[ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ, পশ্চিমবঙ্গ প্রান্তের নানা স্তরের কার্যকর্তা, সদস্য এবং ‘ভারতীয় কিষান বার্তা’-র পাঠক মহলের মতামত, অভিব্যক্তি, ইচ্ছা ও আশার নানান ঝলক প্রস্তুত কলমে পরিবেশিত হল। এখন থেকে ‘ভারতীয় কিষান বার্তা’-র প্রতিটি সংখ্যায় এইরকম পাঠকের কলম তুলে ধরা হবে। আপনাদের সকলকে স্বাগত জানাই। পাঠক তার বিস্তারিত পরিচয় দিয়ে, একটি ছবি সহ মতামত, সংবাদ প্রেরণ করতে পারেন। জেলার কার্যকর্তাদের মারফত আপনার লেখা পাঠান। এই সংখ্যায় যারা লিখেছেন: শ্রী চিকুর কুমার রায়, শ্রীমতী পিঙ্কি ঘোষ, শ্রী উজ্জ্বল মাহাতো। ]
*১.*
*জৈবিক চাষ : সুস্বাস্থ্যের আশ্বাস*
“ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকায় মাথা”। আমার দেশ ভারতবর্ষ, “সুজলাং সুফলাং শস্য শ্যামলাং মাতরম। বন্দেমাতরম্।” রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করে দেশের মাটি, বায়ু, জল, ও খাদ্যদ্রব্য বিষাক্ত উঠছে এবং কৃষকের উৎপাদন-খরচ বহুগুণ বেড়ে গেছে। ফলে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন কৃষিজীবি বন্ধুরা, কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় কৃষি বিভাগ জৈবিক চাষের প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা করতে “পরম্পরাগত কৃষি” প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অবৈজ্ঞানিক ব্যবহারের কুপ্রভাব থেকে কৃষি জমি, জনস্বাস্থ্য, ও ভূগর্ভস্থ জল বাঁচাতে জৈবিক কৃষিই একমাত্র উপায়। জৈবিক চাষের জন্য যে সমস্ত জৈবসার ও কীটনাশক প্রয়োজন তা আমরা বাড়িতে বা স্বদেশী সার উৎপাদন সংস্থা থেকে নিয়ে ব্যবহার করলে দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ মজবুত হবে। ভর্তুকিযুক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে না। এছাড়াও জৈবিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসল বিশ্ববাজারে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে। আশাকরা যায়, আগামী দিনে বিশ্বের বাজার আমাদের কৃষক ও কৃষিজীবি বন্ধুদের জন্য উন্মুক্ত হবে। ফলস্বরূপ কৃষকের উপার্জন বৃদ্ধি পাবে, ফসলের নায্য মূল্য পাবে এবং অভাবী বিক্রি করতে হবে না।
আমাদের দেশ ভারতবর্ষ কৃষিনির্ভর। ভারতীয় সংস্কৃতির মূলাধার কৃষি ও কৃষিকৃষ্টি। কৃষি ভিত্তিক সংস্কৃতিই ছিল সর্বজনমান্য সংস্কৃতি। ভারতীয় কৃষিজীবি বন্ধুদের জন্য জৈবিক কৃষিই একমাত্র উত্তরণের পথ, কারণ তা কৃষিকৃষ্টির সামীপ্যে-সান্নিধ্যে অবস্থান করে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত “বিষ মুক্ত কৃষি, ঋণমুক্ত কৃষক। বিষ মুক্ত আহার, আত্মনির্ভর ভারতবর্ষ ।”
আগামী প্রজন্মকে পুষ্টি সমৃদ্ধ আহার ও সুস্থ পরিবেশ ও পরিশুদ্ধ পানীয় জল উপহার দিতে অবিলম্বে জৈব পদ্ধতিতে চাষ বাড়াতে হবে, প্রাকৃতিক চাষ করতে হবে। আপনি যে পেশায় নিয়োজিত থাকেন না কেন, যত বড় পদাধিকারী হোন না কেন, কৃষকের দ্বারে পুষ্টি ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে হাজির হতেই হবে। আপনি যদি কৃষি ও কৃষক বন্ধুদের বাঁচাতে সচেষ্ট না হোন তাহলে’ আপনি’ বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই, আপনার ষোলো আনাই বৃথা জীবন। আসুন সকলেই দেশের মাটি, জল, বায়ু ও কৃষকের স্বার্থে জৈবিক চাষে সহযোগিতা করি, জৈব খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করি, রোগমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করি। পরিশেষে বলতে চাই “জৈব কৃষক আমার চিকিৎসক।”
— *চিকুর কুমার রায়, গ্যালাক্সি অর্গানিক ফার্মিং সোসাইটি, আরামবাগ, হুগলী*
*২.*
*পরিবেশের স্বার্থেই জৈবচাষের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে*
