নয়াদিল্লি : ভারতীয় রাজনীতিতে এটি খুব সাধারণ বিষয় নয় যে একজন রাজনীতিবিদ তার কেরিয়ারের চরম শীর্ষে থাকাকালীন সেসব ত্যাগ করে, সমাজসেবাকে গ্ৰহন করেন এবং পরবর্তীকালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ভারতরত্ন লাভ করেন।
কিন্তু নানাজী এটাই করে দেখিয়েছিলেন।
“১৯৭৭ সালে যখন জনতা পার্টির সরকার গঠন করা হয়েছিল তখন নানাজী দেশমুখেকে মন্ত্রী হিসাবে সরকারে যোগদান করার জন্য অনুরোধ করা হলে তিনি তা গ্ৰহন করেননি। তিনি জয়প্রকাশ নারায়নকে অনুসরণ করতেন এবং পল্লী উন্নয়ন এবং আমাদের গ্ৰামগুলিকে স্বাবলম্বী, দারিদ্র্যমুক্ত করে তুলতে নিজেকে অগ্ৰাধিকার দেওয়া পছন্দ করেছিলেন” নানাজীর জন্মশতবর্ষ উদ্বোধনের সময় তিনবছর আগে নরেন্দ্র মোদী এইকথা গুলো বলেছিলেন।
১৯৮০ সালে রাজনীতি ত্যাগ করার পরে, নানাজি, দীনদয়াল গবেষণা ইনস্টিটিউট (ডিআরআই)এর মাধ্যমে যথাক্রমে উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশের গন্ডা ও চিত্রকূটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে বিকল্প গ্ৰামীন উন্নয়ন মডেল স্থাপন করেন। কিছু মহারাষ্টের বিড’এও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
২০১৯সালে তাঁকে মরনোত্তর ‘ভারতরত্ন’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল।
গ্রামীণ উন্নয়ন এবং সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানগুলি ডিআরআই এগিয়ে নিয়ে গেছিলো, যা এখন আরও অনেক রাজ্যেই অনুসরণ করছে।
রবিবার তাঁর জন্মবার্ষিকীতে,আরএসএসে নানাজীর যাত্রা, দীনদয়াল উপাধ্যায়ের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব, জরুরিকালীন পরিস্থিতিতে তাঁর ভূমিকা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক
দীনদয়াল উপাধ্যায়ের সাথে সাক্ষাৎ : ১৯১৬ সালের ১১ই অক্টোবর মহারাষ্ট্রের এক ছোট্ট শহরে কাদোলিতে জন্মগ্ৰহন করেন চন্ডীকদাস অমৃতরাও দেশমুখ (ভালোবেসে তাঁকে নানাজী বলে ডাকা হতো)। প্রাথমিক শিক্ষার টাকা সংগ্রহের জন্য তাঁকে সব্জি বিক্রেতার কাজ করতে হয়। কঠোর পরিশ্রম ও একাগ্ৰতার দ্বারা তিনি রাজস্থানের পিলানি’র বিখ্যাত বিড়লা ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি এন্ড সায়েন্স থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ কে.বি.হেগডিওয়েরের সাথে তাঁর পরিবারের যোগাযোগ ছিল। ১৯৪০ সালের দিকে মুক্তিযোদ্ধা লোকমান্য তিলকের জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে একজন আরএসএস প্রচারক(পূর্ণ সময়ের কর্মী) হিসাবে যোগদান করেন।
প্রচারক হিসাবে প্রথমে তাঁকে উত্তরপ্রদেশে প্রেরণ করা হয় এবং আগ্ৰায় তিনি দীনদয়াল উপাধ্যায়ের সাথে দেখা করেছিলেন, যিনি পরবর্তীকালে ভারতীয় জন সংঘের একজন প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যা পরবর্তীতে ভারতীয় জনতা পার্টি নামে পরিচিত হয়েছে।
প্রায় তিন দশক ধরে নানাজী এবং উপাধ্যায় একসাথে কাজ করেছেন। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক এতটাই দৃঢ় ছিল যে ১৯৬৮সালের ফেব্রুয়ারিতে উপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর নানাজী তাঁর বন্ধুর স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠা করেন ডিআরআই।
আগ্ৰা থেকে নানাজী পূর্ব উত্তরপ্রদেশে সাংগঠনিক কাজ সম্প্রসারণের জন্য প্রচারক হিসাবে গোরক্ষপুর গিয়েছিলেন। তিনবছরের ব্যবধান এই অঞ্চলে আরএসএস-এর ২৫০টিরও বেশি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
১৯৫২সালে গোরক্ষপুরে প্রথম সরস্বতী শিশু মন্দির বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। বর্তমানে সারা দেশে এইধরণের ২০,০০০ এরও বেশি স্কুল এবং তিন কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে।
