রাজবংশী সমাজ – কার্তিক অমাবস্যার কিছু লৌকিক ব্রতাচার এবং সনাতনী বঙ্গ সংস্কৃতি

মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে—

শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।

হাতে হাত ধ’রে-ধ’রে গোল হ’য়ে ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে

কার্তিকের মিঠে রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে;

ফলন্ত ধানের গন্ধে—রঙে তার—স্বাদে তার ভ’রে যাবে আমাদের সকলের দেহ;

রাগ কেহ করিবে না—আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ।

আমাদের অবসর বেশি নয়—ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময়

আমাদের সকলের আগে শেষ হয়;

দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ–অবসাদ–

আমাদের ডেকে লয়, তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা, অবসন্ন হাত।

শারদীয় শুক্লা তিথি ধীরে ধীরে তার শুভ্রবস্ত্রখানি গুটিয়ে নেন প্রকৃতি থেকে। ধীরে ধীরে আপন অঞ্চল বিস্তার করে বসেন হৈমন্তীকৃষ্ণা । পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবতে না ডুবতেই মাঠে মাঠে হেঁউতি ধানের উপর কৃষ্ণপক্ষের আঁধার ঘনিয়ে আসে। সে আঁধার ক্রমশ নিকষ কালো হয়ে ওঠে। 

প্রথম ফসল গেছে ঘরে—

হেমন্তের মাঠে-মাঠে ঝরে

শুধু শিশিরের জল;

অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে

হিম হ’য়ে আসে

বাঁশপাতা—মরা ঘাস—আকাশের তারা;

বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা;

ধানখেতে—মাঠে

জমিছে ধোঁয়াটে

ধারালো কুয়াশা;

ঘরে গেছে চাষা;

ঝিমায়েছে এ-পৃথিবী—

তবু পাই টের

কার যেন দুটো চোখে নাই এ-ঘুমের

কোনো সাধ।

হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে,

শিশিরে পালক ঘ’ষে-ঘ’ষে,

পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে,

ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে

মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে

জাগে এক অঘ্রাণের রাতে

সেই পাখি….

সেই কার্তিক , সেই হেমন্তের নীল কুয়াশায় আঁধার আরো নিকষ কালো হয়ে আসে।  ঘরে ঘরে দীপালিকার আলো জ্বলে ওঠে , বাঁশের ডগায় জাগে আকাশ প্রদীপ। লোক জীবনে তখন ব্রত উৎসবের প্রকারভেদ ঘটে। বঙ্গের উত্তরে রাজবংশী সম্প্রদায় এই সময় গাঁয়ে গাঁয়ে এক ব্রত উদযাপন করেন।  তাকে কেউ বলেন #হকাহুকি , কেউ বা বলেন #উল্কা ।  আবার কেউ অভিহিত করেন #চোরচটিয়া নামে। 

কার্তিক অমাবস্যা , সে বড় ঘোর , সে বড় ভয়াল। এই তিথিতেই হয় মহাকালীর পূজা , হয় দ্বীপানিতা লক্ষ্মী পূজা। 

হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে

হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে॥

ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো– “দীপালিকায় জ্বালাও আলো,

জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।’

শূন্য এখন ফুলের বাগান,   দোয়েল কোকিল গাহে না গান,

কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে।

যাক অবসাদ বিষাদ কালো,   দীপালিকায় জ্বালাও আলো–

জ্বালাও আলো, আপন আলো, শুনাও আলোর জয়বাণীরে॥

এই তিথিতেই উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজের গ্রামে হয় #চোর_পূজার ব্যবস্থা। উত্তরবঙ্গের তাবৎ রাজবংশী সমাজ এই তিথিতেই যে গান বাঁধেন তার নাম #চোর_চুরনী। শুধু অঞ্চলভেদে এর প্রকারভেদ। 

প্রথমে বলি চোরপূজার কথা। 

কার্তিক মাসের অমানিশায় কালীপূজার রাত্রে পূজাটির সূচনা হয়। গাঁঘরে যাদের যাদের গৃহে চোরপূজা প্রচলিত , তারা গ্রামের মালাকারের কাছ থেকে শোলার মুখোশ তৈরি করিয়ে নেন। তারপর সেই গৃহের কোনো একটি ছেলে সেই মুখোশ পড়ে গাঁয়ের ঘরে ঘরে ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করে। তবে যাঁদের গৃহে এ পূজা প্রচলিত আছে তাঁদের নিকট অর্থ সংগ্রহ করা হয় না। সংগৃহীত অর্থ দিয়ে এই পূজা সম্পন্ন হয়। এই ব্রতে শোলার মুখোশ টিকেই পূজা করা হয়। সেই সঙ্গে পায়রা উৎসর্গ করা হয়। সাধারণত স্থানীয় মালাকারগণই পূজার পৌরহিত্য করেন।  প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি রাজবংশী সমাজের বেশ কিছু পূজা বা ব্রত এমন করে অর্থ , চাল সংগ্রহ করেই পালন করা হয় । যেমন – গোরখনাথের ব্রত, হুদুমদেও , তিস্তাবুড়ি পূজা প্রভৃতি। 

তবে , চোর পূজা বহুল প্রচলিত নয়। কিন্তু উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই সময় যে ব্রত বহুল প্রচলিত তার নাম ” হুকাহুকি”। কালীপূজার একদিন আগে সেই ব্রত বা পূজা করলে তার নাম #চোরচেটিয়া আর কালীপূজার দিন করলে তাকে বলা হয় হুকাহুকি বা হুয়াসিয়া। পশ্চিম দিনাজপুরের দেশী- পলিদের মধ্যে এই সময় এই ব্রত #উল্কা_উৎসব নামে পালিত হয়। 

