ভাস্কোর ভারত-আবিষ্কার না ভারতের অতুলনীয় জ্ঞান-সম্পদ এর আবিষ্কার?

ছোটোবেলায় আমাদের ইতিহাসে পড়ানো হয়েছে ভাস্কো-দা-গামা (Vasco da Gama)ভারতবর্ষ ‘আবিষ্কার'(Discovery)করেছিলেন ।
এই ‘আবিষ্কার’ শব্দের অর্থ কি এখানে? ভাস্কোর ১৫শ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ আবিষ্কারের আগে কি এই রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব ছিল না? কয়েকহাজার বছরের প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা কে ‘আবিষ্কার’ করতে হবে কেনো? তাহলে কি বোঝানো হয়েছে ভাস্কো-দা-গামা ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কার করেছিলেন ? তাহলে ইতিহাস বই তে পরিষ্কারভাবে সেকথাই বলা হয় না কেনো?
যদি ভাস্কো ভারতবর্ষে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কার করেই থাকেন , তাহলে কোন্ এমন ন্যাভিগেশন প্রযুক্তির সাহায্যে তিনি তা করেছিলেন যা বাকি বিশ্বের কাছে অজানা ছিল ?
এই প্রশ্নের উত্তরগুলো একটু খোঁজা যাক।
উত্তর খুঁজতে আমাদের আরো কয়েক শতাব্দী পেছনে যেতে হবে।
আলেকজান্ডার এর বিশ্বজয়ের অভিযানের সময়।
আলেকজান্ডার অতি সহজেই মিশর জয় করে , পার্সিয়া কে পরাজিত করে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে থমকে গেলেন রাজা পুরুর সামনে। আলেকজান্ডার এর সৈন্যবাহিনী ভারতের যুদ্ধে পারদর্শী হস্তিবাহিনীর কথা শুনে ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল।পাটনাতে অপেক্ষারত বিশাল হস্তিবাহিনীর খবরে, সৈন্যবাহিনী আরো এগোতে অস্বীকার করায় আলেকজান্ডার কে বাধ্য হয়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো। কিন্তু ভারত বিজয়ের বাসনা আলেকজান্ডার ত্যাগ করলেন না এবং আরো বড়ো সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসে আক্রমণের পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু এতো বড় সৈন্যবাহিনী ভারতবর্ষ কে ঘিরে থাকা মরুভূমি , পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে নিয়ে আসবেন কি করে ? তাই সমুদ্রপথ ব্যবহারের কথা ভাবলেন। ভারতে যাওয়ার সমুদ্রপথ খোঁজার জন্য তার সেনাপতি Nearchus কে দায়িত্ব দিলেন। Nearchus উপত্যকা বরাবর এসে কোনোরকমে আফ্রিকা তে আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত পৌঁছালেন।তাই ভারতবর্ষে আসার সমুদ্রপথ আলেকজান্ডার এর আমল থেকেই জানা ছিল। ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলে প্রচুর রোমান মুদ্রা প্রমাণ করে যে , ভারতবর্ষের সঙ্গে রোমানদের সমুদ্রপথে বাণিজ্য চলতো।গ্ৰিক ঐতিহাসিক ও দার্শনিক স্ট্রাবো (Strabo) বলেছেন, প্রতি বছর অন্তঃত ১২০ টি জাহাজ ভারত ও আলেকজান্দ্রিয়ার মধ্যে চলাচল করতো। রোমান লেখক ও দার্শনিক প্লিনি((Pliny) ভারত-রোম বাণিজ্য নিয়ে চিন্তাপ্রকাশ করে বলেছিলেন যে , ভারত-রোম বাণিজ্য সম্পর্ক ,রোমের অর্ধেক সম্পদ নিঃশেষ করে দিচ্ছিল। এমনকি গুজরাটের লোথাল সামুদ্রিক বন্দর হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই সক্রিয় ছিল। অর্থাৎ , আলেকজান্ডার এর ১০০০ বছর আগে! কিন্তু ব্রিটিশদের ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে ভাস্কো-দা-গামা ভারতবর্ষ আবিষ্কার করেছেন।এ যেন হাজারবার মিথ্যা কথা বলে , কথাটিকে সত্য করে দেওয়ার চেষ্টা।
তাহলে এই ‘আবিষ্কার'(‍‍Discovery) শব্দটি প্রয়োগ করা হলো কেনো?এই প্রসঙ্গে এই শব্দটির কি অন্য কোনো অর্থ আছে , যা আমরা জানি না?
