‘জয় শ্রীরাম’ গালাগালি হলে আরশোলাও পাখি

এই নিবন্ধের শিরোনাম দেখে বিস্মিত হবেন না। আরশোলার মতো নিরীহ প্রাণীকে রাজনৈতিক কূটকচালির মধ্যে টেনে আনার । ইচ্ছে নিবন্ধ লেখকের একেবারেই ছিল না কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাণ্ডকারখানা দেখে নিরুপায় হয়ে আনতে হলো।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি দাবি করেছেন জয় শ্রীরাম একটি গালাগালি বিশেষ। যদি কেউ জয় শ্রীরাম ধ্বনি দেয় তাহলে তার মনে হয় তাকে গালাগালি দেওয়া হচ্ছে। চন্দ্রকোণার রাধাগোবিন্দপুরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এই দাবি। ঘটনাটি এইরকম। ফণী বিদায় নেবার পর মমতা যখন কলকাতায় ফিরছিলেন, সেই সময় কিছু গ্রামবাসী জয় শ্রীরাম ধ্বনি দেয়। ক্ষুব্ধ বিপর্যস্ত মমতা গাড়ি থেকে নেমে তাদের পিছু ধাওয়া করেন। তাকে বলতে শোনা যায়, ‘পালাচ্ছিস কেন? আয় আয়। হরিদাস সব। গালাগালি শিখেছে। মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় পুলিশ এই ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে (!)। সায়ন মিদ্দা, সীতারাম মিদ্দা এবং বুদ্ধদেব । দলুইকে গ্রেপ্তার করে। পরে অবশ্য তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
এখন প্রশ্ন হলো, জয় শ্রীরাম ধ্বনি শুনে মমতা রেগে গেলেন কেন? কেনই বা এই ধ্বনিকে গালাগালির তকমা দিলেন ? প্রথমেই বলে রাখা ভালো এইসব প্রশ্নের এক কথায় কোনও উত্তর হয় না। চাইলে মমতা ঘটনাটিকে উপেক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। এমনকী, রাগের মাথায় হঠাৎ কিছু করে ফেলা বলতে আমরা যা বুঝি, তাও তিনি করেননি। তিনি যা করেছেন সেটি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা একটি প্রক্রিয়ার সুনির্দিষ্ট অংশ। প্রক্রিয়াটিকে আমরা ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে সাম্প্রদায়িকতা বলতে পারি, আবার সরাসরি সাম্প্রদায়িকতাও বলতে পারি। এই নিবন্ধ যখন লিখছি তখনও লোকসভা নির্বাচনের শেষ দুটি পর্যায়ের ভোটগ্রহণ বাকি। মমতার এই জয় শ্রীরাম-ইস্যুর লক্ষ্য ছিল ভোট। বিশেষ করে মুসলমান ভোট। এখনও যেসব জেলায় ভোট বাকি, সব জায়গাতেই মুসলমানেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেন। কিন্তু মমতার সমস্যা হলো এবার মুসলমান ভোট মোট চারভাগে ভাগ হবে। কংগ্রেস সিপিএম তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে। ২০১১-র বিধানসভা, ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে এই সমস্যা ছিল না। ২০১১ সালে তৃণমূল এবং কংগ্রেস জোট। করেছিল। সেবার সিপিএম মুসলমান ভোট পায়নি বললেই চলে। বিজেপির ভূমিকাও ছিল নগণ্য। ২০১৪ সালে সারা দেশে মোদী ঝড় চললেও পশ্চিমবঙ্গে তার তেমন প্রভাব পড়ে নি। সারদা কাণ্ডের ফলে বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেলেও, সেবার মমতা নরেন্দ্র মোদীকে ‘দাঙ্গাবাজ’ ইত্যাদি বলে মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা প্রথম মুসলমান ভোটব্যাঙ্কে ধস নামার ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। সেবার সিপিএম আর কংগ্রেস তৃমমূলের বিরদ্ধে জোট করেছিল। উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু আসনে পর্যদস্ত হয়েছিল তৃণমূল। বস্তুত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে আত্মবিশ্বাসী চেহারা আমরা দেখে অভ্যস্ত, দক্ষিণবঙ্গে ভোট গণনা শুরু হবার আগে পর্যন্ত দেখা যায়নি। এবারে সেই মুসলমান ভোট চার ভাগে ভাগ হবে। তাই তিনি অনন্ত চাপের মধ্যে আছেন। সেই কারণেই জয় শ্রীরাম ধ্বনিকে গালাগালির তকমা দিয়ে তিনি মুসলমানদের বার্তা দিয়েছেন। তার বার্তার মধ্যে বিন্দুমাত্র হেঁয়ালি নেই। তিনি বলতে চান, যে কথা মুসলমান নেতারাও বলতে সাহস পান না, সে কথা তিনি অনায়াসে বলতে পারেন। জয় শ্রীরাম ধ্বনির মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে পারেন, সারা দেশে পূজিত মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রের দেবত্বকে অস্বীকার করতে পারেন। তাঁর মতো মুসলমান- দরদি, ইসলাম-হিতৈষী নেতা আর কেউ নেই। সুতরাং মুসলমানদের ভোট যেন তৃণমূল পায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, রামকে তিনি দেবতা মানেন না। ঠিকই বলেছেন। তবে দেবতা কথাটির অর্থ না বুঝে বলেছেন। দেবতা আর ঈশ্বর এক জিনিস নয় দিদি। দেবত্ব গুণবিশেষ। যে ব্যক্তি এই গুণের অধিকারী তিনিই দেবতা। এর সঙ্গে আচার-অনুষ্ঠান নির্ভর ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। আপনার ফিরহাদ হাকিম যদি এই দেবগুণের অধিকারী হন তা হলে তিনি দেবতা হিসেবে গণ্য হবার যোগ্য। আপনি রামকে দেবতা মানেন না তার অর্থ কি আপনি রামের দেবসুলভ গুণাবলী মানেন? নাকি রামকে ঈশ্বর মানেন না? এই জায়গাটা কিন্তু স্পষ্ট হলো না।
আরও একটা জট আপনি ইচ্ছে করে খোলেননি। রাম যদি দেবতা না হন তাহলে তিনি অবশ্যই মানুষ। রক্তমাংসের মানুষ। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ তার জন্মস্থান আছে, কর্মভূমি আছে, এমনকী যে সেতু পেরিয়ে তিনি লঙ্কায় গিয়েছিলেন, তারও অস্তিত্ব আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষ হলে তিনি কেমন মানুষ! তিনি কি বাল্মীকি-সৃষ্ট কোনও কাল্পনিক মানবচরিত্র নাকি এমন একজন মানুষ যার ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর আপনি দেননি। বলা বাহুল্য, দেবেনও না। শুধু আপনি কেন, সারা দেশে ধর্মনিরপেক্ষ নেতাদের মধ্যে কারোও এমন সাহস নেই যে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। কারণ সারা পৃথিবীতে আজ অবধি এমন কোনও কবি জন্মাননি যার সৃষ্ট কোনও চরিত্র হাজার হাজার বছর ধরে জনমানসকে উদ্বেল করে তুলতে পারে। যে কাল্পনিক চরিত্রের আবির্ভাব তিথি পালন করার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নামে। যার যুদ্ধজয়ের এবং ঘরে ফেরার আনন্দে মানুষ উৎসব করে, বাজি পোড়ায়। কোনও কাল্পনিক চরিত্রের পক্ষেই এতদিন ধরে জনমানসে ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কারণ স্থান-কাল-পাত্রের নিগঢ়কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা শিল্প-সাহিত্যের পক্ষে সম্ভব নয়। তা সে নিজের সময়ে যতই নন্দিত এবং বন্দিত হোক না কেন! সংস্কৃত ভাষা যতদিন দেশের অগ্রগণ্য ভাষা ছিল ততদিন কবি কালিদাস-সৃষ্ট অমর চরিত্র দুষ্মন্ত শকুন্তলা মানুষের মনে উজ্জ্বল হয়েছিলেন। এখন আর নেই। জাতকের কাহিনিতে বর্ণিত চরিত্রগুলির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যতদিন ভারতবর্ষের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ, ততদিন চরিত্রগুলি ছিল অমর। এখন আর নয়। রামায়ণও সংস্কৃত