১৯৪৭সালে আরএসএস সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে রাষ্ট্রধর্ম এবং পাঞ্চোযন্য নামে থাকা দুটি জার্নালের পাশাপাশি স্বদেশ নামে একটি দৈনিক চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অটল বিহারী বাজপেয়ী সম্পাদক, উপাধ্যায়কে পরামর্শদাতা এবং নানাজীকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
জোট নীতি বিশেষজ্ঞ : উত্তরপ্রদেশে বিজেএসের একটি শক্ত ঘাঁটি স্থাপনে নানাজী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৫৭ সালের মধ্যে রাজ্যের প্রতিটি জেলায় এই দলের উপস্থিতি ছিল। নানাজী তাঁর রাজ্যশাখার সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। পরে তিনি দলের কোষাধ্যক্ষ হিসাবেও কাজ করেছিলেন।
একজন রাজনীতিবিদ হিসাবে জোট সরকার গঠনের দক্ষতার জন্য পরিচিত ছিলেন। ১৯৭৭ সালে, উত্তরপ্রদেশের প্রথম অ-কংগ্ৰেসী সরকার একটি জোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে যা সমাজতান্ত্রিক নেতা রাম মোহন লোহিয়া এবং নানাজীকে একত্রিত করেছিল। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ১৯৭৫-৭৬ সালে জরুরী অবস্থা চলাকালীন খুব বেশীভাবে প্রদর্শিত হয়েছিল। তিনি গনতন্ত্র পুনঃরুদ্ধারের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে গনতন্ত্র অক্ষুন্ন রাখার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এর আগে কংগ্রেস শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা জয়প্রকাশ নারায়নের “জেপি আন্দোলন” সম্প্রসারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। জে.পি. এবং নানাজী এতোটাই ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে পরবর্তীকালে নারায়ন এবং তাঁর স্ত্রী উভয়ের নামানুসারে ডিআইআর একটি গ্ৰামীন সংস্কার প্রকল্পের নামকরণ করেছিলেন, যা “জয়প্রভা গ্ৰাম” নামে পরিচিত ছিল। ১৯৭৭সালে তিনি বিরোধী জোটের অন্যতম প্রধান স্থপতি ছিলেন যা পরবর্তীকালে জনতা পার্টির রূপ নিয়েছিল। নানাজী প্রথম বারের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং উত্তরপ্রদেশের বলরামপুর থেকে জয়লাভ ও করেন। পরে তাকে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই মন্ত্রীর পদে প্রস্তাব দিলে তিনি তা বিনীতভাবে প্রত্যাখান করেন। পরে জনতা পার্টি বিভক্ত হয়ে বিজেপি গঠিত হলে ১৯৮০ সালে নানাজী অবসর গ্ৰহনের ঘোষণা করেন। বাকি জীবন তিনি গ্ৰামীন সংস্কারের ক্ষেত্রে দুটি মুল বিষয়কে প্রাধান্য দেন— “গ্ৰামোদয়”( গ্ৰামের উত্থান) এবং অন্যটি হল “স্বাবলম্বন”(স্বনির্ভরতা)।
তিনি চিত্রকূটে প্রথম গ্ৰামীন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন যা “চিত্রকূট গ্ৰামোদয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত। জাতির প্রতি তাঁর সেবার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৯ সালে তিনি রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে মনোনীত হন এবং ঐ বছরেই “পদ্মবিভূষণ” সন্মানে সন্মানিত হন। ২০১০সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আরএসএস-এর একজন প্রবীণ এস.গুরুমুর্তি,যিনি নানাজীর সাথে খুব গভীরভাবে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন তাঁর কাজের ধরন প্রকৃতির সম্পর্কে, তিনি ২০১০এর ৩রা মার্চ একটি প্রবন্ধে জানান যে “তিনি (নানাজী) একবার আমাকে বলেছিলেন যে তিনি যখন তিনি ছোট ছিলেন তখন অনেকদিন এমনও হয়েছে যে তিনি খেতে পাননি। কিন্তু তাঁর এই অবস্থা তাঁকে নকশাল বানাতে পারেনি। সঠিক সময়ে আরএসএসের সাথে তাঁর পরিচয় এবং সঠিক ব্যক্তিদের সাথে তাঁর যোগাযোগ তাঁকে একজন এমন এক বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী করে তুলেছিল যিনি শুধুমাত্র মাতৃভূমির গৌরব অর্জনের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন”।