঞান দিতে পারলেই খুশী। ] — তো একটু আগেই যেমন বললাম গাছের গুণটাই আমাদের কাছে ফার্স্ট প্রায়রটি। এখনকার দিনে যে পরিমাণ দূষণ আর বিশ্ব উষ্ণায়ন মানে তোদের ভাষায় গ্লোবাল ওয়ার্মিং হচ্ছে তার মূল কারণ হল বনভূমির ধ্বংসলীলা। দিপালী বলে ফেলল ঠিক বলেছ দাদা আমিও পড়েছি মানুষ নিজের বাড়ি বানানোর জন‍্য নিজের সুবিধার জন‍্য হিউজ পরিমাণে গাছ কেটে চলেছে.. ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তৃষা বলল- মা বলে আগে নাকি আমাদের উত্তরবঙ্গে আরো ঘন জঙ্গল ছিল আর অনেক পশুপাখী‌ও ছিল কিন্তু চোরা চালানকারীরা মূল‍্যবান গাছ কাটতে কাটতে আর পশু হত‍্যা করতে করতে উত্তরবঙ্গের অনেক ক্ষতি করেছে। ঘল্টা বলল আমাকেও কাম‍্যা (কাকীমা) বলেছে গাছের পাতা না ছিঁড়তে ওরা ব‍্যাথা পায় ওরাও কাঁদে আমাদের মত কিন্তু আওয়াজ হয়না। ওরা খুব আস্তে আস্তে কাঁদে, আর যখন খুব ব‍্যাথা পায় ওরা তখন আমাদেরকে উচিৎ শিক্ষা দেয়। আর্য বলল দাদুর কাছে শুনেছি আগে নাকি এখানে এত গরম পড়ত না এখন যেমন হয়, এর কারণ‌ও গাছের মৃত‍্যু। দাদা বলল তোরা তো দেখছি বেশ জ্ঞানী এই ব‍্যাপারে, বাহ্ খুব ভালো আর তোরা যেগুলো শুনেছিস বা পড়েছিস সব‌ই একদম ঠিক। তাই আমার দৃষ্টিতে প্রতিটি গাছ‌ই কল্পতরু কারণ একমাত্র গাছ‌ই পারে আমাদের এইসব বিপত্তি গুলো থেকে উদ্ধার করতে। গাছ আমাদের সব কিছুই দেয় সব থেকে প্রয়োজনীয় যে জিনিসটা দেয় সেটা হলো অক্সিজেন। আমরা যদি অক্সিজেনের ফ‍্যাক্টরী টাই নষ্ট করে দি তাহলে বাঁচবো কি করে ? আর না-ই যদি বেঁচে থাকি তাহলে আমাদের মনের ইচ্ছা গুলো পূরণ করবো কেমন করে ? তাই আজকের দিনে আমার মনে হয় আমাদের একটি করে গাছ লাগানো উচিৎ নিজেদের স্বার্থে। আর তোরা বোধহয় জানিস না আমাদের শাস্ত্রের বহু জায়গায় গাছকে দেবতা জ্ঞানে পূজার কথা বলা হয়েছে। তোরা কি বলিস গাছ লাগাবি নাকি আজকে? সবাই এর ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো আর তারপরেই হুড়মুড়িয়ে ঘর ছেড়ে পালালো দাদা তো কিছুই বুঝলো না কিন্তু মিনিট কয়েকের মধ‍্যেই সবাই চিৎকার করতে করতে আবার ফিরে এলো সবার হাতে টাকা দাদা আরো অবাক হলো জিজ্ঞেস করলো টাকা কি হবে রে.? ঘল্টা আর টুকাই তোরা টাকা কোথায় পেলি.? ঘল্টা বলল কাম‍্যা দিলো আমাদের কে টাকা চলো আমরা নার্সারী থেকে গাছ কিনে আনি তাড়াতাড়ি চলো ! একটা গল্প শুনিয়ে এমন ইম্‌প‍্যাক্ট কেউ কোনোদিন পেয়েছে কিনা সন্দেহ ! দাদা তো তড়াং করে উঠে পড়লো আর বলল গাছ কেনার টাকা আমি দেবো তোরা তাড়াতাড়ি টাকা গুলো যেখান থেকে এনেছিস ফেরৎ দিয়ে আয়। চল্ যাওয়ার আগে আমরা নিউ ইয়ার রেজলিউশন করি একটা কল্পতরুও নষ্ট হতে দেবনা আজ থেকে, আমরা আবার তপোবন গড়বো এই ভারতভূমিতে। সবাই আমার সাথে বলো-

” সর্বে ভবন্তু সুখীনঃ
সর্বে সন্তু নিরাময়া
সর্বে ভদ্রাণি পশ‍্যন্তু
মা কশ্চিৎ দুঃখভাগ ভবেৎ ।।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.