প্রাচীন ভারতীয় নাট্যশালা হয়ে কলকাতার ছবিঘর – প্রথম অঙ্ক

প্রথম অঙ্ক

নাট্যশালায় নাটকাদি অভিনয় হয়। এখানে নৃত্য ,গীত, বাদ্য , হাব , ভাব, বিলাস ইত্যাদি চৌষট্টি কলার কয়েকটি কলা – শিক্ষার পরিচয় পাওয়া যায়। নাট্যশালায় এগুলির অনুশীলন হয় – রসাস্বাদন হয়। সেই সুপ্রাচীন কাল হতে এখানে অভিনয় দেখে মানবগণ আমোদ উপভোগ করে আসছেন। অভিনেতাগণও অভিনয় করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। 

নাট্যশালা আজকালকার তৈরী একটা নব্য বস্তু নয়। অতি প্রাচীনকালে এর সৃষ্টি। ভারত , গ্রীস এবং রোম – এই তিন দেশেরই নাট্যশালা খুব পুরানো। চীন ও এশিয়া মাইনরের নাট্যশালাও কমদিনের নয়। 

প্রাচীনকালে সুবিশাল ভারতবর্ষে কোন দৃশ্যকাব্যের অভিনয় আরম্ভ করবার পূর্বে কুশীলবগণ একত্র মিলিত হয়ে রঙ্গবিঘ্নশান্তির উদ্দেশ্যে একপ্রকার মাঙ্গলিক উৎসবের আয়োজন করতেন। তার নাম ছিল #জর্জরোৎসব । পরে পুরাতন ইংল্যান্ডে উক্ত উৎসবের অনুকরণে May – Day rites বা May – Pole dance আয়োজিত হতো। সেই যুগের অভিনয়ের সঙ্গে এই জর্জরোৎসবের সম্পর্ক এতই ঘনিষ্ঠ ছিল যে , একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি কল্পনাও করা যেত না। এই জর্জরোৎসবের ইতিহাসই ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রের গোড়ার কথা। 

সাধারণের ধারণা নাট্যবেদ ব্রহ্মার রচিত। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে বেদের ন্যায় , শিবের ন্যায় , আদিশক্তির ন্যায় নাট্যশাস্ত্র অনাদি, অপৌরুষেয় , সয়ম্ভূ। ব্রহ্মা কেবল নাট্যশাস্ত্র প্রবর্তিরিতা মাত্র, সৃষ্টিকর্তা নন। 

পুরাকালে একদিন। মহর্ষি ভরত নিত্য জপ সমাপন করে পুত্র এবং শিষ্যগণ দ্বারা পরিবৃত হয়ে তপোবনে বসেছিলেন। সেদিন অনধ্যায়। পঠন পাঠন থেকে সেদিন  সকলের ছুটি। সুতরাং , এটিই উপযুক্ত অবসর এমন উপলব্ধি করে অত্রেয় প্রমুখ জিতেন্দ্রিয় মুনিগণ ভরতকে প্রশ্ন করলেন ” বেদানুমোদিত ও চতুর্বেদের সমকক্ষ নাট্যবেদ নামে যে গ্রন্থ আপনি কিয়দ্ দিবস পূর্বে সংকলিত করেছেন তা কিরূপে এবং কার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল ? তাছাড়াও এই নাট্য বিষয়ের কয়টি অঙ্গ ,  কি প্রমাণ ,রঙ্গমঞ্চে এর প্রয়োগ বিধি কীদৃশ ?”…..ইত্যাদি বহু প্রশ্ন করেছিলেন।  ভরত মুনি একে একে সবের উত্তর দিয়েছিলেন এবং প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে উক্ত ব্রক্ষস্বরূপ বিদ্যার কথা বলেছিলেন। 

ভরত মুনি বলেছিলেন যে , সায়ম্ভূব হতে সূচিত করে বৈবস্মত অবধি প্রত্যেক মন্বন্তরেরই ত্রেতাযুগে নাট্যবেদ ব্রহ্মা কর্তৃক প্রবর্তিত হয়ে আসছে। কিন্তু কখনো কোনো সত্য যুগে নাট্যবেদের প্রচার হয় নি। 

