পর্ব পাঁচ
প্রচলিত কিংবদন্তি ও ঐতিহাসিক সূত্রগুলি মেলালে দেখা যায় কাষ-ব বা কাস-ব ব্রত প্রবর্তনের পশ্চাতে তাঁর একটি গুরুতর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্ভবত কাজ করে থাকবে।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শনসূত্রে জানা যায়, যে বঙ্গে ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় একটানা বৈদেশিক মরু শাসনের অধীন , তার মধ্যে আকস্মিকভাবে একজন হিন্দুর পক্ষে কয়েক বছরের জন্য হলেও সমগ্র বঙ্গের সিংহাসন অধিকার করাটা যথার্থই বিস্ময়, শক্তি এবং আনন্দের বিষয়।
ইতিহাসে কোন ঘটনাই আকস্মিক ঘটে না। রাজশক্তি অর্জন কোন দৈব ঘটনা দ্বারা চালিত হয় না । রাজা গণেশ দীর্ঘদিন ধরে ইলিয়াসশাহী রাজবংশের একজন প্রভাবশালী হিন্দু অমাত্য ছিলেন তা ইতিহাস-বিদিত। তাঁর বংশ এবং তিনি স্বয়ং রাজশাহীর ভাতুরিয়া পরগনার জমিদার হলেও পরবর্তীকালে পান্ডুয়ায় ইলিয়াসশাহী রাজবংশের অমাত্য থাকাকালীন করঞ্জীতে তাঁর পক্ষে একটি জমিদারি নির্মাণ করা অস্বাভাবিক নয়।
তিনি যে অত্যন্ত ব্যক্তিত্বশালী প্রখর বুদ্ধিমান , কূটনীতিজ্ঞ ও দূরদর্শী মানুষ ছিলেন তার উল্লেখ ইতিহাসে বারংবার উল্লিখিত হয়েছে। এসব তথ্য শ্রদ্ধেয় সুখময় মুখোপাধ্যায়ের রচনা হতে প্রাপ্ত হয়। ফলে অমাত্য থাকাকালীনই সামরিক শক্তির উপর তার প্রভাব ছিল অপরিসীম। কেবলমাত্র তাই নয় , ইতিহাস বলে সুলতানী আমলেই তিনি আপন গরিমা , নেতৃত্ব এবং জনপ্রিয়তার জোরে সামরিক বাহিনী সংগঠিত করেছিলেন। ঐতিহাসিক সূত্র থেকে এ কথাও জানা যায় যে , তাঁর প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি হওয়ার দরুন তিনি ধীরে ধীরে জমিদারি দক্ষিণাভিমুখী একডালা বৈরাহাট্টা পর্যন্ত বাড়িয়ে ছিলেন এবং সেখানে তাঁর পুত্র মহেন্দ্রকে অধিপতি হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। ওই অঞ্চলে মহেন্দ্র নামক একটি গ্রাম এই ঐতিহাসিক বিষয়ে এখনো সাক্ষী।
ইলিয়াস শাহী রাজদরবারের এই ক্ষমতাবান অমাত্যকে গিয়াসউদ্দিন আজমশাহ ধর্মান্ধতার বশবর্তী হয়ে পদচ্যুত করে। ফলে অমাত্য গণেশ গোঁড়া বৈদেশিক মরুবংশের উচ্ছেদকল্পে নানান গুপ্ত পন্থা গ্রহণ করেছিলেন। বোধকরি , এই ব্রত তারই একটি অঙ্গ স্বরূপ।
করঞ্জী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি দশম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত হিন্দু বা সনাতনী রাজবংশ ও হিন্দুধর্মের অধীনস্থ ছিল তা এই অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত মূর্তিগুলি থেকে প্রতীয়মান হয় । দিনাজপুর জেলার ভাষা ও সংস্কৃতিতে এখনো যাদের প্রাধান্য রয়েছে তারা দেশী বা
দেশীয়া এবং পলি বা পলিয়া বলে পরিচিত । করঞ্জী গ্রাম হতে প্রাপ্ত ত্রিবিক্রম বিষ্ণুর যে মূর্তি পাওয়া যায় তার শিলালিপিতে উল্লেখিত আছে #পলেরয়েং_ঠক্কুরঃ বা পলিদের ঠাকুর। H.E Stapleton – J.P.V.S.B Vol.XXVII – তে এই সব তথ্য আপনারা পেয়ে যাবেন। ১৯৩২ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার পর ডঃ সেন সঙ্গে এ বিষয়ে শিশির মজুমদার আলোচনাও করেন। তবে , এ বিষয়ে কোনো লিখিত প্রতিবাদ পত্র শিশির মজুমদার মহাশয়ের নিকট ছিল না। তবে শিশির মজুমদারকে উক্ত শিলালেখটি ডঃ সেন পাঠ করে ডঃ সেন জানিয়ে ছিলেন – বলিবধং ঠক্কুরঃ । অর্থাৎ বালিকে বধ করেছিলেন যে ঠাকুর ।