এর উত্তর পাওয়া যায় একজন আদি আমেরিকান(Native American) এর লেখা একটি বই ‘Five hundred years of Injustice’ থেকে।’আবিষ্কার’ এর ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Discovery’র চার্চ এর উপাসনা-পদ্ধতিগত এক অন্য অর্থ (Church dogma)আছে।এই অর্থ অনুযায়ী , প্রথম কোনো খ্রীষ্টান যে জায়াগাতে যাবে , সেই জায়গাটি তার অধিকারভুক্ত হবে ,পূর্বে সেই জায়গার মালিকানা যারই থাকুক না কেনো ?
ব্রিটেন প্রোটেস্ট্যান্ট মতাবলম্বী হলেও চার্চের এই ফতোয়া কে মেনে ১৪৯৭ সালে সামুদ্রিক অভিযানে পাঠায়। কিন্তু উন্নত ন্যাভিগেশন পদ্ধতি না থাকায় এশিয়ার উদ্দ্যেশ্য যাত্রা শুরু করে উত্তর আমেরিকায় পৌঁছান।
১৮২৩ সালে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট চার্চের এই নিয়ম কে আমেরিকার আইনের অংশ বলে স্বীকৃতি দেয়।কোর্টের এই রায় অনুযায়ী খ্রীস্টানরা আমেরিকা ‘আবিষ্কার'(Discovery !) করলে আমেরিকার মূলনিবাসী আদি আমেরিকান Red Indian রা তাদের জমির অধিকার হারায়।আমেরিকায় এই রায় এর বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোনো আইনি প্রক্রিয়া দেখা যায় নি।এই হচ্ছে ব্রিটিশদের থেকে ধার করা আমেরিকার উন্নত বিচারব্যবস্থা !
চার্চের এই নিয়ম শুধু অমানবিক নয় , এর ফলে প্রচুর গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে এবং অখ্রীষ্টান দের দাসে পরিণত করা হয়েছে।কলম্বাস এর দ্বিতীয় আমেরিকা যাত্রার সঙ্গী লাস ক্যাসাস (Las Casas) এই গণহত্যার বিবরণ দিয়েছিলেন এবং তাঁর মতে প্রায় এক কোটি মানুষ এই গণহত্যার বলি হয়েছিল।এই সংখ্যা হিটলারের ইহুদী হত্যার থেকেও বেশী।
লাস ক্যাসাস বলেছিলেন , স্প্যানিশদের বর্বরতা থেকে মহিলা ও শিশুরাও রক্ষা পায় নি।মানব সভ্যতার ইতিহাসে উপাসনা পদ্ধতির নামে এই বর্বরতা এর
আর এখনো পর্যন্ত কলম্বাসের আমেরিকা ‘আবিষ্কার’ এর ঘটনা বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হয়। অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রেও থমাস কুক (Thomas Cook ) এর ‘অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার’ (আদি অস্ট্রেলিয়ানদের গণহত্যা) এর দিনটি পালন করা হয়‌।এই হচ্ছে ইউরোপিয়ানদের দ্বারা ‘আবিষ্কার’ এর গল্প। কিন্তু শিশুদের কি শেখানো হচ্ছে ? মানব সভ্যতার ইতিহাসের এই কলঙ্কিত অধ্যায়গুলি কে মহিমান্বিত করে তাদের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে।কারণ ঔপনিবেশিক শিক্ষা(Colonial Education) আসলে সারা বিশ্বে চার্চের উদ্দ্যেশ্য পূরণের জন্যই চালু হয়েছিল।বাল্য বয়সে যে শিক্ষা বা মতবাদ একবার মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় , তাই মানুষ সারা জীবন বহন করে এবং তাকেই চরম সত্য বলে মনে করে।’Age of Discovery’ নামে একটি অধ্যায় এখনো ICSE বোর্ডের পাঠক্রমে পড়ানো হয়। গণহত্যা কে মহিমান্বিত করার এই শিক্ষা কি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ নয় ?আর পশ্চিম বিশ্ব আমাদের মানবাধিকার (Human Rights) নিয়ে বড় বড় ভাষণ দেয়।

ভাস্কো-দা-গামা র ভারতবর্ষ ‘আবিষ্কার’ দিয়ে শুরু করেছিলাম।এখন প্রশ্ন হতে পারে , অন্যান্য দেশের মতো ভাস্কোর ভারতবর্ষ ‘আবিষ্কার’ এর সময় অন্যান্য দেশের মতো গণহত্যা হয় নি কেনো ?
