মনে হতো মৃন্ময়ী মা চিন্ময়ী হয়ে এসেছেন : সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়

অনেক ছোট ছোট স্মৃতি মনের কোণে উঁকি দেয়। সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতাম কবে আসবে দুর্গাপুজো। শৈশবের পুজোর স্মৃতি বলছিলেন আইআইইএসটির বরিষ্ঠ অধ্যাপক তথা অখিল ভারতীয় বিদার্থী পরিষদের সভাপতি সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়। সুদীপ্তবাবুর কথায়, “একদম যখন ছোট বয়স ৫ থেকে ৭ বছর হবে, পটকার কয়েকটা লিস্ট তৈরি করতাম। কি কি চাই। বাবার বন্ধু সরকার কাকু এলে একটা লিস্ট দিয়ে বলতাম “কাকু এই বাজিগুলো এনে দিও।” বাবাও কিনে এনে দিতেন। স্কুল ছুটি হলে টিনের সুটকেস থেকে বই বার করে ওর মধ্যে পটকাগুলো রেখে রোদে দিতাম কয়েকদিন। তারপর পুজোর চার দিন কবে কোনটা ফাটাব তা ঠিক করতে ব্যস্ত থাকতাম কয়েকদিন। যেগুলো বেঁচে যেত, কালীপুজোর জন্য রেখে দিতাম। 
পূজার ঠিক আগে পিসিমণি জামা কিনে দিতেন। কি আনন্দ! কটা জামা হল গুনতাম। পিসি একটা, বাবা একটা, মামা-একটা, কাকা একটা ইত্যাদি ইত্যাদি। এখনো মনে পড়ে কালিচরণ জামার কথা। আমার ও দিদির একইরকম। সকলে মিলে মা-বাবার সঙ্গে অটো ভাড়া করে মণ্ডপে মণ্ডপে ঠাকুর দেখতে যাওয়া। বাবা-মায়ের সঙ্গে অন্ডালের কাছে মদনপুর গ্রামে দেশের বাড়িতে গিয়ে গোবিমার মন্দিরে একদিন পুজো দেওয়া, গ্রামের সকলের সঙ্গে দেখা হওয়া। সবাইকে চিনতাম না। বাবার কাছে শুনতাম বিভিন্ন জনের পরিচয়। বিরাট বাড়ি। মুখার্জী পরিবারের বড় দালান। এককালের জমিদার বাড়ি। অবাক চোখে দেখতাম। অধিকাংশ ঘর বন্ধ। আলাদা বৈঠকখানা – সেখানে কি-একটা অফিস হয়েছে। একটি ঘরে দাদু তার এক পিসিকে থাকতে দিয়েছিলেন। ওনার সঙ্গে দেখা হতো। বাবা আমাদের কয়েকটি ঘর খুলতেন। 

বাড়িতে মা বানাতেন নারকেল নাড়ু, নিমকি, গজা, আরসে, বেসনের বরফি। পুজোর ক’দিন মনের আনন্দে খাওয়া। অষ্টমীর দিন হতো লুচি, ছোলার ডাল, ফুলকপির তরকারি। সে কি স্বাদ! বিজয়ার পর প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া, মিষ্টি খাওয়া। কেউ যেন বাদ না যায়। একটু বড় হওয়ার পর মা-বাবার সঙ্গে যেতাম দেওঘর দেবসংঘ আশ্রম ও পরবর্তীকালে কলকাতার আশ্রমের পুজোতে। সে এক অন্য জগৎ! সকলে মিলে সমবেত মাতৃ আরাধনা। মনের পুজো, প্রাণের পুজো ! মাঝে মাঝে মনে হতো সত্যি মৃন্ময়ী মা চিন্ময়ী হয়ে এসেছেন এই মণ্ডপে। মনের সব আশা–আকাঙ্ক্ষা তাকে সমর্পন করতাম। 
প্রতিদিন পূজা শেষে ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ কোন ভেদাভেদ নেই। সকলে মিলে একসঙ্গে প্রসাদ পরিবেশন করা। শেষে নিজেরা খাওয়া। প্রচুর বন্ধু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেখানে আসতো। সে কি আনন্দ! কি মজা! রাত্রে কলকাতার মণ্ডপে মণ্ডপে সব বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়া। আজও মনে পড়ে। বিসর্জনের পরে সে কি দুঃখ! সবার মন খারাপ। আবার যে যার জায়গায় ফিরে যেতে হবে। আবার স্কুল। আবার অপেক্ষা পরের বছরের পুজোর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.