গল্প : অ্যাসাইলাম – সন্দীপ চক্রবর্তী

মাধাইপুর স্টেশনে নেমে শৌভিক পকেট থেকে পোস্টকার্ডটা বের করল। চিঠিতে বেশ প্রাঞ্জল ভাষায় পথনির্দেশ দিয়েছেন মহিলা। –মাধাইপুর স্টেশনে নামবে। স্টেশনের বাইরে অটোস্ট্যান্ড পাবে। অটোওয়ালাকে মাধাই আচার্যের আশ্রমে যাব বললেই তোমাকে পৌঁছে দেবে। আমার গুরুদেবের নামেই স্টেশনের নাম। এখানকার লােকেরা ওঁকে খুব শ্রদ্ধা করে। তােমার কোনও অসুবিধে হবে না। পােস্টকার্ড যথাস্থানে রেখে শৌভিক সিগারেট ধরাল। মাধাইপুর জায়গাটা বােধহয় মন্দ নয়। অন্তত একচিলতে ছোট্ট স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সেই কথাই মনে হয়। হেমন্তের দুপুরে এমন ঝকঝকে নীল আকাশ কলকাতায় কবেই বা দেখা যায়! নিষ্কলুষ প্রকৃতিকে আরও রোম্যান্টিক করে তুলেছে ঘুঘুর ডাক।।

কিন্তু এই মুহূর্তে প্রকৃতির শোভা দেখার মতো মেজাজ শৌভিকের নেই৷ ওর বেশ বিরক্তই লাগছে। পিউ জিদ না করলে ও কোনও অবস্থাতেই রবিবারের ছুটি মাটি করে এই ধাপধারা গোবিন্দপুরে আসত না। শৌভিক অনেক বুঝিয়েছে। এমনকী, কেউ ঠাট্টা করে চিঠি লিখেছে, বলে উড়িয়ে দেবারও চেষ্টা করেছে। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি। পিউয়ের সাফ কথা, দ্যাখো, ভদ্রমহিলার যে বয়েস হয়েছে সেটা ওর নাম শুনেই বােঝা যায়। রাসমণি নাম আজকাল কেউ রাখে না। তার ওপর উনি একটা আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত। এই বয়েসের এবং মানসিকতার একজন মানুষ এই ধরনের বাজে ঠাট্টা কখনওই করবেন না। আমার মতে তোমার একবার যাওয়া উচিত। দামি জিনিস বলতে উনি কী বুঝিয়েছেন ওখানে না গেলে তো বোঝা যাবে না।

অটোস্ট্যান্ডে ভিড় বেশি নেই। শৌভিক একজন অটোওয়ালাকে বলল, ভাই মাধাই আচার্যের আশ্রমে যাব। অটোওয়ালা অল্পবয়েসী ছেলে। দুপুরে প্যাসেঞ্জার নেই বলে ট্রানজিস্টারে গান শুনছিল। শৌভিকের প্রশ্ন শুনে শশব্যস্ত হয়ে বলল, আশ্রমে যাবেন? বসুন।

গ্রামের এবড়োখেবড়ো রাস্তা। ছেলেটা যদিও খুব সাবধানে চালাচ্ছে, তবুও হাতল শক্ত করে না ধরে রাখলে টাল খাবার সম্ভাবনা আছে। শৌভিকের কৌতুহল হচ্ছিল। বলল, তুমি আশ্রমে মাঝে মাঝে যাও নাকি? ছেলেটা সসম্ভ্রমে বলল, কী বলছেন স্যার! আমি তো ওই আশ্রমেই দীক্ষা নিয়েছি। শৌভিক সিগারেট ধরিয়ে আড়চোখে ছেলেটাকে দেখল। কত বয়েস হবে ছেলেটার? বড়জোর পঁচিশ-ছাব্বিশ। এরই মধ্যে দীক্ষা! শৌভিক নাস্তিক নয়। কিন্তু যে বয়েসে মানুষ জীবনের ভালোমন্দ উপভোগ করে, সেই বয়েসে ধর্মকর্ম করা ওর পছন্দ নয়। সিগারেটে গােটা তিনেক লম্বা টান দিয়ে শৌভিক বলল, রাসমণি দেবী নামে তুমি কাউকে চেনো? | চিনি স্যার। আশ্রমে সবাই ওকে মাতাজী বলে। অমন মানুষ হয় না। আপনি কি মাতাজীর কাছে যাচ্ছেন? | শৌভিক কিছু বলল না। ওর মাথায় চিঠির কথাগুলো ঘুরছিল।— স্নেহের বাবা শৌভিক, আমাকে তুমি চিনবে।