উল্কা উৎসব বা ব্রত কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত হলেও আশ্বিন মাসের সংক্রান্তির দিন থেকে এই ব্রতের সূচনা। 

কার্তিক মাসের অমাবস্যার সন্ধ্যায় গ্রামবাসীরা আপন আপন গৃহে এবং ধানের ক্ষেতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন। কেউ কেউ আবার ওইদিন  ধানের ক্ষেতে অস্থায়ী চালাঘর নির্মাণ করেন। সেখানে পূজার আয়োজন হয়। এর নাম #নিশিপূজা। আমরাও করি দ্বীপনিতা লক্ষ্মী পূজা। তার পূর্ব দিন সন্ধ্যায় , ভূত চতুর্দশী বা নরক চতুদর্শীর সন্ধ্যায় পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে জ্বালাই চৌদ্দ প্রদীপ। গৃহ ,পথ, ক্ষেত্র আলোকোজ্জ্বল করে ভীষণ অমানিশায় নানা রূপে মা ব্রহ্মময়ীকে আরাধনা করে অশুভকে দূর করা হয়।

এইদিন সন্ধ্যায় গ্রামের ঘরে পাটকাঠির গোছা উল্কা নির্মাণ করানো হয়। এর অপর নাম সিজা। সন্ধ্যায় এই উল্কা গুলিকে আকাশের দিকে মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। 

পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আমাদের সুপ্রাচীন ভারতের এক সুন্দর সনাতনী রীতি। বেদে উল্লেখ হয়েছে – 

মানী বধী পিতরঃ মীত মাতরম্

অর্থাৎ , পিতা মাতা বা আমাদের পূর্বপুরুষ তাঁদের মৃত্যু হয় না । তাঁদের আত্মা পরমাত্মারই অংশ। সেই আত্মারা সময় মতো আবার নতুন দেহ ধারণ করেন। তাঁরা অমর , অক্ষয় , অব্যয়। তাই তাঁরা আবার যখন শরীরী তখন তাঁরা উত্তরসূরীর আগমন ঘটান । উত্তরসূরীকে বড় করেন ,  দৃষ্টিকোণ প্রদান করেন। তাঁরা  জীবনের প্রথম গুরু। তাঁরা তাই আমাদের মধ্যে দিয়ে অর্থাৎ উত্তরসূরীদের মধ্যে দিয়ে অমর হয়ে থাকেন।

ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্নায়ং

 ভূত্বাঽভবিতা বা ন ভূয়ঃ ৷

অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো 

ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ৷৷

বঙ্গের নানা স্থানে একটি রীতি হল‚ গোটা কার্তিক মাস ধরে পূর্বপুরুষদের বাতি দেখানো ।  মহালয়ার তর্পণের মাধ্যমে শ্রাদ্ধগ্রহণের জন্য যমলোক থেকে যে পিতৃপুরুষরা মর্তে এসেছিলেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে ফিরতি পথ পরিদর্শনের জন্যই এই আলো জ্বালানো হয়। এই দীপাবলিরও অনেক নাম— দীপান্বিতা, দীপালিকা, সুখদাত্রী, সুখসুপ্তিকা, যক্ষরাত্রি, দেওয়ালি ইত্যাদি। সনাতনী সমাজ এই বিশ্বাস লালন করে যে দেওয়ালির আলোর রোশনাই ও প্রবল ঝঙ্কারে যাবতীয় দুষ্ট দুরীভূত হবে। এমন বিশ্বাস হয়তো মূর্খামি কিন্তু অমাবস্যার রাতে আলোক ও আতশবাজি একটা মুগ্ধতা আনে।

আবার, অন্য মতে চোদ্দো বছর বনবাস যাপনপর্ব শেষে শ্রীরাম, সীতা ও লক্ষ্মণের সঙ্গে অযোধ্যায় ফিরেছিলেন। লঙ্কা জয় ও রাবণকে সংহার করে অযোধ্যায় ফেরার বিজয়োৎসবের দ্যোতক হিসেবে সমস্ত অযোধ্যা নগরী সেজে উঠেছিল। রামের ফেরার রাজপথ আলো ও ফুলের লালিমায় সাজানো হয়েছিল।

কার্তিক মাস মানে হেমন্ত ঋতু । আসলে এই মন কেমন করা ঋতুর মধ্যে কিছু একটা আছে।

আশ্বিনের শেষ দিনের থেকে  জলবিষুব সংক্রান্তি পালনের উদ্যোগ চলে বঙ্গের উত্তর থেকে দক্ষিণে সকল গ্রামে। 

 শাস্ত্রে প্রদীপ হল মানবদেহের প্রতীক। ক্ষিতি‚ অপ‚ মরুৎ‚ ব্যোম‚ তেজ-এই পঞ্চভূতে তৈরি নশ্বর দেহ । প্রদীপও তাই । ক্ষিতি বা পৃথিবী বা মাটি দিয়ে তাকে বানানো হয় । অপ বা জল ছাড়া সেই সৃষ্টি সম্ভব নয় । অগ্নিশিখা হল তার তেজ । মরুৎ বা বাতাস সেই তেজকে জ্বলতে সাহায্য করে । ব্যোম বা অবিনশ্বর শূন্যে বিলীন হয় সেই তেজ ।