আমার দৈনন্দিন জীবনে রোজ কিছু পরিমাণ শাকসব্জি ও ফল খাওয়ার কথা বলেন চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদেরা। শাক-সব্জি ও ফল খাওয়া স্বার্থের জন্য অবশ্যই ভালো। কিন্তু সচরাচর এবং সর্বত্র আমরা যে সব্জি খাচ্ছি, ফল গ্রহণ করছি তা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উত্তম, কতটা নিরাপদ তা যাচাই করে দেখি কী! কী গরীব, কী ধনী, পৃথিবীর সর্বত্র, প্রায় সব দেশেই বর্তমানে বাণিজ্যিক উৎপাদিত শাক-সব্জিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক সার উচ্চমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়। ফসল সুরক্ষায় রসায়নের যথেচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সঙ্গে বেড়েছে শাক সব্জি সংগ্রহের পর কীটনাশক প্রয়োগ এবং জীবাণুমুক্ত করার বিভিন্নরকম রাসায়নিক প্রক্রিয়া। বিভিন্ন পর্যায়ে শাক-সব্জি গ্রহণ ক্রমেই মানবদেহের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। তাই এখন শাক সব্জি খাওয়া কতটা নিরাপদ, তা আমাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা জৈব পদ্ধতিতে শাক সব্জি ফলিয়ে বিষমুক্ত খাবার খেতে প্রয়াসী হতে পারি। এ ব্যাপারে আর দেরী চলে না। নিরাপদ শাকসব্জি মানে জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা শাক সব্জিকে বোঝায় এবং তার নিরাপদ সংরক্ষণ বোঝায়। জৈব শাকসব্জি ও ক্ষেত থেকে তোলার পর খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত নানাভাবে অনিরাপদ হতে পারে। এখন প্রশ্ন হল কোথায় মিলবে নিরাপদ শাক সব্জি? কে দেবে তার নিশ্চয়তা? আর কৃষকরা উৎপাদন করলেও কে দেবে তার উপযুক্ত মূল্য। এসব নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে এখন আমাদের দ্রুত এগিয়ে যেতে হচ্ছে। জৈব পদ্ধতির নিরাপদ উৎপাদনের উপর জোর দিয়ে বেশ কিছু সময়োপযোগী প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে এখন। আশাকরি ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ এ ব্যাপারে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করবে।
উন্নত বিশ্বের প্রায় সব মানুষ এখন নিরাপদ সব্জি বা অরগ্যানিক ভেজিটেবলের সন্ধান করছেন। বাংলাদেশে এখন বিভিন্ন shop -এ অরগ্যানিক ভেজিটেবল পাওয়া যাচ্ছে। জৈব পদ্ধতিতে সব্জি চাষের ফলন প্রথমাবস্থায় কম হওয়ায় এই পদ্ধতিতে সব্জি চাষ করলে প্রথম দিকের ঘাটতি পূরণ হবে না। তাই সব সুযোগেই, সর্বত্র জৈবচাষ ছড়িয়ে দিতে হবে। সেইজন্য এই সব্জির দাম কিছুটা বেশি পেলে, অনেক কৃষক জৈবচাষে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। স্বল্প পরিসরে বিশেষ করে বসত-বাড়িতে আমরা প্রত্যেকে অন্তত জৈব পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন করে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি, যাতে জৈবচাষ দেশজুড়ে রাষ্ট্রীয় কর্মের অঙ্গ হয়ে উঠলে এবং তাতে ফলনের কিছুটা প্রাথমিক ঘাটতি দেখা গেলে আবাস সন্নিহিত উদ্যানে যথাসম্ভব পুষিয়ে নেওয়া যায়। কৃষকও জৈবচাষ করুক, যাদের সুযোগ আছে তারা সবাই জৈবচাষে মন দিন। রাসায়নিক সার রোগনাশক, আগাছানাশক, হরমোন ইত্যাদি বাদ দিয়ে ফসল চক্র অনুসরণ করতে হবে। সবুজ সার, কম্পোস্ট সার ব্যবহার বাড়াতে হবে। জৈবিক রোগনাশক দিয়ে ফসলের রোগ দমন করতে হবে, বাড়াতে হবে উদ্ভিজ্জ কীটনাশকের ব্যবহার।
*– পিঙ্কি ঘোষ, কল্যাণী, নদীয়া*
*৩*
*জৈবিক চাষ কেবল ভাবনা নয়, আত্মনির্ভর হওয়ার পথ।*