কিন্তু আমি তোমাকে চিনি। তোমার জন্মাবধি চিনি। জানি, তুমি ব্যস্ত মানুষ। কিন্তু তোমাকে বাবা একদিন। সময় করে মাধাইপুরে আসতেই হবে। তোমার একটা জিনিস অনেক বছর ধরে আমার কাছে পড়ে আছে। জিনিসটা আমার কাছে খুব দামি। সব কথা শোনার পর তুমিও বুঝতে পারবে কেন এত জোর দিয়ে তোমাকে আসতে বলছি।–

দশ-বারোটি মেটে ঘর নিয়ে মাধাই আচার্যের আশ্রম। আশ্রমের প্রধান আকর্ষণ রাধাকৃষ্ণের মন্দিরটি মাঝখানে রেখে ঘরগুলো তৈরি করা হয়েছে। মন্দিরের চাতালে বসে নানা বয়েসের মহিলারা কাজকর্ম করছেন। শৌভিকের মনে হল এইসব মহিলা আশ্রমেই থাকেন। তবে এরা গৃহী না সন্ন্যাসী সেটা বোঝার উপায় নেই। একজন মাঝবয়েসী মহিলা শৌভিককে বসতে বলে রাসমণি দেবীকে খবর দিতে গেছেন। শৌভিকের বেশ একঘেয়ে লাগছিল। এর আগে ও কখনও এই ধরনের আশ্রমে আসেনি। কোনও নতুন জায়গায় গেলে ঘুরেফিরে দেখার একটা কৌতূহল থাকে। শৌভিকের তাও নেই। চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে একটা চিন্তাই ওর মাথার মধ্যে শিকড় গেড়ে বসে আছে। কে এই রাসমণি? শৌভিকের যখন তিন বছর বয়েস তখন ওর মা মাধুরী মারা যান। অলোকেন্দু যতটা ওর বাবা, ঠিক ততটা মাও। তিন মাস হল অলােকে চলে গেছেন। বাবার সঙ্গে শৌভিকের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতো। সেখানে কোনও আড়াল-আবডাল ছিল না। বাবার সঙ্গে ওর সব কথাই হত। অলোকেন্দুও কোনওদিন রাসমণি দেবী বলে কারও কথা বলেননি! তুমিই শৌভিক? চিঠি পেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ? শৌভিক অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। রাসমণি কখন ঘরে এসেছেন খেয়াল করেনি৷ ধাতস্থ হয়ে ভালো করে। রাসমণিকে দেখার পর ও বেশ অবাক হল। একজন সন্ন্যাসিনী কি এত সুন্দরী হন? কিন্তু এ এমন এক সৌন্দর্য যা। দেখে ভোগের ইচ্ছে জাগে না। বরং এক অপার্থিব মায়ায় ডুবে যায় মন। শৌভিক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ, আমিই শৌভিক। আপনি নিশ্চয়ই—

বোসো। বসে কথা বলো। তোমার ডাকনাম তো সোনা। আমি তোমাকে সোনা বলেই ডাকব।

শৌভিকের বিস্ময় বাড়ল। ওকে ডাকনামে যারা ডাকতেন বা ডাকতে পারতেন তারা কেউই আর বেঁচে নেই। বেশিরভাগই মারা গেছেন এক দুর্ঘটনায়। হ্যাঁ, সেই বীভৎস ঘটনাকে শৌভিক দুর্ঘটনা ভেবেই ভুলে যেতে চায়। এই মহিলা যখন ওর ডাকনাম জানেন তখন ওদের পরিবারের নিষ্ঠুর অতীতও নিশ্চয়ই জানেন। কিছুটা বিহ্ববল ভঙ্গীতে শৌভিক বলল, আপনি কে? আমার ডাকনাম কী করে জানলেন?