কার্তিক মাস ধরে এই প্রদীপ দেওয়া শুধুই বিষ্ণুর আশীর্বাদ যাচনা নয়। তাঁকে তো স্মরণ করতেই হবে। এই পৃথিবীকে পালন করেন তিনি, মৃত্যুর পরেও মানুষের উপরে রয়েছে তাঁরই অধিকার। তাই আকাশপ্রদীপ দেওয়ার সময় উচ্চারণ করা হয় মন্ত্র- ‘’আকাশে সলক্ষ্মীক বিষ্ণোস্তোষার্থং দীয়মানে প্রদীপঃ শাকব তৎ।‘’ 

আকাশে লক্ষ্মীর সঙ্গে অবস্থান করছেন যে বিষ্ণু, তাঁর উদ্দেশে দেওয়া হল এই প্রদীপ। এ বাদেও আকাশপ্রদীপ শীতঋতুতে মানুষের অগ্নিসঞ্চয়ের অভ্যাস। 

মানুষ যখন গুহামানব তখন তার কাছে আগুন অতি মূল্যবান । সেটা ছিল হিংস্র শ্বাপদদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ব্রহ্মাস্ত্র । শীত আসার আগে যতটা সম্ভব আগুন এবং জ্বালানি জমানো হতো ।  গুহায় থাকত জ্বলন্ত শিখা । তা কখনও নেভানো হতো না ।  অগ্নি হল ব্রহ্মের এক সাক্ষাৎরূপ , তাই  অগ্নিহোত্র রক্ষার আচারেও সদা যজ্ঞাগ্নি প্রজ্জ্বলিত থাকে।

বৈষ্ণবদের কাছে কার্তিক মাস খুবই পবিত্র । আকাশপ্রদীপ দেখিয়ে তাঁরা স্মরণ করেন বিষ্ণু ও লক্ষ্মীকে । লক্ষ্মী জনার্দনকে শ্রদ্ধা নিবেদনই হোক | বা পূর্বপুরুষকে পথ দেখানোই হোক । আকাশপ্রদীপ নির্মাণের যথাবিহিত নিয়ম আছে।

তার জন্য  যজ্ঞের উপযোগী এক বৃহৎ কাঠের এক পুরুষপ্রমাণ দণ্ড নির্মাণ করা হয়। তাতে যবাঙ্গুল পরিমাণ ছিদ্র করে লাগানো হয় দু’হাত পরিমাণ রক্তবর্ণের পট্টি। 

সেই অষ্টকোণযুক্ত পট্টির ভিতরে রাখা হয় এই দেহের প্রতীক প্রদীপটি। স্থাপনের সময় বলা হয়- 

‘’দামোদরায় নভসি তুলায়াং লোলয় সহ

প্রদীপং তে প্রযচ্ছামি নমোহনস্তায় বেধসে।‘’ 

কাৰ্ত্তিকমাসে লক্ষ্মীর সঙ্গে দামোদরকে আমি আকাশে এই প্রদীপ দিচ্ছি। বেদ অনন্তকে নমস্কার।

 অনেক  পরিবার আকাশপ্রদীপ স্থাপনের সময় উচ্চারণ করেন- ‘’নিবেদ্য ধৰ্ম্মার হরায় ভূম্যৈ দামোদরায়াপ্যথ ধৰ্ম্মরাজে/প্রজাপতিভ্যত্বথ সৎপিতৃভ্যঃ প্রেতেভ্য এবাথ তমঃ স্থিতেভ্যঃ।‘’ তাঁরা শুধুই আকাশপ্রদীপটি লক্ষ্মী-নারায়ণকে নিবেদন করেন না। তার সঙ্গে আবাহন করেন পিতৃলোকে, প্রেতলোকে থিতু হওয়া পূর্বপুরুষদেরও।

তাই, রাজবংশী সমাজ আপন লৌকিক আচার , রীতি , ব্রতের মাধ্যমে সেই সুপ্রাচীন বৈদিক নিয়মকেই আপন আপনা ভাবে অনুসরণ করেন। কেবলমাত্র রাজবংশী সমাজ কেন ? বরং আমার বলা উচিত, সারা বঙ্গ তথা ভারত জুড়ে নানা লোকাচার , কুলাচারের মাধ্যমে যুগ থেকে যুগান্ত জুড়ে সেই প্রাচীন মুনি ঋষিদের দেখানো পথই অনুসরণ করা হচ্ছে। যেমন – রাঢ় বঙ্গ বা দক্ষিণ ভারতে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে বীরস্তম্ভ স্থাপন ও পূজা। পূর্বপুরুষ, বিশেষত যারা নিজেদের শৌর্য,বীর্য ও কর্মের মাধ্যমে বংশের নাম উজ্জ্বল করেছেন,তাঁদের উত্তরপুরুষেরা আবহমান কাল ধরে  শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করেছে।তাঁদের স্মৃতিতে উৎসর্গ করেছে বিভিন্ন অবকাঠামো, ঠিক যেমন আজকের সময়ের বিভিন্ন শহিদবেদী অথবা স্মৃতি মন্দির।এমনই এক আশ্চর্য অবকাঠামো হল বীরস্তম্ভ।ইংরাজিতে একেই বলে hero stone,পুরুলিয়া, বাঁকুড়া জেলায় এগুলির নাম আবার বীরকাঁড়।দক্ষিণ ভারতে এগুলি আবার বীরকুল্লু বা বীরকল নামেও সুপরিচিত।

রাঢ় অঞ্চলের অতীত ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ,এখানে বসবাস করত আদিম জনগোষ্ঠীর দুটি শাখা অস্ট্রিক এবংদ্রাবিড়।  হা বা হো শবর , মুন্ডা , বীরহর , কোল প্রভৃতি রা অস্ট্রিক জাত ভুক্ত। 

