তৃতীয় পর্ব
"নমামি সর্বভূতানাং বরদাসি হরিপ্রিয়ে
যা গতিস্ত্বৎপ্রপন্নানাং সা মে ভূয়াৎ ত্বদর্চনাৎ।"
”অর্থাৎ 'হে হরিপ্রিয়ে, তুমি সকল প্রাণীকে বরদান করে থাক, তুমি সর্ব দুঃখ হর , তাই তুমি হরিপ্রিয় ,তোমাকে প্রণাম করি। যাঁরা তোমার শরণাগত হয়, তাঁদের যে গতি, তোমার পূজার ফলে আমারও যেন সেই গতি হয়।'
চন্ডীতে মহালক্ষ্মীর মন্ত্র উচ্চারণ করে হয়েছে –
ওঁ অক্ষস্রকপরশুং গদেষুকুলিশং পদ্মং ধনুঃ কুন্ডিকাং
দণ্ডং শক্তিম্ অসিঞ্চ চর্ম্ম জলজং ঘন্টাং সুরাভাজনম্।
শূলং পাশসুদর্শনে চ দধতীং হস্তৈঃ প্রসন্নাননাং সেবে
সৈরিভমর্দিনীমিহ মহালক্ষ্মীং সরোজস্থিতাম্।।
পদ্ম ,ধনু, কমন্ডলু , দণ্ড , শক্তি ,খড়্গ, ঢাল, শঙ্খ , ঘন্টা , মদ্যপাত্র , শূল , পাশ এবং সুদর্শন চক্র ধারণ করেন । আমি সেই প্রসন্নবদনা মহিষমর্দিনী পদ্মের উপর অবস্থিতা মহালক্ষ্মীর আরাধনা করছি।
যখন আসে মহাসর্বনাশ , বিভ্রাট, লড়াই তখনই তো শান্ত থেকে রুদ্র রূপ ধারণ করার সময়।
দেবী মহামায়া যোগমায়াকে শ্ৰী কৃষ্ণের সকল লীলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী রূপে প্রণাম জানানো হয়েছে। চন্ডীতে মহাবিদ্যা যোগমায়া এবং অবিদ্যা রূপী জাগতিক মায়ার উল্লেখ পেয়েছি। তাঁকে মায়া , মহামায়া এবং যোগমায়া রূপে অভিহিত করা হয়। অবিদ্যাস্বরূপ মায়া সংসার বন্ধনের হেতু , মহাবিদ্যা স্বরূপ সর্ব্বসম্পদ্ দাত্রী , অভীষ্টদায়িনী, মোহমুক্তির হেতু স্বরূপ। তিনিই যোগ স্বরূপ আনন্দব্রহ্মের অনুভূতি প্রদানের সামর্থে সর্ব্বাধিকা। ইনিই যুগে যুগে আবির্ভুত বিষ্ণুর দশঅবতারের সহকারিণী স্বরূপ।।
নারদপঞ্চরাত্রে শ্রুতিবিদ্যা সংবাদে বলা হয়েছে যে –
জানাত্যেকা পরা কান্তং সৈব দুর্গা তদাত্মিকা।
যা পরা পরমা শক্তির্মহাবিষ্ণুস্বরূপিণী।।
যস্যা বিজ্ঞানমাত্রেণ পরাণাং পরমাত্মনঃ।
মূহুর্ত্তাদেব দেবস্য প্রাপ্তির্ভবতি নান্যথা।।
একেয়ং প্রেম সর্ব্বস্ব স্বভাবা গোকুলেশ্বরী।
অনয়া সুলভো জ্ঞেয় আদিদেবোহখিলেশ্বরঃ।।
ভক্তির্ভজনসম্পত্তির্ভজতে প্রকৃতিঃ প্রিয়ম্।
জ্ঞায়তেহত্যন্তদুঃখেন সেয়ং প্রকৃতিরাত্মনঃ।।
দুর্গেতি গীয়তে সদ্ভিরখণ্ডরসবল্লভা।
অস্যা আবরিকা শক্তিনর্মহামায়াহখিলেশ্বরী।।
যয়া মুগ্ধং জগৎ সর্ব্বং সর্ব্বদেহাভিমানিননঃ।।
শ্ৰীদুর্গা হলেন চিন্ময়ী শক্তি। তাই তিনি #একাংশনা , তিনিই এক। পরমাশক্তি মহাবিষ্ণু স্বরূপিণী শ্রেষ্ঠশক্তি। তিনি প্রেম সর্ব্বস্বভাবা , তিনি গোকুলাধিষ্ঠাত্রী । তাঁকে জানতে পারলেই মহাশূন্য আদিদেবকে সহজেই প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই অখন্ড রসবল্লভা আদি শক্তির আবরিকা শক্তি অখিলেশ্বরী মহামায়া সমস্ত জগৎকে , সকল দেহাভিমানী জীবকে মুক্ত করেন।
