‘লাভ জেহাদে’র বক্রোক্তি উপেক্ষা করেই ধুমধাম করে হয়েছিল বিয়ে। দিল্লির রিসেপশনে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নায়ডু। ছিলেন আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ এবং তৎকালীন লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। সারা দেশ স্বাগত জানিয়েছিল ভিন্ন ধর্মের এই আইএএস যুগলের ভালবাসার পরিণতিকে। স্বপ্নের সেই কাহিনি দু’বছরের বেশি টিকল না। ডিভোর্সের আরজি জানিয়ে রাজস্থানের পারিবারিক আদালতে আবেদন জানালেন আইএএস দম্পতি টিনা ডাবি ও তাঁর স্বামী আথর আমির খান।
বিয়ের সময় টিনা জানিয়েছিলেন, ২০১৬ সালে মে মাসে যখন তাঁদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়, সেখানে প্রথম আলাপ দুই কৃতীর। আথরই নাকি সোজা এসে টিনার দিল্লির বাড়িতে বেল বাজিয়েছিলেন। তারপর? মাস চারেকের মধ্যে প্রেম। বাধা হয়নি ধর্ম। দুজনের পরিবারের পক্ষ থেকেও কোনও বাধা আসেনি। সময়ের ফেরে তাতে ফাটল ধরেছে। কী এমন ঘটল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কেউ কটাক্ষ করেছেন, কেউ আবার পাশে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিগত মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
এই রকম একটা পরিস্থিতিতে একের পর এক বিজেপি শাসিত রাজ্য ‘লাভ জেহাদ’ ঠেকাতে আইন করার পথে হাঁটছে। তার মধ্যেই ‘লাভ জেহাদ’ বিতর্ক নিয়ে বাকযুদ্ধে মেতেছে কংগ্রেস এবং বিজেপি। রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌতের অভিযোগ, দেশের মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে ‘লাভ জেহাদ’ শব্দটি বিজেপির বানানো। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াতের পাল্টা দাবি, ‘লাভ জেহাদ’ আসলে একটা ফাঁদ। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি-র নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়ও মনে করেন এ ব্যাপারে আইন প্রণয়নের প্রয়োজন আছে। কারণ, মুস্লিম ছেলেদের একাংশ নানাভাবে হিন্দু মেয়েদের ফাঁসিয়ে বিপদে ফেলছে। সম্প্রতি হরিদেবপুরে এক অন্তস্বত্বা বধূর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। অভিযুক্ত স্বামী মুস্লিম। সেখানেই লকেট এ ব্যাপারে নানা কথা বলেন।
‘লাভ-জেহাদ’ কাকে বলে? শীতাংশু গুহ জানিয়েছেন, “শব্দটি এখন বেশ পরিচিত। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, ভালোবেসে বা বিয়ে করে ধর্মান্তকরণ। যেহেতু ‘জিহাদ’ শব্দটি আরবীয় বা ইসলামী, তাই এটিকে মূলত: ভালবেসে ইসলামীকরণ হয়। এর মধ্যে কতটুকু ভালোবাসা আর কতটুকু ‘জিহাদ’ বলা মুশকিল।” যাই হোক, এর বিরুদ্ধে আইন আনার কথা ঘোষণা করেছে মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক, হরিয়ানা। একই পথে হাঁটছে উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার। এই বিষয়ে আইন দফতরকে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র দফতর। উত্তরপ্রদেশের আইনমন্ত্রী ব্রজেশ পাঠক বলেন, ‘‘এই বিষয়টি রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে আঘাত করছে। এটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। সরকার এই বিষয়ে ইতিমধ্যেই আইন আনার পরিকল্পনা করে ফেলেছে এবং তার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গিয়েছে। জেল এবং জরিমানা নিয়ে কড়া আইন আসতে চলেছে। এই বিষয়ে খসড়া তৈরি হচ্ছে। জনগণ খুব শীঘ্রই তা জানতে পারবেন।’’ গায়ের জোরে, লোভ দেখিয়ে বা বিয়ের নামে কারও ধর্মান্তরণ করা যাবে না বলে গত বছরই আইন তৈরি করেছে হিমাচলপ্রদেশ সরকার।
এই পরিস্থিতিতে ‘লাভ জেহাদ’ নিয়ে বিজেপিকে নিশানা করেছেন সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাত। তিনি বলেছেন, ভিন্ন জাতি বা ভিন্ন ধর্মে বিয়ে উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক, কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরা লাভ জিহাদের তকমা দিয়ে এর বিরুদ্ধাচরণ করছেন।
রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা গহলৌতের অভিযোগ, ‘‘দেশে বিভাজন তৈরি করা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য বিজেপি লাভ জেহাদ কথাটি তৈরি করেছে। বিয়ে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিষয়। আইন করে সেই স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া সংবিধান-বিরোধী। এতে দেশের কোনও আদালত সায় দেবে না। ভালবাসায় জেহাদের কোনও স্থান নেই।’’ রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী টুইটে লিখেছেন, ‘‘দেশে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে প্রাপ্তবয়স্কেরা নিজের ইচ্ছেয় জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পারবেন না। তার জন্য তাঁদের রাষ্ট্রের দয়ার উপরে নির্ভর করে থাকতে হবে। বিয়ে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তাতে বাধা দেওয়া ব্যক্তি স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার শামিল।’’
গহলৌতকে পাল্টা জবাব দিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা শেখাওয়াত। তাঁর প্রশ্ন, ভিন্ ধর্মে বিয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয় হলে বিয়ের পরে জোর করে মেয়েদের ধর্ম পরিবর্তন করা হয় কেন? শেখাওয়াত বলেন, ‘‘প্রিয় অশোকজি লাভ জেহাদ হল একটা ফাঁদ। হাজার হাজার মেয়েকে সেই ফাঁদে ফেলে তাঁদের বোঝানো হয় বিয়ে হল ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু বাস্তবটা সম্পূর্ণ আলাদা। বিয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয় হলে বিয়ের পরে মেয়েদের ধর্ম এবং বাবা-মায়ের দেওয়া নাম কেন পাল্টাতে হয়।’’ টুইটে শেখাওয়াতের দাবি, ‘‘রাজনৈতিক স্বার্থে হিন্দু সন্ত্রাসবাদের মতো শব্দ তৈরি করা, ঘৃণা ছড়ানো কংগ্রেসের কাজ। বিজেপি সবার উন্নতিতে বিশ্বাস করে। তাই লাভ জেহাদের নামে মহিলাদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং অন্যায়ের শিকার হতে দেব না।’’
শিক্ষাবিদ তথা প্রাক্তন উপাচার্য অচিন্ত্য বিশ্বাস এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, “আমার দীর্ঘ অধ্যাপনার সময়ে কিছু মুসলমান ছেলেদের মধ্যে কয়েকজন ডাকনাম (হয়ত নিজেদের নেওয়া ছদ্মনাম) ব্যবহার করত। সেসব নামে ধর্ম চিহ্ন থাকে না। কেন জানি না, তাদের নতুন ধরনের ফোন ও অন্যান্য ব্যাপারে তাদের পারঙ্গমতা বেশি থাকত। নাম আর ব্যবহার দেখে তাদের ধর্ম বোঝার উপায় থাকত না। এরা অধিকাংশ বাম রাজনীতির সাহায্য পেয়েছে। ফ্ল্যাট কেনা, ভাড়া পাওয়া এইরকম ক্ষেত্রেও ছদ্মনামগুলো সাহায্য করত হয়ত।
মেয়েদের ক্ষেত্রে এইরকম দেখিনি! ব্যতিক্রম মাত্র দুইজন। তাদের আন্তরিকতায় কিছুমাত্র খামতি ছিল না! তারা ধর্মাচার পালন করত। এখনও যোগাযোগ রাখে, বিজয়া-নববর্ষে প্রণাম পাঠায়। ঈদের শুভেচ্ছাও। অন্যদের খাদ্য ব্যবহার বদলে যায়! বিয়ের পর। আগে মাংস খেত আমাদের বাড়ি। বিয়ের পর খায় না! এদের সঙ্গে হিন্দু মেয়েদের বিয়ে হতে দেখেছি। অর্ধেক ধর্ম ত্যাগ করে। বাকিদের সন্তানদের কি হয়, সহজেই অনুমেয়। আমি ওদের ধর্ম গ্রন্থের সম্ভবমত পাঠ করেছি। মনে হয়েছে, যুদ্ধের পর ‘গনিমতের মাল’ হিসেবেই ওরা মহিলাদের দেখে অভ্যস্ত। অন্য ধর্মের নারীদের স্বধর্মে আনা তাদের কাছে জন্নতে যাওয়ার সুযোগ থাকে। আর জন্নতে যা পাওয়া যায় তার সঙ্গে মুসলমান শাসকদের খুব মিল আছে ‘হারেম’-এর। বাকি যা, তাতে নারীদের আনন্দের কিছু নেই।
ছোটবেলার বহু ঘটনা দেখেছি, বিশেষত মুম্বাইয়ের অভিনেত্রীদের ধর্ম ত্যাগ করে বিয়ে করার ঘটনা— শর্মিলা ঠাকুর থেকে এখনকার করিনা কাপুর পর্যন্ত। বিপরীত ঘটনার প্রমাণ নেই বললেই হয়। সুরাইয়া-রাজকাপুরের কথা তো বিখ্যাত। যদি এ থেকে সিদ্ধান্ত নিই, এগুলো ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়।
উপমহাদেশের উদাহরণ নিলে স্পষ্ট হবে। অমুসলিম নারীরা ধর্ম ত্যাগ করে বিয়ের পর কি হয়? ইমরান পত্নী জেমাইমা কিংবা ‘কাবুলীওয়ালার বাঙালী বউ’-এর অভিজ্ঞতা আমাদের জানা।
একে ‘লাভ জেহাদ’ বলা যাবে কিনা, আরও তথ্য মিলিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু হরিয়ানার মেয়েটিকে ধর্ম ত্যাগ করো, নাহলে মরো! ঘটনার পর তত্ত্বটি অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
এই প্রসঙ্গে সীতাংশু গুহ লিখেছেন, “ধর্মের ব্যাপারে মুসলমানরা গোঁড়া তা বলা বাহুল্য। এদের অধিকাংশ বিশ্বাস করেন যে, অন্য ধর্মের কাউকে ইসলামের ছায়াতলে আনতে পারলে চৌদ্দ পুরুষের বেহেস্ত নিশ্চিত। মুসলিম সমাজ এটি উৎসাহিত করে। রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। ‘নও মুসলিম’ কর্মসূচি নুতন ধর্মান্তরিতদের আর্থিক সহায়তার জন্যে প্রণীত। বাংলাদেশে আগে এই খাতে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ থাকতো, এখনো আছে কিনা জানিনা। লাভ জিহাদ এতকাল একটি একতরফা প্রজেক্ট ছিলো। এখন সময় পাল্টেছে, প্রশ্ন উঠছে, কেন?
