সে তখন অনেক রাত। তখন তো গ্রামগুলোতে আর শহুরে ছোঁয়া লাগেনি। তাছাড়া, যে সময়ের কথা বলছি তখন শীতের বেলায় সূর্য ডুবলেই রাত য়য়ে যেত। তার উপরে অমাবস্যা হলে তো আর কথাই নেই। সে এক নিশ্ছিদ্র আঁধার, শিয়াল ডাকত…রাতচরা পাখি আওয়াজ করে উড়ে যেত। কোনো প্রাচীন ভাঙা মন্দির কি জঙ্গলের মধ্যে থেকে তক্ষক ডেকে উঠত। কৃষ্ণপক্ষে পথ চিনে চলার উপায় কেবল সুদূর নক্ষত্রের আলোক। তবে কুয়াশায় সেসব আদৌ কোনো রাতচলা পথিকের কাজে লাগত কি না জানা নেই…! এক মধ্যবয়সী গৌরবর্ণের এক ব্রাহ্মণ ওড়গাঁও হয়ে চান্না গ্রামের দিকে চলেছেন। 

 জায়গা টা বর্ধমান। এখন যেখানে গুশকরা  স্টেশন সেখান থেকে তিনমাইল দূরে ওড়গাঁও নামের এক গ্রাম আছে। এক সময় সেসব জায়গা ধূ ধূ প্রান্তর ছিল। দূর দূরে বাড়ি , আরো দূরে একটা করে গ্রাম। মাঠের মাঝে গর্ত করা। কোথাও কোথাও কিছু কিছু তালবৃক্ষ  , খর্জুর বৃক্ষ একপায়ে প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। চোখে পড়ে দু একটি পুকুর কি দীঘি। মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে অপর প্রান্তের দিকে তাকালে মনে হয় আকাশ আর মাঠ দিগন্তের বুকে মিশে এক হয়ে গেছে। এসব মাঠ, এসব এলাকায় এক সময় ডাকাতের রাজত্ব ছিল। কত মানুষকে যে এই মাঠে মেরে পুঁতে দিত তার কোনো হিসাব নেই।  গাঁ ঘরের লোকজন প্রাণ ভয়ে মুখে রা টি কাটত না। 

ওড়গাঁও থেকে বেশ খানিক দূরে চান্না গ্রাম। সেখানে ভারী উপদ্রব । কাদের ? না না গাঁ গঞ্জ মায় শহরে ভূতপ্রেত থাকবেই। ওসব ভূতের ভয় নয়। উপদ্রব ছিল ডাকাতের। লোকের মুখে মুখে প্রবাদ ঘুরত –

যদি যাও চান্না 

ঘরে উঠল কান্না।

তো সেই ব্রাহ্মণ সেরাত্রি আঁধারে শিষ্যগৃহ হতে প্রাপ্ত  কিছু চাল, ডাল , গুড় , তরিতরকারি নিয়ে ফিরছিলেন। নির্জনপথ দিয়ে চলতে চলতে তিনি গান ধরেছেন …মায়ের গান , সব বিপদ আপদ কাটিয়ে দেবে।

তোমার গলে জবা ফুলের মালা, কে দিয়াছে তোমার গলে। যত

সমরপথে, নেচে যেতে, রয়ে রয়ে রয়ে দুলে॥

রণতরঙ্গ প্রথম সঙ্গ, চিকুর আলায়ে উলঙ্গ, কি কারণে লাজভঙ্গ,

শিব তব পদতলে॥

নির্জন সেই গভীর  কৃষ্ণনিশায় আর কোথাও কোনদিকে তাঁর মন নেই। একমনে গান গাইতে গাইতে হেঁটে চলেছেন।  এমন সময় অকস্মাৎ হা রে রে রে রে রে .. ভয়াল শব্দে ,মাঠ কাঁপিয়ে ডাকাতের দল এলো তেড়ে। একাকি ব্রাহ্মণ…ডাকাতি করতে বেরিয়ে ওসব বামুন কায়েত শুদ্দুর এসব দেখলে চলে? ডাকাতের কাছে সকলেই শিকার। যা থাকবে নিয়ে টুঁটিটিপে মেরে পুঁতে দিলেই চিত্তির। সর্দার ব্রাহ্মণকে বল্লম সরকি দেখি ভাঁটার মতো রক্তবর্ণ চক্ষুদ্বয় বার করে বললে , ” বাউন কি আচেক তুর কাচে টো ? দে দেকি…! না হলি হেথায় জ্যান্ত পুঁতে দে যাব ।”

