বাঙ্গালির প্রধান খাদ্য ডাল-ভাত। প্রোটিন খাদ্যের একটি উৎকৃষ্ট উৎস হল ডাল। ১০০ গ্রাম ডিম থেকে পাওয়া যায় ১৩.৩ গ্রাম প্রোটিন এবং ১৭৩ কিলো ক্যালোরি শক্তি। সেক্ষেত্রে সমপরিমাণ মুগ ডাল থেকে পাওয়া যায় ২৪.৫ গ্রাম প্রোটিন এবং ৩৪৩ কিলো ক্যালোরি শক্তি। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের সুপারিশ অনুযায়ী প্রতিদিন ৪৭ গ্রাম ডাল খাওয়া উচিত।

ডালের ফলন বাড়াতে ও ডালচাষ লাভজনক করতে প্রয়োজন
১) ভালো জল নিকাশি যুক্ত উচু দোয়াশ মাটিতে চাষ।
২) নিরপেক্ষ বা প্রশম মাটিতে চাষ।
৩) জমিতে জৈবসারের অধিক ব্যবহার।
৪) উন্নত জাতের বীজ এবং সঠিক সময়ে ও মাত্রায় বপন।
৫) বীজ শোধন এবং সঠিক মাত্রার সঠিক জীবাণু সার ব্যবহার।



রাসায়নিক সারের মাধ্যমে ডাল শস্যে চাষের প্রথাগত পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে আমরা যদি জৈব প্রযুক্তিতে বিশেষত জীবাণু সারের মাধ্যমে ডাল শস্যের চাষ করি তাহলে পরিবেশ দূষণের পরিমাণ কমার সাথে সাথে জমির উর্বরতাও অনেকখানি বৃদ্ধি পায়।

জীবাণু সারের সুবিধাঃ
১) প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে জমির উর্বরতা বাড়িয়ে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে।
২) পরিবেশ দূষণের সম্ভবনা দূর করে।
৩) উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে কমিয়ে দেয়।
৪) প্রযুক্তি হিসাবে সহজেই কৃষকের গ্রহণযোগ্য হয়।
৫) রাসায়নিক সারের অপচয় কমায়।

_রাইজোবিয়ামঃ_
রাইজোবিয়াম একটি জীবাণু। এই জীবানু সাধারণত মাটিতে ও শিম্বীগোত্রীয় গাছের (মুসুর, মুগ, ছোলা, বরবটি ইত্যাদি) শেকড়ে বসবাস করে। যার ফলে শিকড়ে ছোট ছোট গুটির সৃষ্টি হয় এবং ওই গুটির মধ্যে নাইট্রোজেন আবদ্ধ হয়। রাইজবিয়াম জীবাণু সার ব্যবহার করলে নাইট্রোজেন সার খুব কম দরকার হয়। কাজেই এটি একটি পরিবেশ-বান্ধব জীবাণুসার।

_রাইজোবিয়াম জীবাণু সার কিভাবে উপকার করেঃ_
১) গাছের পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেনের শতকরা ৭০- ৭৫ ভাগ সরবরাহ করে।
২) উদ্দীপক জৈব যৌগ বা হরমোন সরবরাহ করে গাছের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
৩) ফলন প্রায় শতকরা ২০-৩০ ভাগ বৃদ্ধি করে।
৪) প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন ফসলে বিঘা প্রতি ৭-৮০ কেজি নাইট্রোজেন যোগান দেয়।
৫) বিঘা প্রতি ৩-৬ কেজি সঞ্চিত নাইট্রোজেন পরবর্তী ফসলকে সরবরাহ করে।
৬) কৃষি-বাস্তুতন্ত্রে পরিবেশ দূষণ রোধ করে।