আমাদের আবহমানকালের আদিমাতৃকার নামে জয়ধ্বনি দিয়েই এই সনাতনী জাতির অস্তিত্ব সম্ভব, অন্যথা নয়। যে ব্যক্তি এই প্রকৃতিমাতৃকাধর্মের সর্বোচ্চ স্থান মানে নি, যে এই প্রকৃতিমাতৃকাধর্মের কাছে আত্মসমর্পণ করে নি, সে ব্যক্তি সনাতন নয়, এই কথা স্পষ্ট ভাষায় বলার সময় এসেছে । ধর্ম ছাড়া জাতির গঠন অসম্ভব।
তাই হয়তো চন্দ্রকেতুগড়ের গঙ্গারিডিই সভ্যতায় একসময় আয়ুধধারিণী মহালক্ষ্মীর উপাসনা হতো। সেখানে প্রাপ্ত দেবী লক্ষ্মী মূর্তির মাথায় দুদিকে চুলের কাঁটা স্বরূপ আটটি আয়ুধ, প্রত্যক্ষ হয়। আবার যদি কোনও কোজাগরী পূর্ণিমার দিন নোয়াখালির পুনরাবৃত্তি ঘটে, আদ্যাশক্তি মহামায়া মহাবিদ্যা মহালক্ষ্মী যে আয়ুধ ধারণ করতেন, সে কথা স্মরণ করতে হবে।
তিনি সৎজনের জন্য লক্ষ্মী এবং অসৎজনের জন্য অলক্ষ্মী। একসময় পূর্ববঙ্গে #গাড়শি ব্রত পালন করা হতো আশ্বিন মাসের সংক্রান্তির দিন। অলক্ষ্মী দূর করে দেবী লক্ষ্মীর উপাসনা। এখনও একই ব্রত বা পূজা পালন করা হয় পশ্চিমবঙ্গের নানা গৃহে কার্তিক অমাবস্যায় কালী পূজার দিন দীপান্বিতা লক্ষ্মী পূজা হিসাবে ।
এবার বলি দীপান্বিতা ব্রত বা পূজার নিয়ম। যেহেতু আমার পিতৃগৃহে এই পূজা করা হতো ,তাই সেসব স্মৃতি আমার জীবনকালে অমলিন থেকে যাবে। প্রায় দুর্গা পুজো শেষ হলেই ঠাকুর মশাই এসে জানান দিয়ে যেতেন দিনক্ষণ তিথির। প্রতি ফি বছর নতুন করে ফর্দ বানানো হতো কারণ আগের বছরের ফর্দ হারিয়ে যেত পাঁচজনের সংসারে। কালী পুজোর আগের দিন মানে , নরক চতুর্দশী বা ভূত ফর্দ মিলিয়ে জিনিসের সঙ্গে আসত চৌদ্দশাক। দুপুর বেলা চৌদ্দশাক দিয়ে ভাত খেতাম। সন্ধ্যায় ঠাকুর ঘরে চৌদ্দ প্রদীপ দেখিয়ে বাড়ির অন্ধকার কোণগুলোয় সেই প্রদীপ রেখে আলোকিত করা হতো। সারা কার্তিক মাস জুড়ে বাড়ির ছাদে আকাশ প্রদীপ জ্বলত পূর্ব পুরুষদের পুনরায় ফিরে যাবার পথ দেখানোর জন্য।
যাহোক , মফঃস্বলে থাকতাম। বাড়ির পিছনে একটা বড় পুকুর ছিল । পুজোর দিন ভোরবেলা উঠে মা পিসিরা পুকুরে ডুব দিয়ে এসে পাটভাঙা শাড়ি পড়ে পুজোর জোগাড় করতে বসতেন। পুজোর তিথি থাকত সাধারণত দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে। সারাবাড়ি ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে দেওয়া হতো। তারপর উঠোন , বারান্দা, ঘরের চৌকাঠ, ঠাকুর ঘর সর্বত্র আগের দিন রাত্রি থেকে ভেজানো আতপ চাল বেটে আল্পনা দেওয়া হতো। এটা আমার ছোট পিসি করতেন। বড় হবার পরে আমিও করতাম।