একটি ছেলে, একটি মেয়ে সম্পর্ক হতেই পারে, কিন্তু ধর্মান্তর কেন? জোর-জবরদস্তি ইসলামে বেশি। ধরা যাক, দুই ধর্মের দুই পাত্রপাত্রীর মধ্যে একটি সম্পর্ক গড়ে উঠলো। বিয়ের পালা। ধর্ম তখন সামনে এসে দাঁড়ায়। সমস্যা বাঁধে পাত্র-পাত্রীর একটি পক্ষ মুসলিম হলে; সেখানে অন্য পক্ষকে মুসলমান হতে হয়। এটা এক ধরণের জোর-জবরদস্তি। এখানে ধর্মকে ভালবেসে কেউ ধর্মান্তরিত হচ্ছেন না। আকর্ষণটা ধর্মের নয়, অন্যত্র। চাহিদা ধর্মের নয়, দেহের। প্রশ্ন উঠতে পারে, ছেলে-মেয়ে কাউকে ধর্ম ত্যাগ করতে হবে কেন? আর যদি করতে হয়, তাহলে একজনকে কেন? দু’জনকে নয় কেন? প্রায়শঃ দেখা যায়, মেয়েটি ধর্ম ত্যাগ করছে। এতে মেয়েটির ভালবাসার প্রমাণ হলেও ছেলেটি’র ভালবাসার প্রমাণ হয়না। ভালবাসার জন্যে ধর্মান্তর-কে কি ভালবাসা বলা যায়? দু’জনের ভালবাসার মধ্যে যদি ধর্ম বড় হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সেটা আর যাই হোক, ভালবাসা নয়! দু’জন যদি সত্যি একে অপরকে ভালোবাসেন তবে উভয়েই ধর্মত্যাগ করে তৃতীয় ধর্ম গ্রহণ করলে হয়তো বিষয়টি কিছুটা যৌক্তিক হতে পারে। নইলে তো ওই ‘ভালোবাসা’ আর ‘গৃহস্থের মুরগী পোষা’-র মধ্যে খুব একটা তফাৎ থাকেনা।
অনেকের মতে শিক্ষার অভাব এজন্যে দায়ী। কথাটা কি সত্য? পতৌদির নবাব মনসুর আলী খান অশিক্ষিত ছিলেন না! বাংলাদেশের জহির রায়হান ওপর তলার মানুষ। পতৌদির নবাব শর্মিলা ঠাকুরকে ধর্মান্তরিত করেছেন। শর্মিলা হয়েছেন আয়েশা সুলতানা। জহির রায়হান মুসলমান বানিয়েছেন সুমিতা দেবীকে। শর্মিলা মুসলমান হয়ে পর্দার অন্তরালে চলে যান। জহির রায়হান কিছুদিন পর সুমিতাকে ফেলে কোহিনুর আক্তার সুচন্দাকে বিয়ে করেন। সমাজের নিম্নস্তরে হয়তো শিক্ষার অভাব কিছুটা দায়ী। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ধর্মান্ধতা ও জবরদস্তি এর মুখ্য কারণ। এই জবরদস্তিটা মোঘল আমলের মত ঠিক তলোয়ার নিয়ে নয়, বরং পারিবারিক এবং সামাজিক, কখনো-সখনো রাষ্ট্রীয় এবং সাথে মোহ-লোভ তো আছেই; কখনোবা জীবনের ভয়.”
অশোক সেনগুপ্ত