_ফসফেট দ্রবণকারী জীবাণু সারঃ_
ফসফেট দ্রবণকারী জীবাণু মাটিতে-আবদ্ধ (অব্যবহার যোগ্য) ফসফরাসকে দ্রবণীয় করে গাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। জমিতে ব্যবহৃত ফসফরাসে প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ গাছ গ্রহণ করতে পারে না। কার্যকারিতা মাত্র ২০ শতাংশের মতো। এই জীবাণু সার প্রয়োগ করে ফসফরাসের গ্রহণযোগ্যতা বা কার্যকরিতা বৃদ্ধি করা যায়। মাটিতে বসবাসকারী ব্যাসিলাস এবং সিউডোমোনাস ব্যাকটেরিয়া এবং আস্পারজিলাস ও পেনিসিলিয়াম ছত্রাক এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য। বিশেষত ফসফেট দ্রবণকারী ব্যাকটেরিয়া প্রজাতিগুলিকে জীবাণু সার হিসাবে প্রয়োগ করা হয়। যেকোনো ফসলের ক্ষেত্রে এই জীবাণুসার ব্যবহার করা যায়।

_কিভাবে উপকার করেঃ_
১) ফসলের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় ফসফেটের ৩০-৪০ শতাংশ সরবরাহ করে।
২) গাছের শিকড়ের বৃদ্ধি ঘটায়।
৩) ফলন ১০-২০ শতাংশ বৃদ্ধি করে।

_রাইজবিয়াম ও ফসফেট দ্রবণকারী জীবাণুসার প্রয়োগ বিধিঃ_
প্রায় ২০ গ্রাম ঝোলা গুড়, ২০০-২৫০ মিলি জলে গুলে তা সামান্য ফুটিয়ে নিয়ে ঠাণ্ডা করে, বা বাবলার আঠা, অ্যারারুট, ভাতের মাড় ইত্যাদির সাথে বিঘা প্রতি ২০০ গ্রাম জীবাণু সার ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। বোনার জন্য বাছা বীজগুলিকে প্রথমে ঠাণ্ডা জলে আধ ঘণ্টা ভিজিয়ে জলে ফেলে ওই বীজ ব্যবহার করলে ভালো হয়। এর পর বীজের সাথে জীবাণু সারের মিশ্রণ ভালোভাবে মিশিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে বীজ বপন করতে হবে। প্রতি কেজি বীজের জন্য কমপক্ষে ২০ গ্রাম জীবাণু সার লাগবে। এ ছাড়া জৈব সারের সাথে জীবাণু সার ভালোভাবে মিশিয়ে সরাসরি জমিতে প্রয়োগ করা যায় ( জৈব সার হেক্টর প্রতি ২০ টন)।

_বিভিন্ন শস্যের উপযোগী রাইজোবিয়াম বা জীবাণুর প্রজাতি:_
গোষ্ঠীর নাম
গোষ্ঠীর অধীনস্থ শস্য
_রাইজোবিয়াম_ প্রজাতির নাম

১) “আলফা আলফা গোষ্ঠী”
আলফা- আলফা, লুসার্ণ, মেথী, মেলিলোটাস্
_এনসিফার মেলিলোটি_

২) “ক্লোভার” গোষ্ঠী
ক্লোভার, বারসীম
_রাইজোবিয়াম ট্রাইফলী_

৩) “বীণ” গোষ্ঠী
বীণ বা রাজমা
_রাইজোবিয়াম ফ্যাসিওলী_

৪) “লিউপিন” গোষ্ঠী
লিউপিন
_রাইজবিয়াম লিউপিনি_

৫) “মটর” গোষ্ঠী
মটর, ডেচ্, মুসুর, খেসারী
_রাইজোবিয়াম লেগুমিনসেরাম_

৬) “সয়াবিন” গোষ্ঠী
সয়াবিন
_ব্রাডি রাইজোবিয়াম জ্যাপানিকাম_

৭) “বরবটি” গোষ্ঠী
বরবটি, অড়হর, মুগ, কলাই, ছোলা, চীনা বাদাম
_রাইজোবিয়াম স্পিসিস_