  মানভূম তথা পুরুলিয়ার বুকে হা  বা হো নামক এক আদিম জনগোষ্ঠীর বাসভূমি ছিল ও এখনো কিছু আছে। রঘুনাথপুর থানায় হা অন্ত অজস্র পুকুর রয়েছে আজও – চাঁদাহা, মায়াহা, ইশরাহা, রানাহা, গনাহা  প্রভৃতি। রাচি , হাজারীবাগ প্রভৃতি অঞ্চলে এখনো এনাদের দেখতে পাওয়া যায়।

 বর্তমানে ১লা, ২রা বা ৩রা মাঘ এরা বছরে একবার দামোদরের তেলকুপি বা কালগালি ঘাটে অস্থি বিসর্জন এর উদ্দেশ্যে  আসে। তাদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র নদ দামোদর।  তাদের ভাষায় এটি দ্বাপর গঙ্গা।  

এইসব আদিম জনজাতি প্রতিষ্ঠিত বহু বীর স্তম্ভ আজও বিরাজ করে রাঢ় অঞ্চলের পথে-প্রান্তরে।  আসলে এই বীর স্তম্ভ হল সমাধি প্রস্তর । সুপ্রাচীন যুগে এগুলো নির্মিত হয়েছিল মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে ।কোন বীর যোদ্ধা সেনাপতি বা সরদার কোন বহিঃশত্রুর আক্রমণে যখন বীরের মতো যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করত তখন তার মৃতদেহ কবরস্থ করে তার উপরে বসিয়ে দেওয়া হতো এই স্তম্ভ।

দক্ষিণ ভারতের  কুড়ুমব  এবং ইরলু জনজাতির মানুষেরা এগুলিকে আজও নিজেদের পূর্বপুরুষের স্মৃতি হিসাবে শ্রদ্ধা করে থাকেন। বাঁকুড়া পুরুলিয়া ইত্যাদির বহু গ্রামে অজস্র বীর স্তম্ভ রয়ে।ছে বাঁকুড়ার রানীবাঁধ থানায় বির খাম বলে একটি গ্রাম রয়েছে।  এইটির উচ্চারণ যে বীরখাম্বা থেকে এসেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই ।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসে এই বীর খাম্বার উল্লেখ রয়েছে। ডক্টর মিহির চৌধুরী কামিল্যা এগুলিকে পূর্বপুরুষের সমাধি পূজা বলে চিহ্নিত করেছেন।

 লম্বা পাথরের ফলক এর ওপর  রিলিফ পদ্ধতিতে খোদাই করা হয় মূর্তি। মূর্তির হাতে থাকে ঢাল তরোয়াল,  তীর ধনুক। আগে সমাধির ওপর বসিয়ে দেওয়া হতো বৃহৎ প্রস্তরখন্ড । অতটা কারুকার্যমন্ডিত ছিল না । পরে এগুলোতে খোদিত করে মানুষের মূর্তি বসানো হয়। মূর্তির ওপরের বাঘ সিংহের মূর্তি বসানো হয়ে থাকে। কোন কোন মূর্তি আবার ঘোড়ার পিঠে যোদ্ধা সাজে সজ্জিত।

  অজস্র গ্রামে ছড়িয়ে থাকা এই বীর স্তম্ভ গুলোকে স্থানীয় মানুষ  গ্রাম বা লৌকিক দেবতা হিসাবে যুগ যুগ ধরে পূজা করে আসছে।

  পুরুলিয়া জেলার নিতুরিয়া থানার মদনডি গ্রামের দক্ষিণ পঞ্চকোট পাহাড়ের ঢালে এই ধরনের বৃহৎ বীর স্তম্ভ স্থানীয় আদিবাসী সমাজের মানুষেরা বঙ্গা ঠাকুর নামে পুজো করে থাকে । 

পুরুলিয়ার হুড়া থানার অন্তর্গত ভবানীপুর নামক গ্রামে চন্দ্রেশ্বর শিবের মন্দির রয়েছে। এখানের সুবিশাল বীর স্তম্ভটি স্থানীয় মানুষের কাছে  হলেন রুদ্র মহাকাল। মূর্তির ডান পাশে বিরাট ত্রিশূল রয়েছে ।।সেখানে নিত্য পূজা হয় গ্রামবাসীদের দ্বারা। 

কাশিপুর থানার কুড়িগ্রামে রয়েছে পাঁচটিখানের সৌন্দর্যমন্ডিত বীর স্তম্ভ। প্রত্নস্থলের প্রবেশের মুখে দুপাশে দুটো তোরনের গাত্রে প্রোথিত অবস্থা আছে। এনারা সম্ভবত দ্বারপাল রূপে পূজিত হয়ে থাকেন মানুষের কাছে। 

 তা ছাড়া হুরা থানা এলাকার ভাঙ্গাড়া, লধুরকা  গ্রামেও আছে একাধিক  স্তম্ভ ।যেগুলো চৈত্র মাসের গাজনে বা আখ্যান যাত্রাদিন পূজিত হন।গ্রামবাসীদের দ্বারা। 

 রঘুনাথপুর থানার চেলিয়ামা গ্রাম এর মহামায়ার স্থানে এরম দুটি বীর স্তম্ভ আছে।

 বর্তমানে রঘুনাথপুর গ্রামের ২ নম্বর ব্লকের পশ্চিম দিকে আছে বীর থান এবং বিরার বাঁধ। সেখানে বাঁধের আলে একটি সিমেন্টের চাতালে আতুরি গাছের নিচে রয়েছে একটি দু ফুট উচ্চতার বীর স্তম্ভ। 