ব্রাহ্মণ স্মিত হেঁসে বললেন , ” বাবারা , আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ …. শিষ্যগৃহ হতে সামান্য সিধে নিয়ে ফিরছি। চাল, ডাল, গুড় এইসবই আছে আর সঙ্গে আছে এই ছাতাটি। এসব যদি তোমাদের কাজে লাগে, দরকার হয় নিয়ে যাও। ” এতেক বলে ব্রাহ্মণ প্রাণখোলা হাঁসিতে হেঁসে উঠলেন।  এদিকে ডাকাতরা ব্রাহ্মণের শরীর তন্ন তন্ন করে খুঁজে শিষ্যগৃহ থেকে প্রাপ্ত সকল কিছু নিয়ে নিল।

ব্রাহ্মণের বাস কোতলহাটি। এখনো অনেকটা পথ বাকি। সর্বস্ব কেড়ে নেবার পরে , ব্রাহ্মণ বললেন , ” সব তো নিলে বাবারা…এবার ছেড়ে দাও। ” 

সর্দার অট্টহাস্য করে বললেন , ” বাউন…মুরা কাউরে ধরলি সারি দি লা। তুরে মেরে এই মাটের মধ্যি গর্ত করি পুঁতে দে যাব। মরণের জন্যি তৈরি হ….”

একথা শুনে ব্রাহ্মণ হাঁসতে লাগলেন , বললেন , ” এই দরিদ্র ব্রাহ্মণকে হত্যা করে কেবল তোমাদের ব্রহ্ম হত্যার পাপ ব্যতীত অপর প্রাপ্তি ঘটবে না। “

সর্দার বললে, ” বাউন…লীতি কতা শিকাসনে… মুদের কাছে টো উসব উঁচু লিচু হয় লা। মুদের কাছে শিকার টো শিকার ই হয়।”

ব্রাহ্মণ বললেন , ” বেশ তাহলে, মেরেই ফেলো। কিন্তু মরবার আগে আমাকে একবার মায়ের নাম করতে দাও। মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ ইচ্ছা পূরণ করাই বিধি।”

ডাকাতরা কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে আলোচনা , চিন্তা করল। তারপর ভেবেচিন্তে সর্দার বলল, ” টিক আচে , তাড়াতাড়ি লাম গান কর। তারপর মরবি…”

ব্রাহ্মণ যোগাসনে বসলেন , ডাকাত দল তাঁকে ঘিরে বসল। ধরলেন মায়ের গান রামপ্রসাদী সুরে।

আর কিছু নাই শ্যামা তোমার

কেবল দু’টি চরণ রাঙা,

শুনি তাও নিয়াছেন ত্রিপুরারি

অতেব হ’লাম সাহস-ভাঙা।

জ্ঞাতি বন্ধু সুত দারা

সুখের সময় সবাই তারা,

কিন্তু বিপদকালে কেউ কোথা নাই

ঘর-বাড়ি ওড়গাঁয়ের ডাঙা।

নিজগুণে যদি রাখো

করুণানয়নে দ্যাখো,

নইলে জপ করে যে তোমায় পাওয়া

সেসব কথা ভুতের সাঙা।

ব্রাহ্মণের অপূর্ব আবেগ মিশ্রিত গলা, মন কেমন করে ভক্তিরসের সুর- শুনে ডাকাতদের চোখে জল এলো। সর্দার বললে, ” বাউন ঠাকুর তু আর একটো গান ধর্ । “

আকাশে তখন কুমড়ো ফালির মতো কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে। ছেঁড়া কুয়াশার মধ্যে দিয়ে উঁকি মারা চাঁদের দিকে একবার তাকালেন ব্রাহ্মণ , একবার ডাকাতদের মুখ গুলো দেখার চেষ্টা করলেন। রাতের আঁধার তখন চোখে সয়ে এসেছে। চক্ষু মুদে আবার গান ধরলেন – 

তোমার ভাল চিন্তা সদা, করিগো ! 