মেজ পিসি পাশের বাড়ির গোয়াল থেকে গোবর কুড়িয়ে এনে বানাতেন একটা গোবরের পুতুল। তাকে কলার পেটোয় শুইয়ে দিয়ে ,ফেলে দেওয়া চুল কুড়িয়ে তার মাথায় লাগিয়ে দেওয়া হতো। দূর থেকে সেই ড্যাব ড্যাব চোখওলা , মাথায় উড়ো চুলওলা পুতুল দেখে বুঝতে বাকি থাকত না যে অলক্ষ্মী বিদেয় হবার জন্য প্রস্তুত। কলার পেটোয় অলক্ষ্মীকে ভিটের বাইরের রেখে , তার চারপাশে কোনোক্রমে আল্পনা দিয়ে , একটা কলাপাতায় চাট্টি ফুল আর নকুলদানা রেখে , মাথার কাছে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া হতো।
ঘরের ভিতরে তখন ঠাকুমা চাল বাটা দিয়ে লক্ষ্মীর সিংহাসনের কাছে বসে লক্ষ্মী , নারায়ণের মূর্তি গড়তেন। অনেকে কুবের মূর্তিও গড়ে দেন এর সঙ্গে। দেবী লক্ষ্মীর পিটুলী মূর্তিকে লাল সিঁদুর দিয়ে ,নারায়ণ মূর্তিকে সবজেটে নীল রঙের চূর্ণ দিয়ে রাঙানো হতো। যাঁদের গৃহে কুবের মূর্তিও তৈরী হয় ,তাঁরা অপরাজিতা ফুলের পাতা বেটে রঙ করেন। ঠাকুমা মূর্তিগুলো কলার পেটোয় বসিয়ে পুজোর অন্য জোগাড়ে লাগতেন। পুজোর ভোগ রান্না মা আর সেজ পিসি মিলে রান্না করতেন। ন পিসি বড় ছুঁতমার্গ ছিল। তাই ওনাকে ঠাকুরঘরের কাজই করতে দিতেন ঠাকুমা।
ঠাকুর মশাই পাড়ার মোড় থেকে হাঁক পারতে পারতে আসতেন , ” কৈ গো সব ….এসে গেছি..” । তারপর ধুলো পায়ে হাত মুখ না ধুয়েই অলক্ষ্মীর পূজা করতে বসতেন। বাঁহাতে দীপ ধূপ জ্বালিয়ে , ফুল ছুঁড়ে , নকুলদানা দিয়ে পুজো করে, হাত মুখ ধুয়ে ভিটেয়ে ঢুকতেন। এদিক আমি , ভাই আর কাকা কলার পেটোয় শোয়ানো অলক্ষ্মীকে রাস্তার ধারে ফেলতে যেতাম। আমি আর ভাই একটা ভাঙা কুলো বা ঝুড়ি জোগাড় করে , তার উল্টো পিঠে গাছের ডাল দিয়ে মারতে মারতে বলতাম , ” অলক্ষ্মী দূর হ…”…পথের ধারে একটা বাতি জ্বালিয়ে তাকে ফেলে আসা হতো। আমরা ফিরে এসে হাত মুখ ধুয়ে , গঙ্গা জল দিয়ে শুদ্ধ হয়ে ঘরে ঢুকলে তারপর ঠাকুর মশাই শুদ্ধভাবে লক্ষ্মী পূজায় বসতেন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন এই পিটুলীর পুতুলের উপর যে রং করা হয় তা সুপ্রাচীন লক্ষ্মীপূজা বা প্রকৃতিপূজার নিদর্শন। এগুলি আমাদের ব্যবহৃত খাদ্যশস্যের তিন প্রকার রূপ। সবুজ বা নীল নারায়ণ শস্যের প্রথম রূপ , অপরাজিতা পাতায় রাঙানো হলদেটে সবুজ কুবের শস্যের দ্বিতীয় অবস্থা , লাল রঙে রাঙা লক্ষ্মী হলেন শস্যের শেষ অবস্থা , পরিপূর্ণ পক্ক শস্য। এই যে পূজা , ভূমাতা ,পরমা প্রকৃতির উপাসনা শারদ পূর্ণিমার দিন কেবলমাত্র ভারতেই হয় না । হয় ভারতের বাইরেও , সেই সুদূর পেরু, আফ্রিকা, মেক্সিকোর গ্রামে। আগে গ্রিক , রোমান এবং মধ্যপ্রাচ্যেও উপাসনা হতেন তিনি। তবে সে বহু আগে…কত আগে বুঝতেই পারছেন! মেক্সিকোর গ্রামে সুপ্রাচীন বিশ্বাসে রয়েছেন তিনজন শস্য রক্ষয়িত্রী তিন বর্ণের দেবতার কথা।
