১৯৭৫ সালে কংগ্রেস জরুরী অবস্থা জারি করলে নাগরিক স্বাধীনতা স্থগিত করার পাশাপাশি কিভাবে সাংবাদিকতার কন্ঠরোধের চেষ্টা করা হয়েছিল, প্রবীণ সাংবাদিক কোমি কাপুর তাঁর রচিত বইয়ে তার ই উল্লেখ করেছেন।
এখানে “দ্য ইমার্জেন্সী: অ্যা পারসোনাল হিস্ট্রি” থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হল—
“বিদ্যাচরন শুক্লা ছিলেন মধ্যপ্রদেশের সমৃদ্ধশালী এবং শক্তিশালী মুখ্যমন্ত্রী রবিশঙ্কর শুক্লার ছোট ছেলে। তিনি মধ্যপ্রদেশে একটি বন্যপ্রানী শিকার অভিযান চালানোর ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন এবং খুব আমোদ প্রমোদে জীবন কাটানোর জন্য সুপরিচিত ছিলেন….. ওবেরয় হোটেলে চুল কাটা, হোটেলের সুইমিং পুলে সাঁতার কাটা, উন্নত মানের সাফারি পোশাক পরা তার জীবন যাপনের প্রধান অঙ্গ ছিল। তিনি তার পার্টির সহকর্মীদের সাদা খাদির পোশাক দান করতেন।
তথ্যমন্ত্রী হিসাবে শুক্লা তাঁর প্রথম দিনেই জানিয়েছিলেন যে রেডিও এবং অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের ডিরেক্টররা যেন খুব দায়িত্ব সহকারে অধঃস্তনদের পরিচালনা করেন যাতে কোনো ভুল নজর এড়াতে না পারে।
তিনি আদেশ দেন যে, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর সাহায্য নিয়ে সমস্ত সম্পাদক এবং সংবাদদাতাদের সম্পর্কে সব তথ্য যেন তৈরি রাখা হয়। তবে বিদেশী সংবাদদাতাদের সম্পর্কে তাঁর বিশেষ জ্ঞান ছিল না।
দায়িত্ব গ্ৰহনের পর তিনি দিল্লীর সমস্ত সম্পাদকদের নিয়ে একটি বৈঠক ডাকেন এবং সেখানে তাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন যে আজেবাজে কথা সরকার কোনোভাবেই সহ্য করবে না। সরকার এবং প্রেসের মধ্যে কোনো প্রকার দ্বন্দ্ব যেন তৈরী না হয়। সরকার বিরোধী প্রতিবাদ বা মতবাদ সহ্য করা হবে না। সম্পাদকরা মন্ত্রীর সাথে কোনোপ্রকার তর্কে জড়াননি। ঐ বছরই সেপ্টেম্বরে আরও একটি বৈঠক ডাকা হয় এবং এই বৈঠকে ‘ন্যাশন্যাল হেরাল্ডে’ এর সম্পাদক চলপতিরাও, জরুরী অবস্থা চলাকালীন যার আচরণবিধি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিল, তিনি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা শারদা প্রসাদের কাছে মন্তব্য করেন যে — “আমি সহকর্মীদের এমন অভিনয় আগে কখনও দেখিনি এমনকি ব্রিটিশ শাসনের সময়েও নয়”।
‘দ্য হিন্দু, দ্য হিন্দুস্থান টাইমস, টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র মতো সংবাদপত্রগুলি নিজেদের পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিল। তারা সরকারের দ্বারা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল। ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এর তৎকালীন সম্পাদক এস.নেহাল সিং বলেছিলেন যে: “যেটা আমি নিজে পারিনি, সেটা টাইমস্ অফ ইন্ডিয়ার সম্পাদক শ্যাম লালে’র মতো বিনয়ী মানুষ এই জরুরী অবস্থা চলাকালীন মেনে চলেছিলেন”। যেদিন
মিসেস গান্ধী নির্বাচনে পরাজিত হলেন সেদিন তিনি সম্পাদকীয় লেখার মাধ্যমে এই জরুরী অবস্থা নিয়ে সমস্ত রাগ বের করে ছিলেন।
পরে জনসংঘের নেতা এল.কে.আডবানি মন্তব্য করেছিলেন যে ‘প্রেসকে বাঁকতে বলা হয়েছিল কিন্তু তারা হামাগুড়ি নির্বাচন করেছিল’।