রাসমণি হাসলেন, ওসব কথা পরে হবে। আগে কিছু খেয়ে নাও। তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি খিদে পেয়েছে।

শৌভিকের খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। ওর মনে প্রবল অস্থিরতা। বিস্মৃত এক গুহামুখের পর্দা সরে যাওয়ার ভয়। কিন্তু রাসমণি কোন কথাই শুনলেন না। শৌভিকের খাওয়া শেষ না পর্যন্ত সারাক্ষণ পাশে বসে রইলেন। শৌভিক কম খায় বলে অনুযোগ করলেন। আবার দই খেলে ওর ঠাণ্ডা লাগে বলে পরিবেশনকারিণী মেয়েটিকে বললেন, ও যখন খাবে না বলছে ওকে দই দিসনি উমা। বরং প্রসাদের মিষ্টি আর একটা দে। খাওয়ার পর নিজের ঘরে। শৌভিককে বসতে বলে রাসমণি বললেন, তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি এখনই আসছি।

এক চিলতে ঘর। আসবাবপত্রও সামান্য। একটা ছোট তক্তপোশ আর একটা কাঠের আলমারি। কিন্তু সবকিছু ভারী পরিপাটি করে সাজানো। শুধু দেওয়ালগুলো বড়ো শূন্য। শৌভিকের মনে হল একটা ছবি কি নিদেন একটা ক্যালেন্ডার থাকলে মানানসই হত৷ রাসমণি ঘরে ঢুকলেন খবরের কাগজে মোড়া চৌকো মতন কী একটা জিনিস হাতে নিয়ে। ওটা কী বোঝার উপায় নেই। ছবি হতে পারে। বইও হতে পারে। শৌভিক ভাবল কথাটা জিজ্ঞাসা করবে। এটাই সেই জিনিসটা কিনা যার কথা রাসমণি চিঠিতে লিখেছেন। কিন্তু করতে পারল না। একটা অদ্ভুত ভয় ওকে করতে দিল না। তক্তপোশে আয়েশ করে বসে রাসমণি হেসে বললেন, আমি জানি তুমি ছটফট করছ। সেটা স্বাভাবিকও। তবে আর আমি তোমাকে কষ্ট দেব না। থামলেন রাসমণি। কয়েক মুহূর্ত কী যেন চিন্তা করে বললেন, প্রথমেই বলি অলোকেন্দুদা আমাকে চিনতেন। আমাদের মধ্যে চিঠিপত্রে যোগাযোগও ছিল। আজ যে জন্য তোমাকে আমি ডেকে এনেছি অলোকেন্দুদা নিজেই তা করতে চেয়েছিলেন। পাছে তুমি ভুল বোঝো তাই করতে পারেননি। দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমায়। তবে একটা শর্তে। ওঁর জীবদ্দশায় আমি কিছু করতে পারব না। যে চিঠিতে তিনি এসব কথা আমায় লিখেছিলেন সেটা পড়লেই তুমি বুঝতে পারবে। রাসমণি আলমারি খুলে চিঠি বের করে শৌভিককে দিলেন।

অলোকের হাতের লেখা চিনতে শৌভিকের অসুবিধে হল না। চিঠির তারিখ দেখে বুঝল মারা যাবার তিন মাস আগে লেখা। একেবারে শেষে অলোকেন্দু লিখেছেন, মাধবীর প্রতি আমি অন্যায় করেছি, রেণু। জীবনের শেষদিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই আমার অপরাধবোধ বাড়ছে। জানি না ঈশ্বর আমাকে কী শাস্তি দেবেন। প্রতিদিনই ভাবি সোনাকে সব কথা খুলে বলব। কিন্তু সাহস পাই না। যদি ও আমায় ভুল বুঝে দূরে সরে যায়! আমার একটা অনুরোধ রাখবে? এ গুরুদায়িত্ব তুমি নেবে? পরিবারের ইতিহাস সন্তানের কাছে গোপন করে আমি মহাপাপ করেছি। মাধবীকে বঞ্চিত করেছি তার ন্যায্য অধিকার থেকে। এই বিপুল আত্মগ্লানি আমি আর সইতে পারি না। তুমি আমায় মুক্তি দাও রেণু। তুমি মাতাজী। তুমি সর্বংসহা। আমার মৃত্যুর পর তুমি সব কথা সোনাকে বোলো। আমি তোমার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকব। ইতি–তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী, অলোকেন্দুদা |

শৌভিক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল রাসমণির দিকে। তারপর বলল, বিশ্বাস করুন আমি এসবের কিছুই বুঝতে পারছি না। মাধবী কে?