সম্প্রতি আমরা দেখছি যে ভারত সরকার ও দেশের বিভিন্ন রাজ্য সরকার জৈবিক চাষ বাড়ানোর অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের সমস্ত সরকার তথা আপামর জনসাধারণ দেখছে যে বিগত দিনে রাসায়নিক চাষবাস হওয়ায় দেশে দেশে রোগের প্রাদুর্ভাব খুব বেশি বেড়ে গেছে। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে। ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, সুগার, হার্ট অ্যাটাক, টিবি, মৃগী, বিভিন্ন রকমের চর্মরোগ, জ্বর, মাথা ব্যথা, ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। পাঞ্জাব থেকে রাজস্থান পর্যন্ত একটি ট্রেন চলে তার নাম ক্যান্সার ট্রেন। পাঞ্জাব ও হরিয়ানাতে সবুজ বিপ্লব প্রথম শুরু হওয়ায় হাজার হাজার কৃষক মানুষ রাজস্থানের ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যান। এখন প্রায় প্রত্যেক গ্রামে ক্যান্সার রোগী দেখতে পাওয়া যায়।এই রকম ভাবে যদি 10-20 বছর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিয়ে চাষ করা হয়, তাহলে দেশের প্রত্যেক পরিবার পিছু একজন দূরারোগ্য রোগে মারা যাবেন। এই দুরারোগ্য রোগ জনসাধারণ যাতে চিকিৎসা করাতে পারেন তার জন্য সরকার 5 লক্ষ টাকার বীমা দিতে বাধ্য হয়েছে। দেশে অনেক বড় বড় হাসপাতাল, এইমস, নির্মাণ করতে হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে দেশে লোকসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। সন্তান জন্মের পর থেকেই রোগ নিয়ে জন্মাচ্ছে। যার কারণ রাসায়নিক জাতীয় খাবার খাওয়া ও মোবাইল রেডিয়েশন। বিষযুক্ত খাবার খেয়ে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন মানুষকে উচ্চগুণমানের ঔষধ খেতে হচ্ছে।
ভারত সরকার কে প্রত্যেক বছর G. D. P এর 0.5% (প্রায় 70 হাজার কোটি টাকা) Fertilizer Subsidy হিসাবে দেশের কৃষকদের দিতে বাধ্য হয়। অতএব সরকারকে কৃষি ও স্বাস্থ্য বিভাগে প্রচুর টাকা খরচ করার পরেও দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্তিতি ঠিক করতে পারছে না। প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কৃষি আমাদের অর্থ ব্যবস্থার আধার। আজও দেশের 60%-70% জনসংখ্যা কৃষির উপর নির্ভরশীল। আজও 70% জনসংখ্যা গ্রামে বসবাস করে এবং এরা বেশিরভাগ কৃষক। এদের অবস্থা শোচনীয় এবং দুর্দশাগ্রস্থ। ভারতের এই দুর্দশা শোধরানোর জন্য ভারতে এখন চাই জৈবিক কৃষিকাজে মনযোগ দেওয়া। আমাদের দেশ কে এখন কর্পোরেট জগৎ চালাচ্ছে। তাই ভারত এখনও গরীব। দেশ পরম ভৈববশালী তখনই হবে যখন দেশ পরিচালন ক্ষমতা কৃষকের হাতে থাকবে। কৃষকের হাত তখনই শক্তিশালী হবে যখন নিজের হাতের তৈরী দেশি বীজ ও জৈব সার হাতের নাগালের মধ্যে থাকবে।
*জৈব কৃষির ক্ষেত্রে বহু ব্যবহৃত কয়েকটি কার্যকরী উপকরণ*
A. জৈবসার:-
1.গোবর সার
2.কম্পোস্ট বা আবর্জনা সার
3.সুপার কম্পোস্ট
4.ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার
5.নিম, করঞ্জ, ও সরিষার খোল
6.নাদেপ কম্পোস্ট
B. তরল সার
1.সঞ্জীবক
2.জীবন্মৃত
3.অমৃতপানি
4.গোমূত্র
5.ভার্মিওয়াস
6.পঞ্চগব্য
C.সবুজ সার
1.ধঞ্চে
2.এজোলা
3.সিম্বগোত্রীয় শস্য চাষ।
D. শস্য সুরক্ষার বিভিন্ন উপাদান
1.বীজামৃত
2.দশপর্নী
E. কিছু বহুমুখী উদ্ভিজ কীটনাশক
1.নিমাস্ত্র
2.ব্রহ্মাস্ত্র
3.আগ্নেয়াস্ত্র
F. ফসলের কীট শত্রু দমন
1.নিম পাতার নির্যাস
2.নিমবীজের নির্যাস
3.লঙ্কা ও নিমবীজের নির্যাস
4.গোমূত্র ও নিমপাতার নির্যাস
5.নিম ও করঞ্জ খোল, এলোভেরা রস, গোমূত্রের মিশ্রিত নির্যাস
6.লঙ্কা, পেঁয়াজ, রসুনের নির্যাস
7.আদার নির্যাস
8.তুলসী পাতার নির্যাস।
কৃষক এই গুলি যদি ব্যবহার করেন তো রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে না। তখনই হবে দেশ কৃষি ক্ষেত্রে স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বন।
*– উজ্জ্বল মাহাতো, শ্যামপুর, জয়পুর, পুরুলিয়া, মোবাইল-6294140383*