গ্যাবেলসের বইয়ের থেকে একটি পৃষ্ঠা বের করে শুক্লা তাঁর অনুগত পুলিশ অফিসার কে. এন.প্রসাদকে বিশেষ ডিউটির নাম করে মন্ত্রকে নিয়ে এসেছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি শুক্লার অত্যন্ত আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন এবং সংবাদ মাধ্যমের সমস্ত বিষয়ে তাঁকে অবহিত করতে থাকেন। শুক্লার নেক নজরে থাকা এই পুলিশকর্তা তার সহকর্মীদের সাথে নিয়ে মিডিয়ার সমস্ত কাজকর্মের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার জন্য চোদ্দোজন আইপিএস অফিসারকে এইকাজে নিয়োগ করার আবেদন জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে। আইপিএস অফিসাররা এইকাজে মূখ্য ভূমিকা পালন করবে বলে তিনি মনে করতেন। তাঁর মত অনুযায়ী ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর থেকে সিআইএস( সেন্ট্রাল ইনফরমেশন সার্ভিস) অফিসাররা সাংবাদিকদের মুখোমুখি উপর খুব কাছ থেকে নজর রেখে তথ্য সংগ্রহের কাজটি ভালোভাবে করতে পারবে। ঐ বছরের শেষের দিকে তেত্রিশজন সংবাদদাতাদের সরকার বিরোধী লেখার জন্য চরম অসম্মানিত করা হয়। প্রসাদ পরবর্তী সময়ে শাহ্ কমিশনের কাছে স্বীকার করেছিলেন যে তিনি ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন যে ঐসব অসম্মানিত সংবাদদাতারা আরএসএস এর মতো কোনো নিষিদ্ধ সংস্থার সঙ্গে যুক্ত কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে। জরুরী অবস্থা জারি হওয়ার দুদিনের মধ্যেই দিল্লীর সমস্ত সংবাদপত্রের অফিসে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে সেন্সরশিপ আরোপ না হওয়া পর্যন্ত কোনো সংস্করণ ছাপা হতে না পারে। আমাদের মাতৃভূমি,যা সেসময় শ্রীমতী গান্ধীর পক্ষে কাঁটার মতো ছিল,তাকে এক দীর্ঘসময়ের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। জয়প্রকাশের অফিসে পুলিশের সাপ্তাহিক অভিযান চলত। রামনাথ গোয়েঙ্কার কেনা “এভরিম্যান’স” এর শেষ সংস্করণটি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। এভরিম্যানের সমস্ত কর্মচারীরা ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এ স্থানান্তরিত যায়, এমনি এর সম্পাদক অজিত ভট্টাচার্যও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সহ-সম্পাদক হিসাবে যোগ দেন এবং ডিআইআর এর ৪৮নং ধারা অনুযায়ী সেন্সরশীপ আরোপ করা হয়। যদিও প্রযুক্তিগত দিক থেকে এটি সুরক্ষা সমস্যা এবং জনসাধারণের নির্দেশ সম্পর্কিত ব্যাপার ছিল, কিন্তু সেইসময় সরকার বা শাসক বিরোধী সবকিছুই নিষিদ্ধ করার নির্দেশিকা জারি করা হয়েছিল এবং বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল যে এই নির্দেশিকাটি কোনোভাবেই প্রকাশ করা যাবে না। মিসা এবং ডিআইআর এর আওতায় গ্ৰেপ্তার হওয়া মানুষের নাম বের করা চলবে না।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ২৮শে জুন দিল্লী থেকে একটি সংস্করণ প্রকাশ করে বলেন যে অফিস বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে তারা দুদিন অনুপস্থিত ছিল এবং এইজন্য ক্ষমাও চেয়ে নেন। এইঘটনার পর তাদের প্রথম সম্পাদকীয় অংশটি ফাঁকা রেখে দেওয়া হয়। এদেরই যমজ প্রকাশনী সংস্থা ‘ফিন্যান্স এক্সপ্রেস’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা অনুলেখন করেন—
‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য
উচ্চ যেথা শির’।
এবং প্রার্থনা শেষ করা হয় এইভাবে ‘ হে পিতা! স্বাধীনতার স্বর্গে আমার দেশকে জাগ্ৰত করুন’।
‘দ্য স্টেটসম্যান’ ও ফাঁকা অংশ রেখে দেন এবং জানান যে সংবাদপত্রের বিষয়টি সেন্সরের আওতায় চলে গেছে।
এইসময় দাবি করা হয় যে, কিছু সংবাদপত্র তাদের অধিকারের অপব্যবহার করে, দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য এবং ভুল খবর পরিবেশনের মাধ্যমে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। সেন্সর বোর্ডের পক্ষ থেকে সাত তাড়াতাড়ি সমস্ত সম্পাদকদের নির্দেশ দেওয়া হয় যে তাঁরা যেন সম্পাদকীয় কলমটি ফাঁকা রাখেন বা সাহিত্যের বিখ্যাত কিছু সৃষ্টির উদ্ধৃতি কিংবা গান্ধীজী, রবীন্দ্রনাথ, নেহেরুর মতো জাতীয় নেতাদের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করা যেন না হয়। এমনকি