 রাসমণি সঙ্গে সঙ্গে কিছু বললেন না। এই কালক্ষেপ যত না সময় নেওয়ার জন্য, তার থেকে অনেক বেশি শৌভিককে সময় দেওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পর বললেন, তোমার মা।

আপনার ভুল হচ্ছে। আমার মায়ের নাম মাধুরী। মাধবী নয়। আমার যখন তিন বছর বয়েস মা মারা যান।

রাসমণি চিন্তা করছিলেন। দৃষ্টি বাইরে। হেমন্তের পড়ে আসা বেলায় লাল রং ধরেছে রোদ্দুরে। ঠিক যেমন সে। রাতে বোড়াগাঁর আকাশ লাল হয়ে উঠেছিল আগুনের আভায়। পালাচ্ছিল সবাই। গ্রাম ছেড়ে, দেশ ছেড়ে, সর্বস্ব ছেড়ে–| যারা পালাতে পারেনি, ধরা পড়ে গেছে— তাদের অবস্থা ছিল সব থেকে খারাপ। পুরুষদের নির্বিচারে খুন করছিল ওরা। আর মেয়েদের— ভাবতে ভাবতে কেঁপে উঠলেন রাসমণি। একটা অন্য চিন্তা মাথায় এল। তিনি সন্ন্যাসী। পূর্বাশ্রমের কথা স্মরণ করা তার অকর্তব্য। পরক্ষণেই মনে পড়ল অলোকেন্দুর কথা। অলোকেন্দুকে তিনি কথা দিয়েছিলেন। রাসমণির প্রতিশ্রুতি পেয়ে শান্তিতে চোখ বুজেছেন অলোকেন্দু৷ আজ যদি তিনি কথার খেলাপ করেন, কলঙ্কিত হবে তার সন্ন্যাস। রাধামাধবের সামনে কোনওদিনই তিনি আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবেন না।

রাসমণি নিজের ভেতরে প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে সোজা হয়ে বসলেন। তারপর সরাসরি তাকালেন শৌভিকের দিকে, ভুল আমার হচ্ছে না সোনা। তবে আমার কথা ঠিকমতো বুঝতে হলে তোমাকে আগে ইতিহাসটা জানতে হবে। সামান্য বিরতির পর বলতে শুরু করলেন রাসমণি। দেশভাগের পর রেণুর বাবা সদাশিব মুখোপাধ্যায় এবং অলোকের বাবা হরনাথ মিত্র পূর্ববঙ্গেই রয়ে গিয়েছিলেন। দুটি পরিবারেরই বসবাস বোড়ালগ্রামে। সদাশিব ছিলেন কলেজের অধ্যাপক আর হরনাথ আইনজীবী। দই বন্ধর হৃদ্যতা এমন পর্যায়ের ছিল যে অনেকেই ভাবতেন অলোকের সঙ্গে রেণুর বিবাহ শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু তা হয়নি। কারণ সদাশিব কায়স্থ হরনাথের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়েতে সম্মত হননি। দুটি অবুঝ বাল্যপ্রণয়ীর প্রেম অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসকের অত্যাচারে পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা তখন কোণঠাসা। তৈরি হয়েছে শত্রু সম্পত্তি আইন। এই আইনের জোরে ছুতোনাতা কারণে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে হিন্দুদের সম্পত্তি। সদাশিব এবং হরনাথ দুজনেই সম্পন্ন গৃহস্থ। তারা বুঝতে পারছিলেন, যে কোনওদিন তাদের ওপরেও খাঁড়া নেমে আসতে পারে। কিন্তু তবুও তারা পূর্ববঙ্গ ছেড়ে আসার কথা ভাবেননি৷ যাকে কাদায় গুণ ফেলে থাকা বলে সেভাবেই ছিলেন। খবরের কাগজে রোজ পড়তেন হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের খবর। দুই বন্ধু আলোচনা করতেন। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম আসত না, তবুও দেশের প্রতি এবং পিতৃপুরুষের অর্জিত সম্পদের প্রতি মায়ায় রয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু একাত্তরে পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে উঠল। বোড়ালগ্রামের একদা জমিদার গোপাল রায়চৌধুরী নিজের বাড়িতে সপরিবারে খুন হলেন। জমিদারবাড়ির দখল নিল মুসলমান গুন্ডারা। সদাশিব এবং হরনাথ সিদ্ধান্ত নিলেন, আর নয়। এবার চলে যেতেই হবে। ইতিমধ্যে অলোকের সঙ্গে যশোরের অবনীন্দ্রনাথ বসুর মেয়ে মাধবীর বিয়ে হয়েছে। ওদের একমাত্র ছেলের বয়েস ছ’মাস। সদাশিব এবং হরনাথ দুজনেই জানতেন সাতপুরুষের সম্পদ তারা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন না। গোলাম হোসেনের দলবল অষ্টপ্রহর লুটপাট করার জন্য ওৎপেতে বসে আছে। গোলাম রাজাকার বাহিনীর পাণ্ডা। অত্যাচারী খানসেনার ডানহাত। ক’দিন আগেই বোড়ালগ্রামের শতাব্দীপ্রাচীন কালীমন্দির ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে ওরা। পুরোহিত কালীকিঙ্কর কলমা পড়তে রাজি না হওয়ায় তার গলা কেটে খুন করেছে। সুতরাং যৎসামান্য টাকাপয়সাই সঙ্গে নেওয়া গেল। মুশকিল হল গয়নার বাক্সগুলি নিয়ে। সাত-সাতটা গয়নার বাক্স গোলাম হোসেনের চোখের আড়ালে রাখা সহজ কথা নয়। হরনাথ বললেন, আমার মতে ওসমান আমাদের সঙ্গে চলুক। ষণ্ডা-গন্ডা আছে, লড়তে পারবে। মুসলমান হলেও ওরা তিন পুরুষ ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে। এই প্রস্তাবে কেউই আপত্তি করেনি। শুধু মিত্তিরবাড়িতে নয়, ওসমানের যাতায়াত ছিল রেণুদের বাড়িতেও। রেণুর মা মায়া বলতেন, ওসমানরে দেইখ্যাও সুখ। সেদিনের সেই হিঁচকাঁদুনে পোলাডা বড়ো হইয়া মাঝি হইসে। সুতরাং সন্দেহ করার কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু তখন কে জানত ওই ওসমানই খাল কেটে গোলাম হোসেনকে ডেকে আনবে।