 স্থানীয় গরাই, তেলি এবং বাগদী সম্প্রদায় মানুষটা ধান কাটার পূর্বে এক গুচ্ছ ধান মূর্তিকে প্রথম উৎসর্গ করে কাজ শুরু করে। তাছাড়া পয়লা মাঘ এখানে পূজা পাঠ হয়।

পুঞ্চা থানার বুধপুর নামক জনৈক প্রত্নস্থলের  চারটি স্তম্ভ অবহেলিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।  ঝাড়বাগদা গ্রামের স্তম্ভটি পূজিত হয় বন ভৈরব নামে।বাগালিয়া পুরুলিয়ার স্টেশন ও ছোট গ্রাম। সেখানে বাগাল বাবা নামে পূজিত হন একটি বীর স্তম্ভ।  পুজা পাটের দায়িত্বে আছেন পূজারী হর হর রায়। তিনি ওই স্থানে রীতিমত একটি আশ্রমিক পরিবেশ তৈরি করে ফেলেছেন । তাছাড়া জয়পুর থানার অন্তর্গত জয়পুর নামে  গ্রামে একটি বীর স্তম্ভ খামারমুড়া ঠাকুর নামে পূজিত হন। সুখ শান্তি লাভের আশায় এখানে নিত্য পূজা করে স্থানীয়রা।পূজা-অর্চনার দায়িত্বে থাকেন লায়া বা পুরহিত।  খামার মুড়া কে নিয়ে নিয়ে বহু লোককথা শুনতে পাওয়া যায়।

এভাবে কোথায় যেন বৈচিত্র্যময় সুবিশাল ভারত প্রাচীন লৌকিক আচারের মধ্যে দিয়ে এক হয়ে যায়। 

 উত্তরবঙ্গে উল্কা ব্রতের ন্যায় পালিত হয় হুকাহুকি ব্রত। তবে হুকাহুকি ব্রতের কিছু স্বাতন্ত্র আছে। 

কার্তিক অমাবস্যা তিথিতে ব্রতে অংশগ্রহণ করেন যে সকল মেয়েরা তাঁরা একটি ডালায় তেল, সিঁদুর, পঞ্চ শস্য  বা পাঁশোসি , দীপ ধূপ ইত্যাদি সাজিয়ে রাখেন। তার সঙ্গে কাঁচা হলুদ আর দূর্বা ঢেঁকিতে কুটে তেল দিয়ে মেখে ডালার একপাশে রেখে দেন। এই ডালার স্থানীয় নাম #ঢন। 

পাটকাঠির গোছা ইলুয়াকাশের খড় দিয়ে বেঁধে তৈরি করা হয় উল্কা বা সিজা। আর মাটির ঘড়া বা গঙ্গাও একই সঙ্গে নির্মিত হয়। এই সিজাগুলিকে তেল সিঁদুর মাখিয়ে আঠিয়া কলা , ভাদই ধান এবং পঞ্চ শস্য বা পাঁশোসি দিয়ে সাজিয়ে বাড়ির দেবস্থানে রাখা নিয়ম। সন্ধ্যাকালে দেবস্থানের মাটিতে চাঁদ ,সূর্য এবং নাঙ্গল জুয়াল অঙ্কিত হয়। 

সুপ্রাচীন কাল হতে সকল  খাদ্যবস্ত্রবাসস্থানের নিমিত্ত কেবলমাত্র প্রকৃতির উপরই নির্ভরশীল। সেই অসীম আদি প্রকৃতির ইচ্ছা হলে তবেই মানব বা জীবকুল বেঁচে থাকে। প্রকৃতি মাতার অভ্যন্তরেই তো নানা রূপে থাকে অমৃত। চাষ আবাদ সবই তাঁর সেই অমৃতের ফসল। সবটাই সেই মহামায়া মহাদেবী মহালক্ষ্মী মহাবিদ্যা ব্রহ্মময়ীর সুপ্রসন্নতার উপর নির্ভর। সেই উদ্দেশ্যেইনেই পূজা হয় দ্বীপনিতা কার্তিক অমানিশায়। আর সম্মান , কৃতজ্ঞতা জানানো হয় পূর্বপুরুষদের যাঁরা প্রাচীন কাল থেকে অমৃতের সন্ধান দিয়ে এসেছেন। 

দেবস্থানে পূজা সম্পন্ন হলে সিজার আঁটিগুলি আগুন দিয়ে জ্বেলে ব্রতের শরিকরা বাড়ির পুকুর ঘাটে গিয়ে ছুঁড়ে দেয়। সেই সময় মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে বলে – ” আলোই দেখ”…. যেমন ,- ” আজুরে আজু আলোই দেখ ” অর্থাৎ , দাদু গো দাদু আলো দেখ অথবা “আতারে আতা , আলোই দেখ ” অর্থাৎ দিদিমা গো দিদিমা আলো দেখ। এরপরে সমস্বরে উচ্চারিত হয় , ” হুকারে হুকি আইজ থেকে পরম নুক।”

বাড়ি ফিরে ব্রতীরা বৌদি এবং বোনের কপালে কাজল ও সিঁদুরের ফোঁটা দেয়। আর সিজা ভেজানো জল এবং পাশোসি মাথায় ছিটিয়ে দেয়। 

