১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের দিল্লি কাউন্সিলে চতুর জিন্না লাহৌর প্রস্তাবের একাধিক মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণার ‘এস’ অক্ষরটা কেরানির টাইপের ভুল বলে কেন্দ্রীভূত একটাই পাকিস্তানের প্রস্তাব সুকৌশলে পাশ করিয়ে নিলেন সম্মেলনে, কাছ থেকেই তা দেখেছেন তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাকে অখণ্ড রাখার শরৎ বসু-আবুল হাশিম-সুরাবর্দির শেষ মুহূর্তের চেষ্টাটাও যখন ব্যর্থ হল, ব্যথিত হয়েছেন। অন্নদাশঙ্কর রায়কে বলেছিলেন যে, একটা স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন সেই ১৯৪৭-৪৮ সাল থেকেই উনি দেখতে থাকেন। অন্যথায় ব্যাখ্যা মেলে না, এক সময় মুসলিম লীগের একনিষ্ঠ কর্মী মাত্র তেইশ বছর পরে কী ভাবে হয়ে উঠলেন ধর্মনিরপেক্ষ এক রাষ্ট্রের স্রষ্টা। কম্পিউটারে টাইপে ভুল করলে আমরা ‘আনডু’ করি, শেখ মুজিবের গোটা জীবনটাই যেন ছিল— যে পাকিস্তানের জন্যে যৌবনে লড়েছিলেন, সেই পাকিস্তান রাষ্ট্রটাকেই বাংলা থেকে ‘আনডু’ করার সংগ্রাম। তা সম্ভব হয়েছিল, কারণ ওঁর পায়ে সব সময় লেগে ছিল মধুমতী পারের জল-কাদা-মাটি।
পূর্ববঙ্গ ছিল চিরকালের অবহেলিত। কলকাতা বন্দর ছাড়া পূর্ববঙ্গ যে দিল্লির কাছে কত গুরুত্বহীন ‘ডিসপোজ়েবল ছিল, নোয়াখালির খানা-খন্দ-কচুরিপানায় ভরা জল-কাদার মাটিতে দাঁড়িয়ে রামমনোহর লোহিয়াকে বলা জওহরলাল নেহরুর কথাগুলো স্মরণ করলে বোঝা যায়। আর রাওয়ালপিন্ডির পঞ্জাবি শাসকদের কাছে পূর্ববঙ্গ তো ছিল কেবলই একটা বাজার, যার অধিবাসীরা ‘সাব-হিউম্যান’ ও আধা-হিন্দু। সে রকমই এক জনপদের দিঘল এক গর্বিত নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। যিনি বাঙালি, আবার মুসলমানও।
ওঁর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহিদ সুরাবর্দি যখন তাঁর নীতিহীন রাজনীতি নিয়ে করাচির ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাফেরা করছেন, পদের মোহে আত্ম-পরাজয়ী হচ্ছেন ফজলুল হক, চিনের প্ররোচনায় মৌলানা ভাসানি বিভ্রান্ত, তখন শেখ মুজিবই, প্রতিবাদে ও প্রতিরোধে জ্বলে উঠলেন সূর্যের মতো। বাংলার মানুষ বুঝতে পারছিল, এই এক নেতা যে তাদের ধোঁকা দেবে না। জেল খেটেছেন প্রায় তেরো বছর। আর কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠ থেকে, কিছুটা যেন নেলসন ম্যান্ডেলার মতোই, ক্রমশ হয়ে উঠলেন আরও প্রাজ্ঞ ও দৃঢ়চেতা এক জননেতা।
ও রকম নৃশংস ভাবে নিহত হওয়ার আগে নতুন রাষ্ট্রটাকে গড়ার জন্যে সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। কিন্তু ওই স্বল্প সময়েই বঙ্গবন্ধুর অর্জন কিছু কম ছিল না। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা তো সবই ধ্বংস করে দিয়েছিল— রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, কাঠামো। পৌরাণিক সেই ফিনিক্স পাখির মতোই যেন এক ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠল বাংলাদেশ। আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ এক চমৎকার সংবিধানও তৈরি করে দিলেন। ১৯৭৫-এ এসে নিজের মধ্যবিত্তের দলটাকে উনি করতে চাইলেন কৃষক-শ্রমিকমুখী ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (বাকশাল)। কিন্তু ওঁর দলের ভিতরের ধনীরা তখন চাইছেন আরও বিকাশ। নিজের হাতে গড়া দলটার সঙ্গেই কোথায় যেন একটা বিচ্ছিন্নতা ঘটে গেল ওঁর। বঙ্গবন্ধু পরিণত হলেন কালের চিহ্নিত বলিতে!