ইতিহাস বলতে বলতে রাসমণির গলা ধরে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, যে রাতে ওরা। বোড়ালগাঁয়ে আগুন লাগাল, সে রাতেই আমরা গাঁ ছাড়লাম। ওসমানের নৌকায় আমরা তিনটে পরিবার। আমি, বাবা, মা, হারুকাকা, কাকিমা, অলোকেন্দুদা, মাধবী, তুমি, তোমার মামাদাদু অবনী মেসােমশাই আর তোমার মাসি মাধুরী। যাকে তুমি মা বলে জানো। ভেবেছিলাম চলে যেতে পারব। একবার ঢাকা পৌঁছতে পারলে আর চিন্তা ছিল না। ট্রেনে চড়ে সোজা কলকাতা। কিন্তু কপাল মন্দা কোতুলপুরের কাছে ধরা পড়লাম। ওরা ছিল মোট ন’জন। পাশের একটা নৌকা থেকে আমাদের নৌকায় উঠে গোলাম হোসেন দুহাত লম্বা ছুরি বাবার গলায় ঠেকিয়ে বলল, আমাগো পাওনা না মিটাইয়াই পালাইবার মতলব করসিলেন নাকি কত্তা! বাবা বলেছিল, আমাদের প্রাণে মেরো না গোলাম। তোমার পায়ে পড়ি। সঙ্গে টাকাপয়সা-গয়নাগাঁটি যা আছে সব তুমি নাও। কিন্তু কোনও লাভ হল না। সেদিন চোখের সামনে বাবা মা হারুকাকা, কাকিমা আর অবনী মেসোমশাইকে খুন হতে দেখেছিলাম। অলোকেন্দুদা জলে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিল৷ তোমাকে কোলে নিয়ে মাধুরীও তাই করেছিল। অমাবস্যার রাত ছিল। ওরা খুঁজে পায়নি।

আপনাদের কী হল? শৌভিক জিজ্ঞাসা করল।

আমাদের! রাসমণি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। শৌভিক দেখল রাসমণির গাল বেয়ে জলের ধারা। নেমেছে। ওর মন খুব নরম। অন্য সময় হলে ও হয়তো বলত, আপনার যদি কষ্ট হয় বলতে হবে না। কিন্তু আজ ও কিছুই বলল না। মাতৃস্নেহ ও পায়নি। তার জন্য কাউকে বলতে না পারা এক কাঙালপনা ওর মধ্যে রয়ে গেছে। ছেলেবেলায় স্কুল থেকে ফিরে মাধুরীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ও সারাদিনের সব কথা বলত। ঠিক যেমন করে ওর বন্ধুরা বলে। যেমন করে স্বর্গের দেবশিশুরা বলে। আজ এই মহিলা বলছেন মাধুরী ওর মা নয়। তা হলে কে ওর মা? মাধবী? যদি তাই হয় মাধবীর সব কথা ওকে জানতে হবে।