শ্রীমদ্ভগবদগীতার উদ্ধৃতিও নিষিদ্ধ করা হয়। তামিল ম্যাগাজিন ‘ত্থুগলক’ এর সম্পাদক চো রামাস্বামীর থেকে জানা যায় যে ঐসময় হাস্যরসাত্মক কথা, ব্যাঙ্গচিত্র, ব্যাঙ্গাত্মক রচনা এমনকি ডিআইআর বিরোধী দূরসম্পর্কিত কোনো রচনাও সেন্সরশিপের আওতায় চলে গেছিলো। তাঁর ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে মোরারজি দেশাইকে জন্মদিনে অভিনন্দন জানানোও নিষিদ্ধ ছিল। জওহরলাল নেহরু প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল হেরাল্ড জরুরী অবস্থা চলাকালীন পুরো সময় ধরে সরকারকে সমর্থন জানিয়ে গেছেন এবং তাদের সংবাদপত্রের শীর্ষভাগ থেকে খুব সতর্কভাবে ‘স্বাধীনতা ধ্বংসের মুখে, আপনার সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে রক্ষা করুন’ উদ্ধৃতিটি সরিয়ে ফেলেছিলেন। জরুরী অবস্থা আরোপের কয়েকমাসের মধ্যেই শঙ্করের বিদ্রুপাত্মক সাপ্তাহিক পত্রিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। যদিও আদর্শগত দিক থেকে কে. শঙ্কর পিল্লাই মিসেস গান্ধীর দিকেই ছিলেন তবুও তিনি খুব ভালো করেই জানতেন যে এই প্রবল প্রভাবশালীর নিয়ন্ত্রনাধীন পরিবেশে তাঁর পত্রিকার কোনো স্থান নেই। বিদায়ী সম্পাদকীয়তে শঙ্কর তাঁর অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করেন যে ‘স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা কখনোই হাস্যরস গ্ৰহন করতে সমর্থ নয় কারণ মানুষ স্বৈরাচারী শাসকদের দিকে তাকিয়ে হাসতে পারে কিন্তু সেটা করা চলবে না। হিটলারের সময়ে কোনো ভালো কৌতুক,ব্যঙ্গচিত্র,হাস্যরসাত্মক রচনা সৃষ্টি হয়নি। যখন সেন্সরবোর্ডের প্রধান এইচ.জে.ডি পনহা পরামর্শ দেন যে, সেন্সরশিপের আদেশেগুলির জন্য আইনমন্ত্রক থেকে একটা ছাড়পত্র নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে, যাতে তারা ৪৮নং ধারার অধীনে থাকা আদেশ ২৭৫(ই) অনুসারে থাকা বিষয় এবং সেন্সরশিপের তালিকাভুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে শুক্লা তাঁর এই যুক্তি কানেই তোলেননি। তিনি বলেন যদি আদালতে তাদের আদেশ চ্যালেঞ্জ করা হয় তখন তারা বুঝতে পারবে যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল কিনা। এমনকি বোম্বে হাইকোর্ট এবং গুজরাট হাইকোর্ট উভয়েই জানিয়েছিলেন যে ডিআইআর-এর সাথে সম্পর্ক নেই এমন কোনো বিষয় সেন্সরশিপের নেতৃত্ব প্রদানের নাম করে সেন্সর বোর্ডের প্রধান কোনো আদেশ জারি করতে পারেন না। কিন্তু কোর্টের নির্দেশাবলী নির্লিপ্তভাবে উপেক্ষা করা হয়েছিল; সেন্সরশিপের নির্দেশিকাগুলি বারবার পাল্টে ফেলে আরও কঠোর করা হয়েছিল। সংসদ এবং আদালতের কার্যক্রম ও সেন্সরশিপের আওতায় আনা হয়েছিল। শুধুমাত্র পার্টির সমর্থনে এবং ভোট বিষয়ক কথা বাদ দিয়ে সরকার পক্ষের বিবৃতি ছাড়া কোনো মত বা বিপক্ষে বলা কথা প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। গদি নিয়ে মন্তব্য, বিরোধী দলের খালি আসন বা নিখোঁজ সদস্যদের নাম কখনো উল্লেখ করা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ছেলের থেকে বেশী উদার ছিলেন, তিনি এবং তাঁর মন্ত্রীসভা সম্মতি দিয়েছিলেন যে বিরোধী দল ধর্মঘট করলে সংবাদপত্র সেটা প্রকাশ করতে পারে। সঞ্জয় গান্ধী ও তাঁর সমর্থকরা এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি এবং পরবর্তী সময়ে ধর্মঘটের খবর নিষিদ্ধ করা হয়। শ্রীমতী গান্ধীর স্বামী ফিরোজ গান্ধী, সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য যে আইন পাশ করিয়ে ছিলেন, হাস্যকরভাবে তা বাতিল করা হয়। রাজ্যের উচ্চ আদালত সেন্সরবোর্ড পরিচালিত কিছু নির্দেশনার বিরুদ্ধে রায় দান করেছিলেন। রাষ্ট্র বিরোধী সংবাদ, সংবিধান সংশোধনকেও হত্যা করেছিল।