কারণ ভাস্কোর ভারতে পৌঁছানোর পরেও প্রায় ২৬০ বছর পর্যন্ত ইউরোপীয়ানরা সামরিক শক্তির নিরিখে , ভারতের তুলনায় দুর্বল ছিল।ভাস্কো কে কালিকট থেকে পালিয়ে কালিকটের শত্রু কোচি(Cochin) তে
আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
এই সময় সামরিক দিক থেকে দুর্বল হওয়ায় , ভারতবর্ষের ভূমি দখল করতে ইউরোপীয়রা ব্যর্থ হলেও ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের জ্ঞান তারা কোনোরকম প্রতিরোধ ছাড়াই ইউরোপে পাচার করতে পেরেছিল।
সেই সময় বর্বর , ভারতবর্ষের তুলনায় দরিদ্র ইউরোপীয়রা বাণিজ্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধশালী হওয়ার আশায় সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় জ্ঞানের জন্য ভারতের মুখাপেক্ষী ছিল।
তাই ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে বিজ্ঞানের অতুলনীয় জ্ঞান-ভান্ডার আবিষ্কার করেছিল।
রোমান চার্চ সিরীয় খ্রিস্টানদের (যারা যীশুর ১২ জন শিষ্যের একজন ,সেন্ট থমাস দ্বারা কেরালায় ৫২ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দে ধর্মান্তরিত) জন্য তার প্রথম মিশন স্কুল ১৫০৮ সালে কোচিতে স্থাপন করে । উদ্দ্যেশ্য ছিল ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের জ্ঞান পর্তুগিজদের পাচার করা।তারপর সেই বিজ্ঞান কে নিজেদের আবিষ্কার বলে দাবি করা।তথ্য কে বিকৃত করে , বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কৃতিত্ব ইউরোপীয়দের নামে চালিয়ে দেওয়ার এক উদাহরণ আমরা অপেক্ষাকৃত বর্তমানকালেও আমরা দেখতে পাই।যেমন রেডিও তরঙ্গ আবিষ্কারের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব জগদীশ চন্দ্র বসুর পরিবর্তে ইতালির মার্কনি কে দেওয়া হয়।
কলম্বাস পৃথিবীর ব্যাসার্ধ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ৪০% ত্রুটি করলেও , আমাদের শেখানো হয় ,’কলম্বাস আবিষ্কার করেছিলেন পৃথিবীর আকৃতি গোলাকার’।কলম্বাস কেমন করে এইরকম একটি ভুল করলেন? আসলে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় গণিত তখনো ইউরোপের অজানাই ছিল। পৃথিবীর ব্যাসার্ধ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন কোণের জন্য ত্রিকোণমিতিক সারণীর প্রয়োজন ছিল যা কেবলমাত্র ভারতেই নির্ণয় করা হয়েছিল।কোচি থেকে জেসুইটরা(ক্যাথলিক চার্চের অনুগামী) ত্রিকোণমিতির সারণি ইউরোপে পাচার করে ও ১৬০৭ সালে জেসুইট জেনারেল ক্লভিয়াস নিজের নামে তা প্রকাশ করে। সেই ত্রিকোণমিতির সারণি হাতে পেলেও ক্লভিয়াসের পৃথিবীর সঠিক ব্যাসার্ধ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় গাণিতিক জ্ঞান ছিল না। এমনকি বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন কলম্বাসের ১৫০ বছর পরেও পৃথিবীর ব্যাসার্ধ নির্ণয়ে ২৫% ত্রুটি করেন। ভারতীয় পদ্ধতিতে আল-বিরুণী একাদশ শতাব্দীতে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ নির্ণয় করেন যার ত্রুটির পরিমাণ ছিল মাত্র ১%। অর্থাৎ , কলম্বাস গোলাকার পৃথিবীর ধারণা ইউরোপের মুসলিমদের থেকে পেয়েছিলেন।