রাসমণি আঁচলে চোখ মুছে বললেন, এতক্ষণ কী ভাবছিলাম জানো সোনা? ভাবছিলাম, আমি সন্ন্যাসী হলেও তুমি আমার সন্তানতুল্য। তোমাকে কী করে আমি সেদিনের কথা বলব? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাসমণি। তারপর বললেন, সেদিন ন’জন রাক্ষস আমাকে আর মাধবীকে ভোগ করেছিল। সেখানেই শেষ নয়। একটা মিলিটারি ব্যারাকে বন্দী ছিলাম তিন মাস। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, একজনের পর আর একজন— আমরা যে মানুষ ভুলে গিয়েছিলাম। প্রতিদিন নিজেদের অভিশাপ দিতাম। মৃত্যুকামনা করতাম। পাগলের মতো দেওয়ালে মাথা ঠুকতাম। কিন্তু না, মরণ আমাদের হয়নি।

শৌভিক হতবাক। অলোকেন্দুচিরকাল হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির কথা বলেছেন। দেশভাগের জন্য রাজনীতিকে দোষারোপ করেছেন। নেতাদের ক্ষমতার লোভকে দায়ী করেছেন। কিন্তু কখনও বলেননি ওর মাকে–ওর দেশকে এত যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল।

রাসমণি অন্যমনস্ক ভঙ্গীতে বললেন, দুঃখটা কোথায় জানো? আমার সব শূন্যতা রাধামাধব ভরিয়ে দিয়ে  গ পায়নি। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। এখানে আসার পর যে ক’দিন বেঁচেছিল, অ্যাসাইলামেই কেটেছে। আমি আর অলোকেন্দুদা পালা করে যেতাম। এমনিতে কথা-টথা বিশেষ বলত না। শুধু আমরা গেলে বলত, তোমরা দেখে নিয়ো, সোনা একদিন আসবে। মায়ের অপমান ও মেনে নেবে না। তোমরা কিন্তু ওকে আমার কথা বোলো। আমি ওর অপেক্ষায় থাকব। ও যেন আমায় বাড়ি নিয়ে যায়।

ট্রেন চলতে শুরু করেছে শিয়ালদার দিকে। কিন্তু শৌভিক এখনও ডুবে আছে একটা ঘোরের মধ্যে। কোলের ওপর খবরের কাগজে মোড়া মাধবীর ছবি। শৌভিক দেখেছে ছবিটা। মাধবী আর মাধুরীর চেহারায় অনেক মিল। অমিল শুধু ভবিতব্যে। যে ভবিতব্য ঈশ্বর লেখেননি, লিখেছিলেন ভারতের মহান রাজনৈতিক নেতারা। এক উন্মাদ জনগোষ্ঠীর নিষ্ঠুরতায় প্রাণ পেয়েছিল সেই ভবিতব্য। আর চরম পরিণতিতে পৌঁছেছিল অ্যাসাইলামের ছোট্ট ঘরে।

ডুকরে উঠল শৌভিক। ওর মনে হচ্ছিল, কোনও মানবীর নয়, ও আসলে এক অ্যাসাইলামের সন্তান। এই দেশের কোটি কোটি মানুষ প্রত্যেকেই অ্যাসাইলামের সন্তান। কিংবা, খণ্ডিত এই দেশটাই একটা বিশাল অ্যাসাইলাম। যার নাম মাধবী। অথবা রেণু।

ভয় করছিল শৌভিকের। মারাত্মক ভয়। স্রেফ ভয় থেকে বাঁচার জন্য শৌভিক একটানে কাগজের মােড়ক ছিড়ে মাধবীর ছবিটা বের করে আনল। কাঁচের গায়ে হাত বােলালাে কিছুক্ষণ। মা কখন দেশ হয়ে যায় আর দেশই বা কখন মা হয়ে যায় কে জানে! অ্যাসাইলামের ঘরটা একটু একটু করে মিলিয়ে গেল। শৌভিক ফিসফিস করে বলল, তােমার অপেক্ষা শেষ হয়েছে মা। এই দ্যাখো তোমাকে আমি বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.