হুকাহুকি ব্রতের ডালা বা ঢনটি গৃহস্থ বাড়িতে যত্ন করে রেখে দেওয়া হয়। 

এছাড়াও কালীপূজার ভোরে রাজবংশী সমাজে বাড়ির মেয়েরা #গরুচুমা অনুষ্ঠান করে। হম , গো এবং শস্যধনই তো সকল ধনের শ্রেষ্ঠ ধন। বিখ্যাত পন্ডিত ও বিদেশি ভারততত্ত্ববিদেরা আমাদের সনাতন শাস্ত্রে যেখানেই গো শব্দ পেয়েছেন তার অর্থ করেছেন গরু! কিন্তু হলায়ুধ সংস্কৃত কোষে পাওয়া যায় ‘গো’ শব্দের দশটি অর্থ যার সবকটিই সংস্কৃত সাহিত্যে ও কথ্য সংস্কৃতে প্রয়োগ হয়েছে! ‘গো’ শব্দের দশটি অর্থ হল- (১) দিশা,(২) দৃষ্টি,(৩) কিরণ,(৪) স্বর্গ,(৫)বজ্র,(৬)বাণী বা বেদান্তবাক্য,(৭) বাণ,(৮)বারি,(৯)ভূমি ও (১০) গরু নামক পশু। সকলের নিকটই আমরা কোনো না কোনোভাবে কৃতজ্ঞ।

বেদে বলা হয়েছে – অঘাসু হন্যতে গাবঃ কথাটার লৌকিক সরল অর্থ হল, সুপ্রাচীন যুগ হতে গরুই ছিল  প্রধান সম্পদ, বিবাহাদিতে যৌতুক হিসাবে গরুই দান করা হত। মঘা নক্ষত্রে সূর্যের কিরণ মন্দীভূত হয়, কাজেই কন্যার পিতৃপ্রদত্ত গবাদি পশু ঐ সময়েই পতি গৃহে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হত আর অর্জুন্যো পর্য্যুহ্যতে মানে ফাল্গুনী নক্ষত্রে কন্যা স্বামী গৃহে যাত্রা করতেন।

 মাতা রুদ্রাণাং বসূনাং স্বমাদিত্যনামমৃ তস্য নাভিঃ

প্র নু বোচং চিকিতুষে জনায়,মা গামনাগামদিতিং বধিষ্ট।( ঋ ৮/১০১/১৫)

এর অর্থ হল গরু হল বসু, রুদ্র আদিত্যদের কন্যা, মা ও ভগিনীর সমান।গরু দুধ অমৃত দান করে।সকলে জেনে রাখ গরু,,যার অদিতি,তাকে বধ করো না।

ঘৃতং দুহানামদিতিং জনায়াগ্নে মা হিংসী পর মে ব্যোমন্।১৩/৪৬

মানে মানুষকে যে ঘৃতদান করে তার নাম অদিতি, কাজেই তাকে হিংসা কোরো না।

যা বা যার থেকে মানব খাদ্য, বস্ত্র , বাসস্থান পায় বা উপকৃত হয় তাই পূজ্য। আদিম সনাতনী বিশ্বাস এমনই। প্রতিটি মানবজাতির মধ্যেই সেই ব্রহ্ম ও শক্তির অবস্থান ছিল নানাভাবে , নানা রূপে। সেখানে ব্রহ্মই হলেন রুদ্র , সয়ম্ভূ, আদিম এবং শক্তি হলেন আদি পরাশক্তি। তাঁরা বৃক্ষ, শিলা, জল, বাতাস , আলোক , নদী , ভূমি , সূর্য , চন্দ্র, গ্রহ, তারা  সর্বত্র অবস্থান করেন। নিরাকার থেকে তখন তাঁরা সাকার হয়ে ওঠেন।  তিনি অবস্থান করেন প্রতি জীবে , যাঁরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে উপকার করেন। 

বিষ্ণু রূপে শালগ্রাম শিলা, শিব রূপে লিঙ্গ , ধর্ম রূপে কুর্ম , দেবী রূপে বিবিধ যন্ত্র এবং ঘট পবিত্র বস্তু এবং গরু পবিত্র পশু। এগুলিই শূন্য ও শক্তি স্বরূপ। তুলসী সহ দেবতার পূজা প্রকৃতি , শূন্য অর্থাৎ পরম ব্রহ্মের পূজার নামান্তর।  সকল দেবদেবীর জর উপাসনা করা হয় তা সবই ব্রহ্মের উপাসনা। বিষ্ণু , শিব,  দুর্গা , কালী, শ্ৰী, সরস্বতী প্রমুখেরা ব্রহ্ম স্বরূপ। আমরা পরম ব্রহ্মকে যে ভাবে দেখি সেভাবেই তিনি দেখা দেন। সুরেশচন্দ্র বিদ্যানিধি বলেছেন – ” অতএব বিষ্ণু, দুর্গা, কালী প্রভৃতি সমস্ত দেবতাই তাঁদের উপাসকের  মধ্যেও উচ্চ নীচ নিরূপন হতে পারে না। “

তাই দুগ্ধ এবং বল প্রদানকারীনী গরুকে মাতা রূপে পূজা এক অতি সুপ্রাচীন প্রথা । গরুচুমা অনুষ্ঠানের দিন সাত সকালে বাড়ি ঘর দুয়ার পরিষ্কার করে কাঁচা হলুদ ও দুর্বা ঢেঁকিতে কুটে সর্ষের তেল দিয়ে কলার ঢনায় মাখে। তারপর বাড়ির মেয়েরা সব্বাই দল বেঁধে গোয়াল ঘরে গিয়ে গরুর কপালে তা মাখিয়ে দেয়। তার সঙ্গে সিঁদুরও মাখায় । এরই নাম গরুচুমা। গরুর গলায় সেদিন শোলার ফুল বেঁধে দেওয়া হয়। আর কলার পাতা ও কলার #ঢাভি  দিয়ে তৈরি #চটপুটিয়া গোয়ালঘরে রেখে দেওয়া হয়। 