তোমার নিকটে । 

দুঃখে যাক সুখেই যাক জেনেছি, 

যে আছে লিখন ললাটে ।

 বারে বারে ভ্রমণ করি, মা ! 

আমার এই কৰ্ম্ম বটে। 

কিন্তু দীন দেখে যদি দয়া কর, 

তবে দীন দয়াময়ী নামটি রটে। 

গান শেষ হল। ব্রাহ্মণ শান্ত সমাহিত কন্ঠে ডাকাত সর্দারকে বললেন , ” সর্দার আমার নাম গান সমাপ্ত হয়েছে। আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। মারো আমাকে এইবার। ডাকাত সর্দার ব্রাহ্মণের মুখপানে অবাক হয়ে চেয়ে রইলে, যেন সে জীবনের সকল পাপশক্তি বাকশক্তি হারিয়েছে। তারপর কম্পিত কন্ঠে বললে, ” ঠাকুর তুমি আর একটো গান করো। আমরা শুনব।”

ব্রাহ্মণ আপন হৃদয়ে জগন্মাতার মুখখানি স্মরণ করে জপ করলেন – 

কালি কালি মহাকালি কালিকে কালরাত্রিকে | 

ধম্মকামপ্রদে দেবি নারায়ণি নমোস্তু তে || 

চারিদিক নিস্তব্ধ। সুবিশাল মাঠের কোনো প্রান্ত থেকে শিয়াল ডেকে ওঠে। দূর ক্ষেত থেকে ঝিল্লি রব ভেসে আসে। কুয়াশার মধ্যেও একফালি কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্র কেমন উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। ব্রাহ্মণ সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে গান গাইলেন – 

মন! চলো শ্যামা মার নিকটে

মা মোর অগতির গতি বটে।

যার যে বাসনা , মনেরই কামনা,

সেখানে সকলেই ঘটে।

অল্প পুণ্যভরা সাজিয়ে পসরা,

এনেছে ভবের হাটে।

যা করো উপায় পাঁচে মিলি খায়,

কলঙ্ক তোমারই রটে!

গান সমাপ্ত হল। চারিদিকে আবার সেই নিস্তব্ধতা। ডাকাতদল ব্রাহ্মণের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে আরম্ভ করল। সেই ক্রন্দনের শব্দ নির্জন প্রান্তরে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। সে কান্না যেন কোনো বিবেক দংশনের কান্না। কোন অতৃপ্ত আত্মার মুক্তির জন্য কান্না। ডাকাত ডুকরে ডুকরে কেঁদে বলতে লাগল , ” ঠাকুর গো ও ও ও ও হ , খেমা করি দাউ টো। মুরা সকলে পাপী টো আসি। তোমার সক্কল জিনিস লিয়ে লাও গো। তুমাকে মারলি মুদের লরকেও ঠাঁই হবে নি গো ওও ও…খেমা করো।”

ব্রাহ্মণ জয় মা , জয় মা , জয় জগদম্বা শ্যামা মা …মা মা গো…রব তুলে মা ব্রহ্মময়ীকে ডাকতে লাগলেন। ডাকাত দলও ব্রাহ্মণের গলায় গলা মিলিয়ে মা মহাকালীকে ডাকতে লাগল। তারপর ডাকাত দল ব্রাহ্মণকে কোটলহাটি গ্রামে পৌঁছে দিয়ে আসল। পর দিবস প্রাতে ঊষা লগ্নে শুদ্ধভাবে সম্পূর্ণ ডাকাত দলটি সেই ব্রাহ্মণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করল। 

এরপর সেই ডাকাত দল ডাকাতি ত্যাগ হল ভক্ত। 

মন রে কৃষি কাজ জান না।

এমন মানব-জমিন রইলো পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা।।

কালীনামে দেওরে বেড়া, ফসলে তছরূপ হবে না।

সে যে মুক্তকেশীর শক্ত বেড়া, তার কাছেতে যম ঘেঁসে না।।

কৃষিকাজ , গোপালন করে তাঁরা সাধারণ মানুষের মতো জীবনধারণ করতে লাগলেন। এখানেই হল ভক্তের জয়। 