এক সময়কার হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ দেশটার ঈশ্বরী পাটনীর সন্তানেরা আজ ফসল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পরিশ্রমী বস্ত্রবালিকাদের কারণে ক্ষুদ্র বাংলাদেশ আজ গোটা বিশ্বেই পোশাক শিল্পে এক সুপারপাওয়ার, চিনের পরেই। আর টেক্সটাইল হচ্ছে ‘মাদার অব অল ইন্ডাস্ট্রিজ়’। ফলে চিরকালের কৃষিজ বাংলাদেশও আজ ক্রমে হয়ে উঠছে শিল্পায়িত। জিডিপি বেড়েই চলেছে বছর বছর। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার আর সামাজিক অনেক সূচকেই দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে থাকছে বাংলাদেশ। ভোট দিলে পাকিস্তানকে সুইডেন বানাবেন, ইমরান খানের এই কথায় সে দিন পাকিস্তান টেলিভিশনের এক টক শো-তে ও দেশের এক বুদ্ধিজীবীকে বলতে শুনলাম, সুইডেন নেহি, মুঝে বাংলাদেশ বনা দো। এ যেন একাত্তরের মিষ্টি প্রতিশোধ! এক নতুন আত্মবিশ্বাস যেন পেয়েছে হাফ-সেঞ্চুরি করা দেশটার মানুষেরা যার বর্তমান নেত্রী, মধুমতী পারের কন্যাটি, দৃপ্তকণ্ঠে বলতে পারেন, বিশ্ব ব্যাঙ্ক টাকা না দিলে কী হবে, আমরা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানাব। আজ যে কেউ পদ্মার পারে এলে দেখতে পাবেন যে, বিশাল পদ্মা নদীর চেয়েও বিশালতর এক সেতু দক্ষিণ ও মধ্যবঙ্গের দু’কূল বেঁধে দিয়েছে চিরকালীন মেলবন্ধনে। পূর্ববঙ্গকে সেই প্রাচীন কাল থেকেই হেয় করা হয়েছে। ‘বাঙাল’দের নিয়ে বাংলা সাহিত্যে ও জনরুচিতে কত অবজ্ঞাই না আমরা দেখেছি! কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি এক বড় শক্তি। আজকের বিকাশোন্মুখ জঙ্গম বাংলাদেশ যেন শত শত বছরের সে সব অবজ্ঞার বিরুদ্ধেই পূর্ববঙ্গের প্রতিশোধ!
TAP TO UNMUTEAdvertisement
তবে রাষ্ট্র আর সমাজ এক জিনিস নয়। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রটা ছিল সাম্প্রদায়িক, সমাজ ততটা সাম্প্রদায়িক ছিল না। এখন রাষ্ট্র কিছুটা অসাম্প্রদায়িক হয়েছে, কিন্তু সমাজ হয়ে পড়েছে সাম্প্রদায়িক। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব সমাজটাকে ছেড়ে দিয়েছে অশিক্ষিত ও কুশিক্ষিত মোল্লাদের হাতে। ফলে ইট-কংক্রিটের কিছু উন্নতি ঘটলেও, মানুষের মানবিক ও নান্দনিক উন্নতি ঘটছে না তেমন। সংস্কৃতিগত ভাবে সমাজটা পিছিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের আর এক সমস্যা, দেশটার শাসক শ্রেণি। শাসক শ্রেণি বলতে শুধু ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলটিকে বোঝাচ্ছি না, রাজনৈতিক নেতা, ধনী ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও পুলিশের বড়কর্তা, এ সব নিয়ে যে ‘এলিট’ শ্রেণি দেশটাকে শাসন করে, তার গোটা অংশটাকেই বোঝাচ্ছি। সাতচল্লিশের পর হিন্দুদের জমি-সম্পত্তি ও একাত্তরের পর অবাঙালিদের ব্যবসা-সম্পত্তি দখলের ফলে এদের অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। আরও বিপদ, দুর্নীতির হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে চলে যায় বিদেশে। এদের অনেকেরই নিউ ইয়র্ক, ডালাস বা টরন্টো শহরে বড় বড় দালানকোঠা রয়েছে। লুটেরা এই শাসক শ্রেণির কাছে বাংলাদেশ এক কামধেনু মাত্র!