এই গোপূজন পরব ঠিক কালীপূজার পরের দিন রাঢ় বঙ্গের ঘরে ঘরে পালিত হয়। একটি সুসঙ্গত সমাজে মানুষ যখন একই ভৌগোলিক পরিবেশে বসবাস, ঐতিহ্য রক্ষা, প্রায় একই জীবন যাপন করে তখন সেই সুসঙ্গত সামাজিকদের #লোক বলা যেতে পারে । 

স্বভাবগতভাবেই সব লোক সাধারণত ধর্ম প্রবণ হয়ে থাকে। পল্লী সমাজের বুকে আজও অতীত স্মৃতি সত্তা লুকিয়ে আছে অনুসন্ধান, প্রকাশের অপেক্ষায় ।  যার যথাযথ অনুসন্ধান ও প্রকাশের ফলে যা ইতিহাসের নতুন অধ্যায় উন্মোচন করে দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে শ্রী রাধাগোবিন্দ বসাক মহাশয় এর মন্তব্য , তিনি বলেন যে  , ” যে পর্যন্ত না কেউ  এই দেশের লৌকিক দেবতা বিষয়ে লিখেছেন সে পর্যন্ত বঙ্গের সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অলিখিত থেকে যাবে। “

  শ্রদ্ধেয় গুরুসদয় দত্ত মহাশয় বহু অজানা তথ্য আবিষ্কার করেছেন । বর্তমানেও বহু তথ্য সন্ধানী লোকসংস্কৃতি গবেষক এই কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তুলে ধরেছেন জেলাগুলির সুমহান ঐতিহ্য । আমার বর্তমান আলোচনা সেই বহমান লোকসংস্কৃতির একটি ক্ষুদ্র অংশ।

 এরম একটি উৎসব বা পূজার হলো গরাইয়া উৎসব।

 গরাইয়া  শব্দ কোথা থেকে এসেছে এটা বলা মুশকিল ? তবে মনে হয় গরু থেকে এসেছে গরাইয়া। কারণ গাই জাগার একটি আহিরা গীত গাওয়া হয় । 

আমিতো যাত্যএ ছিলি

 কুলহিয়ে কুলহিয়ে ভাই

 তরি গেইয়া আনল ঘুরাই 

এখানে গেইয়া শব্দটি এসেছে গাই থেকে। তাই যদি গেইয়া গাইয়া হয় তবে । গরু থেকে গরুয়া  , এই গরুয়া থেকেই কালে কালে গরুয়া – গয়রা –  গরাইয়া হয়েছে।

 সাধারণভাবে পুরুলিয়া  অঞ্চলের মানুষ জনের গৃহে পূজা টি দেখতে পাওয়া যায়।  কালী পূজা বা তার পর দিন  অমাবস্যা থাকতে থাকতেই পূজা টি অনুষ্ঠিত হয়। 

ধান দূর্বা ,ধুপ ধুনো , আতপ চাল ,জ্বলন্ত প্রদীপ প্রভৃতি উপাচারের সাথে একটি মোরগ , একটি মুরগি কিংবা ছাগল বা ভেড়ার পাঁঠা ও পাঠি বলি দিতে হয় ।

গোয়াল ঘর টি কে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে , গরু বাধার খুঁটি  , পাঘা , গরুর গোবর ফেলা ঝুড়ি , ঝাঁটা কে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিতে হয় । গোয়াল ঘরের মধ্যে একটি সাময়িক উনুন তৈরি করে ঘি এর  আবগা গুড়ের পিঠে ছাকতে হয় । এই পিঠে দুধ দিয়ে আতপ চালের গুড়িকে মেখে গুড় সহযোগে  বিশেষ পদ্ধতিতে ঘিয়ে ভাজা । এক্ষেত্রে জল স্পর্শ করা চলে না

। এই পিঠে মাসাবধি থাকলেও বিকৃত হয় না ।

গোয়ালের আগুড় বা কপাট কোণে একদলা চিমতে মাটির উপর একটা দেড় ফুট লম্বা শাল কাঠের  গোঁজ গুঁজে দিতে হয়।  গোঁজের মাথায় একটি খাপ কাটতে হয়।  হয় ফলে এটি অনেকটা শিব লিঙ্গের আকার নেয় । শিবলিঙ্গ যা সয়ম্ভু, আদি , সৃষ্টির প্রতীক।  একটি সুধী শালুকের ফুল জড়িয়ে দিতে হয় । মনে হয় এই ফুল গাভীদের পুষ্পবতী হওয়ার প্রতীক ।ফুলটি শালুক ফুলের মতো দেখতে হলেও আকারে ছোট এবং বৃতি ও পাপড়ি গুলো নীলাভ । এরা দিনের বেলা ফুটে

 এই ফুলটি প্রেম নিবেদনের প্রতীক।

 একটি ঝুমুরে আছে 

 ” সুধী শালুকের ফুল গো,

 আঁধার রাতে ফোটে বধু…

  যার সঙ্গে যার ভাব থাকে

 মরিলে কি ছুটে বধু

 এত রাত কি সে?