তবে বলি বা পলি যাই হোক না সেটি বিষ্ণু মূর্তি তা নিয়ে দ্বিমত নেই। এর থেকে অনায়াসে উপলব্ধি হয় যে সুপ্রাচীন কাল হতে এই অঞ্চলে সনাতনী পলিয়াদের বেশ প্রাধান্য ছিল। রাজা গণেশ সম্ভবত সেই সকল সুপ্রাচীন ও শক্তিশালী জাতিকে আপন পাইক ও সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন।
উক্ত ব্রতীদের চেহারার মধ্যে আজও কিছু কিছু পলিয়া জাতির ছাপ পরিলক্ষিত হয়। ধারণা করা হয়, এই অঞ্চলের দেশী ,পলি ইত্যাদি জাতির মধ্যে যাঁরা রাজা গণেশের পাইক ও সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন , তাঁরাই গণেশ সম্প্রদায় নামে অভিহিত হন। তবে , এবিষয়ে গবেষণার যথেষ্ট অবকাশ আছে।
করঞ্জী গাঁয়ের কয়েক মাইল দূরে যে হাট বসে তার নাম আগদুয়ার। সম্ভবত সেটি ছিল রাজপ্রাসাদের অগ্রবর্তী দ্বার। আর গণেশ পাড়ার ভিতরে ছিল পাছদুয়ার হাট। আর সেটি হয়তো পশ্চাদবর্তীদ্বার। উল্লিখিত ঢিপিগুলি প্রাসাদ মন্দির ইত্যাদির ধ্বংসাবশেষ মাত্র সেকথা পূর্ব পূর্ব পর্বে উল্লেখ করেছি। প্রাসঙ্গিক যে কিংবদন্তি আছে তাও রাজপ্রাসাদেরই সাক্ষ্য দেয়।
ছাচিকাদেবীর মন্দির এবং তার ভাস্কর্য দেখে উপলব্ধি হয় যে , এই কীর্তি স্বয়ং রাজা গণেশের। তিনি ছিলেন চণ্ডীর উপাসক একথা সকলেই জানেন। দেবী ছাচিকাই মা চন্ডী । তাই তিনি প্রতি মঙ্গলবার আজও নিয়মিত পূজা পেয়ে আসছেন।
কাষ- ব বা কাস-ব ব্রতের সমগ্র আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে লৌকিক বিশ্বাস ও রীতিনীতি যুক্ত থাকলেও একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণই এর প্রবর্তক নিদর্শন মেলে । কিংবদন্তিতেও এর সংকেত পাওয়া যায় । তাছাড়া কংস বধের ঘটনা অঞ্চলের সকল মানুষের মধ্যে সুবিদিত। পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে ধাওয়াইল গাঁয়ে একটি বেদীর মধ্যে ভগ্ন নারায়ণ মূর্তিকে কংসবধের থান রূপে পূজা করা হয় । তাছাড়া দুষ্ট কংসবধের বিষয়টিকে ব্রতরূপে পালনের নির্দেশ দিয়ে রাজা কি তাঁর পাইক , সৈন্যবাহিনী ও অন্যান্য সনাতনী প্রজাগণকে পরাধীনতার ও শত্রু নিধনে উৎসাহিত করেছিলেন। কেননা পূর্বেই বলেছি যে এই ব্রতের ব্রতীরা সকলেই ব্রত পালনের নিমিত্ত নিষ্কর জমি ভোগ করেন।
আলোচ্য ব্রতে বহু লৌকিক নিয়ম ও পূজাবিধি লক্ষণীয়। অনেক সময় রাজ নির্দেশ প্রবর্তিত শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠান সেই রাজার পতনের ফলে ধীরে ধীরে লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে যায়। অর্থাৎ লৌকিকব্রত থেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত শাস্ত্রীয় আচারযুক্ত ব্রত এবং লৌকিক ব্রত। আলোচ্য ব্রতে এমন বহু নিদর্শন মেলে।
জনশ্রুতি থেকে উপলব্ধি করা যায় , করঞ্জী মস্তিষ্ক এবং একডালা বৈরাহাট্টার নিকটবর্তী ধাওয়াইল হয়ে পাণ্ডুয়ার সন্নিকটস্থ যাত্রাডাঙ্গি পর্যন্ত তা প্রসারিত। এর মধ্যে হয়তো লুকিয়ে আছে রাজা গণেশের কোন রণকৌশল । সম্ভবত ব্রতের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর সামরিক বাহিনী দিয়ে ধীরে ধীরে পাণ্ডুয়া ঘিরে ধরেছিলেন। ইতিহাসে উল্লিখিত হয়েছে সে ঘটনা । গিয়াসসুদ্দিনের মৃত্যুর পর রাজা গণেশ ধীরে ধীরে দুই বৎসরের সময় নিয়ে তবে রাজা হতে পেরেছিলেন ।
