এস্পাসিটো বুধবার রাতে পিয়াজ্জার কুড়ি ফুট মারাদোনা-ম্যুরালের সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন। ভদ্রলোক বিখ্যাত কেউ নন। তাঁকে চেনার কথাও নয়। তাঁর দু’টো পরিচয়। এক, তিনি ইতালীয়। দুই, দিয়েগো মারাদোনার (Diego Maradon) চির উপাসক। ভাল করে কথা বলতে পারছিলেন না আন্তোনিও। বিলাপ করে শুধু বলছিলেন, “শেষ হয়ে গেল, সব শেষ হয়ে গেল। নেপলস শহরটার হৃদয়ের একটা অংশেরই আজ থেকে চিরমৃত্যু ঘটে গেল।’’
এ তো গেল একটা চিত্র। অন্যদিকে, দিয়েগোকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে প্রিয় স্টেডিয়ামই মারাদোনার নামে করে দিচ্ছে শোকার্ত নেপলস। এখানেই শেষ নয়, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ইউরোপা লিগের (Europa League) ম্যাচে প্রিয় তারকার ১০ নম্বর জার্সি পরে মাঠে নামলেন নাপোলির (Napoli) ফুটবলাররা।
দিয়েগোর প্রয়াণের খবরটা যখন জানাজানি হয়, নেপলসের জনপ্রিয় একটা টিভি শো চলছিল। কিন্তু সে সব বন্ধ করে মারাদোনার প্রয়াণের খবর দেখানো শুরু হয়ে যায়। বেশিক্ষণ লাগেনি তারপর। কাতারে কাতারে লোক নেমে পড়েন রাস্তায়। প্রিয় নাপোলি ক্লাবের জার্সি পরে। ভেজা চোখে, হাতে মোমবাতি নিয়ে। সঙ্গে গলায় দুঃখের গান– ফুটবলের রাজা, নাপোলির রাজা, তুমি আর নেই। কে আবার মুহূর্তে দ্রুত প্রোজেক্টর বসিয়ে দিলেন রাস্তায়। দেখানো শুরু হয়ে যায়, মারাদোনার ফুটবলজীবনের সব হিরে-জহরত। মণি-মাণিক্য।
নাপোলি সমর্থকদের একটা রীতি আছে। টিম জিতলে-টিতলে লাল ধোঁয়ায় তাঁরা আকাশ ঢেকে দেন। কিন্তু গত রাতে রীতি ভাঙল নাপোলি। এক অশীতিপর বৃদ্ধাকে কোথা থেকে যেন হাজির হয়ে যান বাড়ির ব্যালকনিতে। চিৎকার করে ডাক দেন, লাল ধোঁয়ায় প্রিয় দিয়েগোকে শেষ কুর্নিশ দিতে। যা তৎক্ষণাৎ শোনে শহর। রাতের আকাশ রাঙিয়ে দেয় ভালবাসার লাল রংয়ে। বার্সেলোনা থেকে যখন নাপোলিতে এসেছিলেন মারাদোনা, গোটা ফুটবলবিশ্বের ভ্রূ কুঁচকে গিয়েছিল। নাপোলির না ছিল কোনও কালে আভিজাত্য, না ছিল ঐতিহ্য। কিন্তু নাপোলি সমর্থকদের ইতিহাসের তাদের সেরা সুখের সময়টা উপহার দিয়ে যান মারাদোনা। নইলে কোনও এক সিরো পিস্তানো মারাদোনা মহাপ্রয়াণের পর আর বলবেন কেন, প্রতি রবিবার দুপুরের লাঞ্চ বাদ দিয়ে তিনি মারাদোনাকে দেখতে যেতেন। মা-র বকুনি উপেক্ষা করে। কেনই বা নাপোলি শেষ বিদায়ের সময় আর্তনাদ করে বলবে– দিয়েগো, তুমি আমাদের অপ্রতিরোধ্য করে দিয়েছিলে।
আসলে ইতালির এই শহরে দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা নিছক এক ফুটবল মহাতারকা ছিলেন না। নিছক ফুটবলার-সমর্থকের সম্পর্ক ছিল না মারাদোনার সঙ্গে নেপলসের। দিয়েগো ইতালির এই শহরের কাছে ছিলেন তার অনেক বেশি কিছু, একান্ত আপন, নেপলসের প্রতিটা পরিবারের আত্মজ। আসলে দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা নামক তারকা-বলয়ের ভেতরের মাটির মানুষটাকে দেখতে পেয়েছিল নাপোলি। তাঁর প্রতিবাদী চরিত্র দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, শূন্য থেকে শুরু করেও বিশ্বজয় করা যায়।
তাই প্রিয় দিয়েগোকে শেষ বিদায়টাও দিল নেপলস বড় স্বতন্ত্র ভাবে। আবেগের ফুল-ফুলে ভরিয়ে। নাপোলির স্টেডিয়াম, যার নাম সান পাওলো স্টেডিয়াম, সেটাকে দিয়েগোর মারাদোনার নামে করা হচ্ছে বলে এ দিন ঠিক করে ফেললেন নাপোলি মালিক এবং নেপলস মেয়র। স্টেডিয়ামের বাইরে সমর্থকরা আবার অতিকায় তিরিশ ফুটের এক ব্যানার তৈরি করলেন। যাতে লেখা– কিং। রাজা। কেউ আবার রাজপথে নিজেদের দোকানের সামনে পোস্টার সেঁটে দিলেন ফুটবলের রাজপুত্রের। যাতে লেখা– মারাদোনা, নেপলস আজ কাঁদছে। কী নাম দেবেন এই সম্পর্কের? একটাই মাথায় আসে– পিতা-পুত্র।