সায়ম্ভূব হচ্ছে প্রতি কল্পের আদি মন্বন্তর। তার প্রথম সত্যযুগ ও সত্য ত্রেতার সন্ধিকাল অতিক্রান্ত হবার পর ত্রেতাযুগের প্রারম্ভে – দেব, দানব, যক্ষ , রক্ষঃ , গন্ধর্ব , মহোরগ প্রভৃতি দ্বারা সমাক্রান্ত – লোকপালগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত – মানবের কর্মভূমি জম্বুদ্বীপে -প্রজাপুঞ্জ গ্রাম্যধর্মে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। কারণ , ত্রেতাযুগ প্রবৃত্ত হবার সঙ্গে সঙ্গেই লোক – সমাজে একপাদ পাপ সঞ্চারিত হয়েছিল। প্রজাগণ পাপ – সঞ্চারের ফলে কাম , লোভ ইত্যাদি দোষের বশীভূত – ঈর্ষা , ক্রোধ প্রভৃতি দ্বারা বিমূঢ় হয়ে দুঃখ ভোগ করছে দেখে দেববৃন্দ ব্রহ্মাকে বললেন – 

” হে ব্রহ্মদেব ! ত্রিলোক চিত্তবিনোদনের উপযোগী এমন একটি হিতকর ক্রীড়ার দ্রব্য , যা একাধারে দৃশ্য ও শ্রব্য হতে পারে।  আপনি কৃপাপূর্বক সকলের শ্রবণযোগ্য একটি সার্ববণিক পঞ্চম বেদ সৃষ্টি করুন । “

 তত্ত্বাবিৎ ব্রহ্মা , ” তথাস্তু” বলে সকল দেবগণকে বিদায় দিলেন। পরে যোগ বলে চতুর্বেদের স্মরণে প্রবৃত্ত হলেন। তিনি তখন সংকল্প করলেন – ” আমি নাট্যাখ্য এমন এক পঞ্চম বেদ সংকলন করব যা ধর্ম এবং বুদ্ধির অনুকূল হবে। যা হবে অর্থপ্রদ , হৃদ্য , প্রয়োজনীয় , যশস্য , নানা উপদেশ বহুল। ধর্মার্থ কাম – মোক্ষাত্মক চতুর্বর্গের উপায় প্রবর্তক , বেদের চারিটি ভাগ সংগ্রহ স্বরূপ সর্বশাস্ত্রের সারভূত , সর্বপ্রকার শিল্পের আকরস্বরূপ এবং ইতিহাস সংযুক্ত হবে। “

এইরূপ সংকল্প করে ভগবান লোক পিতামহ ব্রহ্মা চতুর্বেদের অঙ্গসম্ভূত নাট্যবেদ প্রণয়ন করলেন। ঋগ্বেদ হতে গ্রহণ করলেন পাঠ্য অংশ, সামবেদ হতে গীত, যর্জুর্বেদ হতে অভিনয় ও অর্থববেদ হতে নিলেন রস। এই রূপে সর্ববেদবিৎ ব্রহ্মা কর্তৃক চতুর্বেদ ও আয়ুর্বেদাদি উপবেদগুলির সঙ্গে সম্বন্ধ নাট্যবেদ সৃষ্টি হল।

ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্রে ভারতীয় নাট্যবিদ্যা উৎপত্তি সম্বন্ধে যে অপূর্ব কাহিনী বিবৃত হয়েছে তা উক্তরূপ। তারপর ব্রহ্মার নির্দেশে বিশ্বকর্মা নাট্যশালা নির্ম্মাণ করলেন। ব্রহ্মার নির্দেশে মহর্ষি ভরত সেই সৃষ্ট কলাকে কাজে লাগানোর নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কেবল নাট্য ? নাট্যে যদি নৃত্য না থাকে তবে অভিনয় হবে কি করে ? আদিদেব মহাদেব প্রদান করলেন তান্ডবনৃত্য আর আদিপরাশক্তির রূপ শিবের শক্তি পার্বতী দিলেন লাস্যনৃত্য। পদ্মনাভ বিষ্ণু চারপ্রকার নাটকীয় পদ্ধতি আবিষ্কার করে নাট্যকলার প্রবর্তন করলেন। তখন ভরতের উপর ভার হল – তিনি নাট্যশাস্ত্র স্বরূপ দৈব পঞ্চমবেদ পৃথিবীতে নিয়ে এলেন। 