সর্বাধিক উপকার পেতে করণীয়ঃ
১) বিভিন্ন শিম্ব জাতীয় ফসলের জন্য বিভিন্ন প্রজাতির রাইজোবিয়াম নির্দিষ্ট। সেই জন্য মাটির প্রকৃতি ও ফসল বিশেষে সঠিক প্রজাতির রাইজোবিয়াম প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
২) প্রয়োগ বিধি সঠিক ভাবে পালন করা।
৩) সঠিক গুণমান সম্পন্ন জীবাণু সার কেনা।
৪) রাইজোবিয়ামের কার্যকরিতা বৃদ্ধির জন্য বিঘা প্রতি ১০ কুইন্টাল জৈব সার প্রয়োগ করা।
৫) জীবাণু সার মেশানো বীজ রোদে শুকান যাবে না এবং নির্দিষ্ট দিনেই বুনতে হবে।
৬) জীবাণু সার প্রয়োগের ১ সপ্তাহ আগে বা পরে জৈব কীট নাশক বা রোগ নাশক মেশানো যাবে না।

_বিভিন্ন ডাল শস্যের কয়েকটি উন্নত জাতের নামঃ_
কলাই- সারদা, গৌতম, উত্তরা, পন্থইউ- ৩১,
মুগ- সম্রাট, পন্থ মুগ-২, আই পি এম ০২-০৩, আই পিত্রম- ৯৯-১২৫, এস এম এল- ৬৬৪

মুসুর- সুব্রত, মৈত্রী, আশা, মল্লিকা

ছোলা- অনুরাধা, মহামায়া, বিজি ২৫৬, জিসিপি ১০৫

খেসারী- রতন, প্রতীক, নির্মল

মটর- রচনা, অর্পণা, অরকেল, ডিডিআর- ২৩

_ডাল শস্যের পোকাঃ_
ডাল চাষে কত গুলি বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তার মধ্যে শস্য রক্ষার বিষয়টি অন্যতম।
ডাল শস্য চাষ করলে যে সমস্ত পোকা গুলি প্রভূত ক্ষতিসাধন করে তা হল —
শুঁটি ছিদ্রকারি পোকা,শুঁটির মাছি, কাটুই পোকা, লাল শুঁয়ো পোকা, ল্যাদা পোকা, জাব পোকা, সাদা মাছি ইত্যাদি।

_ডাল শস্যের বিভিন্ন রোগঃ_
ডাল শস্যের অন্যতম কতকগুলি রোগ হল-
ঢলে পড়া, বাদামি দাগ ধরা, ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ (পাতায় দাগ), হলুদ কুটে রোগ, সাদা গুঁড়ো ছত্রাক, মরিচা বা ধুসর ধসা রোগ ইত্যাদি।

_ডাল শস্যের সুসংহত শত্রু নিয়ন্ত্রণ_
ডাল শস্যের এই রোগ, পোকা বা অন্যান্য শত্রু দমন করতে হলে আমাদের বিজ্ঞান-ভিত্তিক উন্নত চাষের বিভিন্ন প্রযুক্তি যেমন-
১) উন্নত ও রোগ পোকা সহনশীল জাত চাষ করতে হবে।
২) পরিচর্যাগত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৩) যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং
৪) জৈবিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলো মেনে চলতে হবে।
তাহলে আমরা খুব কম খরচে ফলন বাড়িয়ে লাভ জনক ভাবে ডাল শস্যের চাষ করতে পারব।

_ক) সহনশীল জাত নির্বাচনঃ_
এ জন্য আমাদের প্রথমেই ডালের রোগ পোকা সহনশীল উন্নত জাত ব্যবহার করতে হবে। সহনশীল জাত চাষ করলে রোগ পোকা আক্রমণের প্রাদুর্ভাব অনেক কম হয়, ফলে নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ হয়।