ভাষায় লেখা। সুতরাং কালের ধর্ম মেনেই কাল্পনিক রামচরিত্রের মুছে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু রাম মুছে যাননি। কারণ তিনি কাল্পনিক চরিত্র নন, ঐতিহাসিক চরিত্র। কিন্তু মমতা রামকে মানুষ বলেই খালাস। তার ঐতিহাসিকতা মানতে রাজি নন। রামকে ঐতিহাসিক চরিত্র মানলে প্রাচীন যুগ থেকে প্রবহমান ভারতীয় অস্মিতার কথাও মানতে হয়। রাম ভারতীয় অস্মিতারই প্রতীক। তিনিই ভারতকে রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সার্বভৌম ভারত রূপলাভ করেছিল তাঁর হাতে। এখানেই মমতা-সহ ভারতের সব। ধর্মনিরপেক্ষ এবং বামপন্থী নেতাদের আপত্তি। তাদের লড়াই অখণ্ড ভারতের বিরুদ্ধে। তাদের রাজনীতি ভারতকে ভাঙার রাজনীতি। সেই কারণেই রামের প্রতি মমতার এই সীমাহীন অশ্রদ্ধা।
মমতার কাছে জয় শ্রীরাম ধ্বনি গালাগালি পদবাচ্য। মমতার মুখে তার এই অশিষ্টাচারের কথা শোনার পর চমকে উঠেছে বাঙ্গালি। নিন্দা আর কটুক্তির ঝড় বয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। অনেকেই তাঁকে অসভ্য, ‘নাস্তিক’ ‘পাগল’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করেছেন। কিন্তু সবিনয়ে বলি তিনি এর কোনওটাই নন। তিনি শঠ, ধূর্ত এবং অসম্ভব স্বার্থপর। রাজনৈতিক স্বার্থে তিনি লক্ষ্মীর ঝাপিতে নিষিদ্ধ পশুর মাংস রাখতেও পিছপা হন না। তিনি জানেন, ফুলিয়ার কবি কৃত্তিবাস ওঝা তুলসীদাসেরও আগে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন। বহু বাঙ্গালি পরিবারে আজও সযত্নে পঠিত হয়। কৃত্তিবাসী রামায়ণ। বহু বাঙ্গালি পরিবারে পূজিত হন রাম। হ্যাঁ, দেবতা হিসেবেই। এদেশের মানুষের মন সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই লিখেছিলেন, ‘দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়রে দেবতা। এদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে তাদের প্রিয় মানুষকে দেবতার আসনে বসিয়েছে। প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছেন দেবতা। এ ভাবেই মানুষ থেকে দেবতা হয়েছেন শ্রীরামকৃষও পরমহংস, মা-সারদা, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজী এবং গান্ধীজী। এরা কেউই ঈশ্বর নন, শুধুই দেবতা। মানুষ এদের কাছে ঋণী বলেই এরা দেবতা। ভারতীয়দের কাছে এদের স্মরণ-মনন সেই ঋণ স্বীকারের প্রক্রিয়া বিশেষ।রামের কাছেও ভারত ঋণী। তাই রামও দেবতা। জয় শ্রীরাম’ ছিল রাবণের বিরদ্ধে যুদ্ধে বানরসেনার রণহুংকার। পরে জয় শ্রীরাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনও সংগ্রামে সাধারণ ভারতীয়দের রণহুংকার হয়ে দাঁড়ায়। আজ এই ধ্বনি বন্দে মাতরমের সমগোত্রীয়। সুতরাং জয় শ্রীরাম যদি গালাগালি হয় তাহলে আরশোলাও তো পাখি।
সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক কথা বলেন। বলুন। আপত্তি নেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে জয় শ্রীরাম ধ্বনি তিনি বন্ধ করতে পারবেন না। মা দুর্গার অকালবোধন বাঙ্গালির বড়ো প্রিয়। বাঙ্গালি জানে শরৎকালে মা দুর্গার অকালবোধন কার জন্য হয়েছিল। কে করেছিলেন, কেনই বা করেছিলেন? দুর্গার পরমভক্তের নামে অকথা-কুকথা বললে বাঙ্গালি ছেড়ে কথা বলবে না। মমতাও সেটা জানেন। তাই তিনি শুধু গর্জাবেন, বর্ষানোর সাহস তার কোনোদিনই হবে না।
সন্দীপ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.