#সঙ্গীত_দামোদরে এই ঘটনায় আরেকটু রকমফের আছে । সেখানে বলা হয়েছে ব্রহ্মার নিকট সকল দেবতারা নন বরং ইন্দ্র গিয়েছিলেন। 

ভারত ঋষি ব্রহ্মার প্রণালী অবলম্বন করে বনের ঋষিদের শিক্ষা দান করেন,  নাট্যশাস্ত্রও প্রনয়ণ করেন। সুরলোকে বেজে উঠে শঙ্খ,

নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক–

এল মহাজন্মের লগ্ন।

আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত

ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।

রম্ভা ,উর্বশী , মেনকারা পেলেন নাট্যশিক্ষা।  নৃত্যের তালে তালে , বাদ্যের মূর্ছনায় নাট্য , নৃত্য, নৃত্ত। ভরত ঋষি নাট্য জ্ঞান দিলেন ধরার অমৃতের পুত্র সন্তানদের ।  তাই নাটকের নাম #ভরত_সূত্র এবং নটের নাম #ভরত_পুত্র। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে নাট্যপ্রকরণের সংক্ষিপ্ত পরিচয় আছে। এই গ্রন্থ অভিনয়ের জন্য তিন রকমের নাট্যমন্ডপের ব্যবস্থা তিনি উল্লেখ করেছেন। 

বিকৃষ্টচতুরস্রশ্চ ত্র‍্য‍স্রশ্চৈব ভূ মণ্ডপঃ 

১ ) বিকৃষ্ট – চতুষ্কোণ

২) চতুরস্র – সমচতুষ্কোণ

৩) ত্র‍্য‍স্র – ত্রিকোণ

নাট্যমন্ডপের পরিমানও তিন রকমের – জ্যেষ্ঠ ,মধ্যম  কনিষ্ঠ।

তেষাং ত্রীণি প্রমাণানি জ্যেষ্ঠং মধ্যং তথাবরম্।

বিকৃষ্ট প্রেক্ষাগৃহ জ্যেষ্ঠ। – জ্যেষ্ঠং বিকৃষ্টং বিজ্ঞেয়ম্।

এটি কেবল দেবতাদের জন্য নির্মিত হতো । – দেবানাং ভূ ভবেজ্জ্যেঠম।  প্রেক্ষাগৃহ দৈর্ঘ্যে ১০৮ হাত । – অষ্টাকিং শতং জ্যেষ্ঠম্। চতুষ্কোণ প্রেক্ষাগৃহ মধ্যম । –  চতুরস্রং তু মধ্যম। রাজা- রাজড়াদের জন্য এটি নির্ধারিত। নৃপণাং মধ্যম ভবেৎ। এর দৈর্ঘ্য ৬৪ হাত । – চতুঃষষ্টিন্তু মধ্যমম্। ত্রিকোণ প্রেক্ষাগৃহ কনিষ্ঠ । – কনীয়স্ত স্মৃতং ত্র‍্য‍স্রম্। এটি ছিল সাধারণ লোকের জন্য নির্দিষ্ট ।  – শেষাণাং প্রকৃতীনাং তু কণীয়ঃ সংবিধীয়তে। এই প্রেক্ষাগৃহের প্রতিবাহুর পরিমাণ ৩২ হাত। – কর্ণয়স্তু তথা বেশ্ম হস্তা দ্বাত্রিংশদিষ‍্যতে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি – আমরা সাধারণত হাত বলতে যা বুঝি এক্ষেত্রে তা ধরলে হবে না। এর মাপকাঠি অন্যরকম।  অনু , রজঃ , বলি , লিখ্যা , যুকা, অঙ্গুলি , হস্ত ও দণ্ড – এই কয়টি দিয়ে সনাতনী মতে মাপ করবার নিয়ম। 

১ দণ্ড – ৪ হস্ত , ১ যব – যুকা , ১ বলি – রজঃ , ১ হস্ত – ২৪ অঙ্গুল , ১ যুকা  – ৮ লিখ্যা , ১ রজঃ – ৮ অনু , ১ অঙ্গুল – ৮ যব , ১ লিখা – ৮ বলি।

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ১. ভারতীয় নাট্যশালার গোড়ার কথা

২. কলকাতার সিনেমা হল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.