সমুদ্রযাত্রার জন্য সমুদ্রে অক্ষাংশ নির্ণয়ের পদ্ধতি জানা আবশ্যক।আর সেই সময় স্থানীয় অক্ষাংশ বের করতে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ জানতেই হতো। পৃথিবীর ব্যাসার্ধ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন ত্রিকোণমিতিক সারণীর। ত্রিকোণমিতিক সারণী হাতে পেলেও তা বুঝতে ইউরোপের কয়েক শতাব্দী লেগে গিয়েছিল যেমন বেশিরভাগ নকলের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। ন্যাভিগেশন এর জন্য প্রয়োজনীয় গণিত ও বিজ্ঞানের অভাবে কলম্বাস ভারতবর্ষের উদ্দ্যেশ্য যাত্রা করে আমেরিকা পৌঁছে গিয়ে , আমেরিকার অধিবাসীদের নাম দিলেন ‘Red Indian’।
যে সামুদ্রিক যাত্রাগুলি আসলে মানব সভ্যতার ইতিহাসের বর্বরতা ও ইউরোপের বিজ্ঞানে অজ্ঞানতা প্রকাশ করে , সেগুলিকে মহিমান্বিত করে আমাদের পড়ানো হয়।
উল্টে , ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের আগমনের দুটো কারণ এক খ্রিষ্টীয়করণ এবং দুই ভারতীয় বিজ্ঞানের নকল করে ইউরোপে পাচার খুব সহজেই প্রমাণ করা যায়।এই সত্যগুলো এখনো জনসাধারণের মধ্যে প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছে।
ঔপনিবেশিকতা কি এখনো আমাদের শিক্ষা কে গ্ৰাস করে রাখে নি ?
ভারতবর্ষের শিক্ষা কি , সত্যের পক্ষে কথা বলছে?
ইউরোপীয়দের বিজ্ঞানের উৎকৃষ্টতার যে মিথ্যা কাহিনী শিশুমনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে , তা থেকে না বেরোতে পারলে এবং ভারতবর্ষের বিজ্ঞান এর সঠিক ও গৌরবময় ইতিহাস পাঠ্যবই তে ঠাঁই না পেলে , ভারতের ভবিষ্যতের নাগরিক হিসেবে তারা কি আত্মবিশ্বাসী ও গর্বিত হতে পারবে ?

তবুও স্বাধীনতার এতবছর পর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কে ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত করার সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে ‘National education Policy 2020’ এর মাধ্যমে। NEP এর 4.27 para তে বলা হয়েছে -“Knowledge of India” will include knowledge from ancient India & it’s contribution to modern India & its success and challenges , and a clear sense of India’s future aspirations with regard to education , health , environment , etc.।তাই জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের সঠিক ও গৌরবময় ইতিহাস জেনে একজন ভারতীয় হিসেবে গর্ববোধ করবে এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে এই দেশকে আত্মনির্ভরতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে–এই আমাদের আশা।

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.