প্রসঙ্গত লক্ষণীয়, যে এই ব্রত থেকে এটাও প্রমানিত হয় যে রাজা গণেশ জমিদারী অংশে অহিন্দুদের উপরও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন এবং গিয়াসউদ্দিন উচ্ছেদে তিনি হয়তো তাঁদের কিছু অংশকে সুকৌশলে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এই ব্রত যে কঠিন সংযম ও নিষ্ঠার সাধনা, প্রাচীন সনাতনী বিশ্বাস পরিলক্ষিত হয় , তা থেকে অনুমিত হয় রাজা গণেশ কিভাবে শত্রু হত্যায় তার বাহিনীকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছিলেন। আহূতি থানের হাঁড়ি থেকে যে হালকা ওঠে তার মাধ্যমে তিনি হয়তো কোনো গোপন সংকেত রচনা করতেন। অথবা এটা হয়তো যুদ্ধ বিজয়ের উল্লাস প্রকাশের একটি রূপ মাত্র ।
আজও দিনাজপুর জেলার কিছু গ্রামে উৎসব উপলক্ষে বিশেষত নবান্নে মাংস কাটার পর একটি মাটির হাঁড়িতে মাংস চর্বি পুড়িয়ে জল ঢেলে হালকা তোলা হয়। তখন গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা আনন্দে কাস-ব ধ্বনিতে ফেটে পড়েন।
করঞ্জী গ্রামে আহূতি জাগানোর থানে মাটি চাপা আগুন সম্পর্কে গ্রামবাসীদের প্রচলিত বিশ্বাস থেকে মনে করা যেতে পারে যে ইলিয়াস-শাহী সুলতানদের বিরুদ্ধে রাযা গণেশ যে যুদ্ধ রচনা করেছিলেন তা মূলত করঞ্জী থেকেই সূচিত ও পরিচালিত হতো।
যোগ চিহ্নের মতো মাটি খুঁড়ে হিন্দুদের চিতা সাজানোর পদ্ধতির মতো যজ্ঞকুণ্ডটি নির্মাণের মধ্যেও হয়তো গণেশের কোন রাজনৈতিক কৌশল লুক্কায়িত।
কংসব্রত – কংসরাজার থান, তার মধ্যে অবশ্যই কোনো না কোনো ঐতিহাসিক সত্য লুক্কায়িত আছে। সুপ্রাচীন বিরাট রাজ্য, ভীম তাঁরই সাক্ষ্য বহন করে। তবে , রাজার গণেশের দুর্ধর্ষ উত্থানের পর, তিনি বৈদেশিক গোষ্ঠীর নিকট #কাণস নামে পরিচিত হন। মুদ্রায় তাঁকে কানস রাউ বা কানস শাহ বলে উল্লেখ রয়েছে। ইন্দো-পারসীক ইতিহাসবিদরা তাঁকে রাজা কংস বা কানসি বলে উল্লেখ করলেও , ভারতীয় পন্ডিতগণ একে সংস্কৃত গণেশ শব্দের ভুল আরবি বানান বলেই মনে করেন। আধুনিক কিছু পণ্ডিত তাঁকে দনুজমর্দন দেব বলেও উল্লেখ করেছেন।
তবে, তিনটি সূত্র মনে রাখা উচিৎ- ১. কর্ষণ থেকে কনস, কাস-ব, কাষ- ব হয়েছে।
২. প্রাচীন বিরাট রাজ্য, শ্রীকৃষ্ণের কংসবধের ঘটনা ইত্যাদি রাজা গণেশকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল এক ঐক্যবদ্ধ হিন্দু যোদ্ধাবাহিনী গঠন করতে এবং দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করতে।
৩. গণেশ রাজা তাঁর দুর্ধর্ষ শক্তির নিমিত্ত দুর্বৃত্তদের নিকট কাণস নামে পরিচিত হন।
কাল হতে কালে সকল কিছু লোকভাবে, লোকচিন্তাধারায় মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। এছাড়াও এই অঞ্চলের প্রচলিত সত্যনারায়ণের মধ্যে এইচ.ই. স্টেপেলটন গণেশ কাহিনীর কিছু ছায়াপাত দেখা যায়। এঅঞ্চলের বহু লোকগাথা ,লোকগান আজ হারিয়ে গেছে। বলা যায় সেগুলি দুর্লভ্য। আরো দুঃখের বিষয় কোনো এক অজানা কারণে এসব স্থানে সংঘবদ্ধ এবং পরিকল্পনানুসারে ক্ষেত্র গবেষণার অভাবে বহু পুঁথি ও মূল্যবান মূর্তি আজ লুপ্ত হয়ে গেছে।
সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. উত্তর গ্রামচরিত
২. পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা -১ ম খণ্ড
৩. মধুপর্নী শারদীয়া
৪. বিরাট