  এই থেকেই মনে হয় এই শালুক প্রেম ও মিলনের প্রতীক।

পূজা অনুষ্ঠিত হয় কপাট কোণে। কপাট কোন গোপনীয়তার প্রতীক ।  মিলন কোন গুপ্ত স্থানে সংঘটিত হয়।

বাড়ির একজন এও স্ত্রী ধান দূর্বা , পিঠে ইত্যাদি নিয়ে শঙ্খ ধ্বনি , উলুর মাধ্যমে খুটি, পাঘা, বাগালের পেনা (পাচঁন), বাগাল ও শাল কাঠের গোঁজ টি পুজো করতে থাকে । থালায় যে নয়টি গুড় পিঠে থাকে তা বাগালের প্রাপ্য । নয় পিঠে নবগ্রহের প্রতীক , যাকে সাক্ষী রেখে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মূল গোয়াল ঘরে শ্রীবৃদ্ধি কামনা উদ্দেশ্যে পূজা হয় ।

এরপর বাগাল , গাই গরু শিঙে তেল মাখিয়ে চকচকে করে এবং নানা রঙে গাইগরুকে রাঙিয়ে দেয়। এর পরের দিন থেকে শুরু হয় বাঁধনা পরব। মাহাতো কুর্মি  ও অন্যান্য জনজাতির মানুষেরা গড়াইয়া পুজো করে থাকেন। 

” সুধী শালুকের ফুল রাজা হে,

 ওহে ফুটে আধা রাতে

 যার সঙ্গে যার দেখা নাই রাজা 

হে দেখা হবে আজ্যে রাতে।”

মহারাষ্ট্রে দীপাবলির দিন কয়েক আগেই পালিত হয় ‘গোবৎস দ্বাদর্শী’। একে বলে ‘বাসু বরস’ উৎসব। এ ক্ষেত্রে ‘গো’ অর্থাৎ ‘গাভী’ এবং ‘বৎস’ অর্থাৎ ‘বাছুর’। মরাঠি ভাষায় ‘দ্বাদর্শী’ বা ‘বরস’ মানে চন্দ্রমাসের দ্বাদশ দিন। এই ‘বাসু বরস’ দিনে মরাঠি সম্প্রদায়ের মানুষজন গরু-বাছুরের পুজো করে। পুরাকালে রাজা ভিনা ছিলেন একজন খুবই অত্যাচারী শাসক। তাঁর অসৎ রাজ্যশাসনে ও প্রজাদের ওপর অত্যাচারে পৃথিবী ক্রমশ নিষ্ফলা হয়ে পড়েছিল। রাজা ভিনার পুত্র পৃথু এই পৃথিবীকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করতেন। পৃথিবী তখন গাভীর রূপ ধারণ করে অনর্গল দুগ্ধদানে রাজ্যকে আবার সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা করে তোলেন। সমগ্র মহারাষ্ট্রবাসী তাই কৃষ্ণপক্ষের দ্বাদশীর দিনটিতে গো-মাতার পুজো করে।

হেমন্তিকা এসো এসো হিমেল শীতল বন-তলে

শুভ্র পূজারিণী বেশে কুন্দ-করবী-মালা গলে।।

            প্রভাত শিশির নীরে নাহি’

            এসো বলাকার তরণী বাহি’

সারস মরাল সাথে গাহি’ চরণ রাখি’ শতদলে।।

ভরা নদীর কূলে কূলে চাহিছে সচকিতা চখি —

মানস-সরোবর হ’তে-অলক -লক্ষ্মী এলো কি?

            আমন ধানের ক্ষেতে জাগে

            হিল্লোল তব অনুরাগে,

তব চরণের রঙ লাগে কুমুদে রাঙা কমলে।।

কার্তিক মাস,হিম হিম ধূসর হেমন্তিকার আগমনী। ঋতু হেমন্ত,  হাওয়ার বদল  টের পাওয়া যায়। সে এসে গিয়েছে। কুয়াশায় আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটু দূরে। একটা আলো দেখালে হয়তো তার সুবিধে হবে আসতে। যদিও সে এসে গিয়েছে বলে উত্তর দিক থেকে একটা হাওয়া বইতে শুরু করে। ওই হাওয়ায় প্রদীপগুলোর অসুবিধে হয় খুবই! কিন্তু তারা সেটা গায়ে মাখে না।

 বাঁশের ডগায় নিশ্চিন্তে বসে, কাচ বা কাপড়ের ঘেরাটোপে আকাশ প্রদীপ। মাঠে মাঠে সোনার বরণ ফসল রূপকথার গল্প বলে। উল্লাসে তারা মেতে ওঠে। শিউলীরা খেঁজুর রসের জন্য গাছ কামানোর তোড়জোড় শুরু করেন। কচুর পাতায়, ঘাসের ডগায় একটি একটি শিশির বিন্দু সকালের মিষ্টি রোদের ছোঁয়ায় মানিকের ন্যায় টল টল করে ওঠে। ধানের ক্ষেতে হেমন্তিকা লক্ষ্মীর গলায় শিশির জালির মায়াবী মালা ঝোলে। সন্ধ্যা নামে, আঁধার হয় মাদার গাছের তলা….অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে

চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে ব’সে আছে…

ভোরের দোয়েল পাখি- চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ

জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশ্বত্থের ক’রে আছে চুপ;

ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;

মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে

 হেমন্তিকা সন্ধ্যার অন্ধকারে সনাতনী ভারতের গৃহে গৃহে তোড়জোড় সূচিত হয়  প্রদীপ জ্বালানোর। তুলসী তলায় সনাতনী নারীগণ তাদের চিরন্তন গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করে। মঙ্গল শঙ্খ ধ্বনিত হয় গৃহে গৃহে। আর ? আর কার্তিক অমাবস্যাকে কেন্দ্র করে নানা লোকাচারের মাধ্যমে সনাতনী বঙ্গ তথা ভারত এক হয়ে যায়।

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ১ . উত্তর গ্রাম

২. বাংলার মুখ

৩. বাংলার ব্রতকথা

৪. ঋগ্বেদ

৫.হুড়া থানার লৌকিক দেবদেবী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.