পূর্ববঙ্গে একসময় গাড়শি ব্রত পালন হতো, যদিও এখনো কেউ কেউ এই ব্রত পালন করেন। অনেকে একে গাড়ু ব্রতও বলে। ক্ষেত্রসমীক্ষা অনুসারে জানা যায় , আশ্বিন সংক্রান্তির দিন খুব ভোরবেলা উঠে ব্রতীরা বাসি কাপড়ে মাঠ থেকে সবজি নিয়ে আসেন। তারপর বাড়িতে ঝাঁট না দিয়ে , আমানি অর্থাৎ সবজি কাটাকাটি করে সোজা পুকুর কি নদীতে গিয়ে ভালো করে স্নান করেন। বাড়ি এসে রান্নায় করেন নিটোল মনোনিবেশ। নানারকম তরিতরকারী থাকলেও এই ব্রতের নৈবেদ্য বা ভোগে তেঁতুল মিশ্রিত ডাল আবশ্যক। পূর্ব রাত্রে কাককে নিমন্ত্রণ করতে হয়। পরেরদিন রান্না হয়ে গেলে কলাপাতায় সব খাবার সাজিয়ে প্রথমে কাককে খাওয়াতে হবে। সাঁঝের বেলায় কলার পেটোয় বানানো প্রদীপ জ্বেলে দেন। সেই প্রদীপের আলোকে দূর হয় সকল অলক্ষ্মী , অমঙ্গল, দুঃখ , দারিদ্র সব অশুভ।
শ্রাবণ মাসের রিমিঝিমি বর্ষণে ধান্যসুন্দরী যেন দিনে দিনে রূপবতী হয়ে ওঠে। আসে ধানে নবযৌবন । গর্ভিণী হয়ে ওঠে তারা। ধীরে ধীরে বিয়েন ছাড়ে। থোড় আসে। আর জমে ওঠে স্নিগ্ধ দুধ। আশ্বিন সংক্রান্তি হল ধানের পূর্ণ প্রসবকাল। তাই পরিপক্ক হয়ে ওঠার সময়। ধানিজমি কৃষিলক্ষ্মীর আদি দিগন্ত সবুজ শাড়ি। তাতে সোনার পরশ। ভোরে উঠে চাষী , নেয় শরের ডাককাঠি। শিশির ভেজা আলপথে , দুব্বো ঘাসে পা ফেলে মাঠে গিয়ে শোনায় ধানের গর্ভ বার্তা …” ধান ফুল, ধান ফুল… মাঠের সব ধান ফুল…”
সে ডাক মাঠে মাঠে ছড়িয়ে পড়ে। যে ধান ফুলোয় নি সেও এবার হেঁসে ওঠে রাঙা আলোয়। জমির ঈশানকোণে গঙ্গাকে দিয়ে আসে চাষী। নিয়ে আসে মাঠের জল। ডাকের জল খেয়ে মেঠো সরীসৃপরা চলে যায় শীত ঘুমে । মা লক্ষ্মী হেঁসে ওঠেন মাঠ আলো করে।
চেয়ে র’বে; ভিজে পেঁচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে
কদমের বনেশোনাবে লক্ষ্মীর গল্প-
ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে;
চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি-
শাদা শাঁখা- বাংলার ঘাসআকন্দ
\বাসকলতা ঘেরা এক নীল মঠ-
আপনার মনেভাঙিতেছে ধীরে-ধীরে;-
চারিদিকে এই সব আশ্বর্য উচ্ছ্বাস-
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১ .শ্ৰী শ্ৰী চণ্ডী
২. মেয়েদের ব্রত কথা
৩. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
8.বাংলার মুখ