নিজের রেকর্ড তিনি নিজেই ভাঙলেন। চোদ্দর ভোটের ২৮৩ কে পার করে একাই এগিয়ে গেলেন আরও বেশ কয়েক পা। এতটাই যে আরেকটু হলেই ছুঁয়ে ফেলতেন তিনশ!
এ তো শুধু ফিরে আসা নয়! আগুনখোর পাখির মতোই ফিরে আসা! এবং বিষ্যুদবার বেলা গড়ানোর আগেই স্পষ্ট হয়ে গেল, দেশের মানুষ এ বারও স্পষ্ট জনমত দিয়েছে। কেন্দ্রে আরও একবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গড়তে চলেছেন নরেন্দ্র দামোদার দাস মোদী।
এতক্ষণে সেই ফলাফল নিয়ে আর রহস্যের বাকি নেই। বরং প্রশ্ন একটাই। কী করে পারলেন মোদী?
পাঁচ বছর আগে এ প্রশ্ন কেউ করেনি। কারণ, ফল প্রকাশের আগেই যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল জনতার। উপর্যুপরি দুর্নীতির অভিযোগে দীর্ণ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গোটা দেশ জুড়ে প্রবল বিরোধিতার আবহ তৈরি হয়েছিল সে বার। তুলনায় মোদীতে এক মসীহাকে দেখেছিলেন মানুষ। কোন জাদুতে জানা নেই, তবে বিশ্বাস ছিল, তিনি ‘অচ্ছে দিন’ এনে দিতে পারবেন। তাই ঝড় উঠেছিল। যাকে বলা হয়েছিল মোদী ঝড়। সেই ঝড়ে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল কংগ্রেস সহ হিন্দিবলয়ের সব আঞ্চলিক দল।
কিন্তু এ বার? ঝড় কোথায়? উল্টে মাত্র ছয় মাস আগে হিন্দিবলয়ের অন্যতম তিনটি রাজ্য রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগড় হাতছাড়া হয়েছে বিজেপি-র। উত্তরপ্রদেশে লোকসভার উপ নির্বাচনে ডাহা হেরেছে যোগী-মোদী দল। তার পর বরং এই হাওয়া উঠে গেছিল, উত্তরপ্রদেশে বুঝি সাফই হয়ে যাবে বিজেপি। বিশেষ করে মায়াবতী, অখিলেশ পরস্পরের হাত ধরে নেওয়ায় উদ্বেগের স্রোত বয়ে গেছিল বিজেপি-র অন্দরেও।
তা হলে? কী জাদু করলেন মোদী-শাহ জুটি।
এখনও পর্যন্ত ফলাফলের যে গতিপ্রকৃতি, তাতে কার্যকারণ নিয়ে অন্তত কতগুলি বৃহৎ বিষয়ে একমত বিশেষজ্ঞরা।
তা হল, এক: শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে সফল হয়েছেন মোদী-শাহ জুটি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারা, কৃষি সংকটের মতো প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার বিষয় আশয়কে ঢেকে দিতে পেরেছেন স্রেফ মেরুকরণ দিয়ে। সেই মেরুকরণ শুধু গো-মাতা, গো-হত্যা বন্ধ, তিন তালাক প্রথায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে হয়নি, হয়েছে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটিকে সামনে রেখেও। পুলওয়ামা কাণ্ড ও তার পর পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হানাকে সামনে রেখে গ্রাম, শহরে জাতীয়তাবাদের হাওয়া কেড়ে নিতে পেরেছেন নিজেদের দিকে। এবং পুলওয়ামা নিয়ে যত বেশি মমতা-রাহুলরা তাঁকে আক্রমণ করেছেন, তত তীব্র হয়েছে মেরুকরণ।
দুই: তবে বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারেও একমত যে মোদীর সাফল্যের তুলনায় বিরোধীদের ব্যর্থতাও কম বড় নয়। চোদ্দর লোকসভা ভোটে দুর্বল হয়ে যাওয়া কংগ্রেসের মাথায় চেপে বসতে চেয়েছে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ আঞ্চলিক দল। একে তো জাতীয় দলের সভাপতি হয়েও প্রধানমন্ত্রী পদ প্রার্থী হয়ে ওঠার প্রশ্নে রাহুল গান্ধীর মধ্যে টইটুম্বুর আত্মবিশ্বাস দেখা যায়নি, উপরি আঞ্চলিক শক্তিগুলির উপর তাঁর নির্ভরতার বিষয়টি নিজেই প্রকট করে দেন রাহুল। ক্ষতি হয়েছে তাতেই।
তিন: স্থায়ী সরকারের পক্ষেই রায় দিয়েছে মানুষ। পর্যবেক্ষকদের বড় অংশের মতে, উনিশের ভোটে কংগ্রেসের ভরাডুবি হল ঠিকই। কিন্তু তার মানে এই নয় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রাহুল গান্ধীকে অপছন্দ করেন। বরং উল্টোটাই। রাহুলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়াবতী, চন্দ্রবাবু নায়ডুর মতো নেতা যে ভাবে প্রধানমন্ত্রী পদ প্রার্থী হওয়ার চেষ্টায় নেমেছিলেন, তাতেই হয়তো ভয় পেয়েছে মানুষ। এই পরিস্থিতি নিজের সুবিধামতো কাজে লাগাতেও সফল হয়েছেন মোদী-জেটলিরা। প্রচারে ধারাবাহিক ভাবে প্রশ্ন তুলেছেন, মানুষ কী চান, মজবুত সরকার না মহামিলাওয়াটি মজবুর সরকার?
চার: রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন অমিত শাহ। এ ব্যাপারে কোনও সংশয় নেই যে উনিশের ভোটে মোদীর পক্ষে কোনও ঝড় দৃশ্যত স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু এও বাস্তব যে, চোদ্দর ভোটের পর থেকে রাজনীতির জমিতে চব্বিশ ঘণ্টা ছিল বিজেপি। পাঁচ বছর আগে দেশের বহু জেলায়, বহু ব্লকে বিজেপি-র সংগঠন বলে কোনও বস্তু ছিল না। তা সত্ত্বেও জনমতের জোয়ারে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল বিজেপি। কিন্তু গত বছরে সেখানে বুথ স্তরে সংগঠন বাড়িয়েছে বিজেপি। যে রাজ্যগুলিতে একেবারে প্রান্তিক শক্তি ছিল গেরুয়া দল, সেই বাংলা, ওড়িশা থেকে আসন বের করে এনেছে। যে সাংগঠনিক সাফল্য আর যাই হোক কংগ্রেস দেখাতে পারেনি।
এই সব সাত সতেরো কারণের সমষ্টিতে যা হওয়ার তাই হল। সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে জনমত জানিয়ে দিল আরও একবার কেন্দ্রে থাক না চৌকিদারেরই সরকার!