পূজয়ংনশ্চ পঠংশ্চৈনমিতিহাসং পুরাতনম্।

সর্বপাপৈঃ প্রমুচ্যেত দীর্ঘমায়ুর বাপ্নুয়াৎ।।

ধর্মের জয় এবং  অধর্মের পরাজয় এই হল মূল কথা। অধর্মের দ্বারা মানুষ যত ঐশ্বর্য লাভ করুক না কেন পরিণাম তার বিনাশ হয়। ধর্ম থাকে প্রেম, ভালোবাসা, ত্যাগ , ষড়রিপু জয়ের মধ্যে ….প্রাচীনতার মধ্যে, অতীত ঐতিহ্যকে সম্মানের মধ্যে। ধর্মের জয়ের অন্যতম পথ হল প্রকৃতি, আরণ্যক, জীব ও মানবপ্রেম, যা সকল রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতির ঊর্ধ্বে অবস্থান করে।

মানবের জীর্ণ বাক্যে মোর ছন্দ দিবে নব সুর,

অর্থের বন্ধন হতে নিয়ে তারে যাবে কিছু দূর

ভাবের স্বাধীন লোকে, পক্ষবান্‌ অশ্বরাজ-সম

উদ্দাম-সুন্দর-গতি– সে আশ্বাসে ভাসে চিত্ত মম।

সূর্যেরে বহিয়া যথা ধায় বেগে দিব্য অগ্নিতরী

মহাব্যোমনীলসিন্ধু প্রতিদিন পারাপার করি,

ছন্দ সেই অগ্নিসম বাক্যেরে করিব সমর্পণ–

যাবে চলি মর্তসীমা অবাধে করিয়া সন্তরণ,

গুরুভার পৃথিবীরে টানিয়া লইবে ঊর্ধ্বপানে,

কথারে ভাবের স্বর্গে, মানবেরে দেবপীঠস্থানে।

চান্নার সেই বিখ্যাত মাঠে রাত্রি নিশীথে দস্যু কবলে যিনি সেদিন পড়েও মায়ের নাম করে স্থির বুদ্ধি , ধৈর্য্যবাণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি দেবী কালীর পরম ভক্ত সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। বর্ধমান জেলার অম্বিকা কালনা গ্রামে অনুমানিক ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে এই মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়। 

সাধক কমলাকান্ত আজ আর জীবিত নেই। মহাকালীর সংসারে মহাকালের চক্রের নিয়মে তাঁকে একদিন চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু তিনি আমাদের মধ্যে জীবিত তাঁর কর্মের দ্বারা, তাঁর নাম …তাঁর গান দ্বারা। 

ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্

নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ ।

অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো

ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ॥

তাই  হে অমৃতের পুত্রকন্যা এমন  কর্ম  করা উচিৎ যাতে জগৎ মাঝে তুমি মৃত্যুর পরেও শ্রেষ্ঠ আসন নিয়ে অমর হয়ে থাকবে , অমর হয়ে থাকবে তোমার আত্মা।

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন| 

মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি||

সেই অষ্টাদশ শতকের  শীতের কৃষ্ণপক্ষের নিশায় যে স্থানে নতুন করে এক বাল্মীকি প্রতিভার  সৃষ্টি হয়েছিল, সেই স্থানটুকু গ্রামবাসীদের নিকট পবিত্র স্থান বলে চিহ্নিত হয়েছে। এখানে উদাত্ত কন্ঠে কমলাকান্ত মায়ের নামগান করেছিলেন। 

সেই ডাকাতদের বংশধরগণ এখনোও এই গ্রামেই আছেন। তাঁরা এই স্থানে আজও পূজা দেন। কেউ গেলে সেই পূর্বপুরুষদের গল্প শোনায়। আর বলেন অধর্মকে সরিয়ে রেখে ধর্মের জয় হয়েছিল এই গ্রামেই। 

কালী কালী বল রসনা 

করপদ ধ্যান নমামৃত পান 

যদি হতে প্রাণ থাকে বাসনা ||

ভাই বন্ধু সুত দ্বারা পরিজন,

সঙ্গেরও দোসর নহে কোনো জন |

দুরন্ত শমন বাঁধিবে যখন,

চিনে ঐ চরণ কেহ কারো না ||

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ১. কালিকাপুরাণ

২. কমলাকান্তের গান

৩. কালীকথা

৪.ভারতের সাধক

৫.ডাকাত কালী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.