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বপ্ন ছিল, বাংলাদেশ হবে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবার রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশের কেউ কেউ আজ মনে করা শুরু করেছে যে, বাংলাদেশ যেন কেবলই মুসলমানদের রাষ্ট্র! তার জন্মের সময়কার ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে অনেকটাই সরে এসেছে আজকের বাংলাদেশ, আর ততটাই সরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকেও। অজস্র মুরালে, মূর্তিতে, গলা-কাঁপানো-বক্তৃতায় আর আবেগ-থরথর কবিতায় বাংলাদেশে এখন অবশ্য বঙ্গবন্ধুর খুবই সরব উপস্থিতি। তবে তার কতটা অন্তরের টানে, আর কতটা আসলে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি করার বাঙালি মোসাহেবিতে, সেটা দেখার বিষয়। তবে ইসলামি মৌলবাদীদের সঙ্গে আপস অবশ্য বাংলাদেশের শাসক শ্রেণি বেশ আগে থেকেই শুরু করেছে। ইসলামি মৌলবাদীরা যখন ঢাকা বিমানবন্দরের সামনে বাংলার আত্মা লালন ফকিরের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলল, বাংলাদেশের রাষ্ট্রশক্তি কিন্তু তখন কাউকে শাস্তি দেয়নি। তাই আজ তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা খোদ শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যই ভেঙে ফেলার হুমকি দেওয়ার সাহস পাচ্ছে!
সাম্প্রদায়িকতায় জর্জরিত এই উপমহাদেশের পূর্ব প্রান্তের কিছু মানুষ এক দিন বাঙালিদের এক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তবে সে স্বপ্নের পথে পথেই ছিল পাথর ছড়ানো। বুলেটও। কখনও উগ্র ওয়াহাবি ইসলাম তাকে আচ্ছন্ন করেছে, কখনও হিংসুটে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ তার মনন ও আত্মাকে করেছে কলুষিত, ফলে মাঝে মাঝেই হয়তো টাল খেয়েছে বাংলাদেশ, কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগে অর্জিত দেশটা শেষমেশ পথ হারায়নি।
বাঙালির জিনের মধ্যেই রয়েছে এক অচিন সোনার বাংলার স্বপ্ন, যে স্বপ্ন আজন্ম তাড়িত করেছে বঙ্গবন্ধুকে। সেই স্বপ্ন স্বয়ং শেখ হাসিনাও দেখেন, এবং ওঁর নেতৃত্বের সবচেয়ে সফল দিকটা হল— সেই স্বপ্নকে তিনি বাংলাদেশের সকল মানুষের মনেও জারিত করে দিতে পেরেছেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আজ তেমন স্বপ্ন দেখেন না। বাংলাদেশ কিন্তু ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। যদি বাংলাদেশের লুটেরা শাসক শ্রেণি ক্রমশ সামনে এগিয়ে যেতে থাকা এই ট্রেনটার নাটবল্টুও খুলে বেচে না দেয়, বা ভূতের মতো উল্টো পায়ের ইসলামি মৌলবাদীরা ট্রেনটাকে পিছনের দিকে ঠেলে না দেয়, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ নামের রেলগাড়িটা পৌঁছে যাবে মধ্য-আয়ের স্টেশনে।
আর তার পরের স্টেশনটাই তো সোনার বাংলা!