_খ) পরিচর্যাগত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাঃ_
১) যে কোন ডাল শস্য বীজ শোধন করে বোনা উচিত। এ জন্য প্রতি কেজি বীজের জন্য ২-৩ গ্রাম ছত্রাক নাশক জীবাণু ট্রাইকোডারমা বীজ বোনার ৭-১০ দিন আগে বীজের সাথে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হয়।
২) ডাল শস্য শিম্ব জাতীয় ফসল হওয়ায় এদের শিকড়ের গুটিতে নাইট্রোজেন আবদ্ধ হয়। বীজ বোনার আগে সঠিক রাইজোবিয়াম জীবাণুসার জমিতে দিন ও বীজের সাথে মিশিয়ে ছড়ান। জীবাণু প্রয়োগের ৭-১০ দিন আগে ছত্রাক নাশক দিয়ে বীজ শোধন করে রাখুন না হলে ওই ছত্রাক নাশক গুলি জীবাণুকে মেরে ফেলবে।

_গ) জৈবিক নিয়ন্ত্রণ:_
অন্যান্য ফসলের মতো ডাল শস্যেও অনেক উপকারী বন্ধু পোকা বা মিত্র জীবাণু দেখা যায়। এরা আমাদের জমির মধ্যেই আছে। এদের চিনতে হবে এবং সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া মাটিতে উপকারী জীবাণুদের বংশ বৃদ্ধির জন্য মাটিতে জৈব সার বেশি করে দিতে হবে।

ঘ) _ডাল শস্যের বিভিন্ন মিত্র জীবাণু_
রাইজবিয়াম ব্যাকটেরিয়া ছাড়া অ্যাজেটোব্যাক্টর, এজোস্পাইরিলাম ও পি.এস.বি. ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়া যেমন ডাল চাষে উপকার করে তেমনি বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক বা ভাইরাস আছে যারা ডালের বিভিন্ন শত্রু পোকা ও রোগের জীবাণুকে ধ্বংস করে আমাদের উপকার করে। এই সকল মিত্র জীবাণু বা পোকা আমরা বিভিন্ন ভাবে আমাদের ডাল শস্য জমিতে কাজে লাগাতে পারি। যেমন-
১) বীজ শোধনঃ ট্রাইকোডারমা বা গ্লিওক্লাডিয়াম ভাইরেন্স ৪-৫ গ্রাম প্রতি কেজি বীজের সাথে মিশিয়ে বীজ শোধন করলে ডালের ঢলে পড়া, শিকড় পচা রোগের সম্ভাবনা কমে যায়।
২) এন.পি.ডিঃ হেক্টর প্রতি ২৫০ এল ই ৭০০ লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করে কাটুই পোকা বা শুঁটি ছিদ্রকারি পোকা দমন করা যায়। এই ধরনের স্প্রে বিকেলের দিকে এবং ল্যাদা পোকার প্রথম ও দ্বিতীয় দশায় ১ সপ্তাহ অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
৩) বি.টিঃ কাস টাকি বা ইস্ত্রালেনসিস যদি হেক্টর প্রতি ৫০০মিলি গ্রাম স্প্রে করা যায় তবে শুঁটি ছিদ্রকারি পোকা ও কাটুই বা অন্যান্য ল্যাদা পোকা দমন করা সম্ভব।
৪) ট্রাইকোডারমাঃ বোলতার ডিমের কার্ড @৫০,০০০ প্রতি হেক্টর জমিতে ব্যবহার করলে শুঁটি ছিদ্রকারি, কাণ্ড ছিদ্রকারি ইত্যাদি পোকার ডিমকে ধ্বংস করে।
৫) উদ্ভিদজাত কীটনাশক জলে গুলে স্প্রে করলে, এছাড়া নিম খোল, করঙ্গা খোল জমিতে দিলে ঢলে পড়া রোগ, উই পোকা, নিমাটোড, বা কাটুই পোকার উপদ্রব কমে।

[ *লেখক পরিচিতি: কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল (Krishnendu Mandal), বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক-ছাত্র* ]

_প্রস্তুত প্রবন্ধটি ‘ভারতীয় কিষান বার্তা’-র জৈবকৃষি বিশেষ সংখ্যার অন্তর্গত। ১লা ডিসেম্বর, ২০২০। সম্পাদক ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।_ ( _Bharatiya Kishan Barta, Organic Farming Special Issue, 1 December, 2020, Editor: Dr. Kalyan Chakraborti)_

কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.