থীম: দুর্গতিনাশিনী যেখানে দুর্গতিগ্রস্ত
বুকের মধ্যে ঢাকের বাদ্যি শুরু হয়ে যায় মহালয়ার ভোরে চণ্ডীপাঠ থেকে। বছরের একটিমাত্র দিনে ভোর বেলা উঠে রেডিও খুলে শোনো, নতুবা ফস্কে গেলে আপসোস করো – এই শৃঙ্খলা কবে চূরমার; কারণ ইদানিং মণ্ডপে মণ্ডপে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ পঙ্কজ মল্লিকরা যখন তখন উপস্থিত। শুধু মণ্ডপ কেন, বাজারে সিডি বা ইন্টারনেটেও উপলব্ধ – নিজের বাড়িতেও যখন খুশি শোনা যায়; এমনকি মহরম কী খ্রিস্টমাসের দিনে শুনতেও শাস্ত্রীয় বাধা নেই। মহালয়ায় চণ্ডীপাঠ তাই এখন আর দুর্লভ প্রতীক্ষা নয়, সুলভ পণ্য। যুগের সঙ্গে প্রযুক্তির দৌড়ে তাই এই যুগপৎ সীমাবদ্ধতা ও বিশেষ আকর্ষণ হারানোর মধ্যে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি দুটোই আছে।
কিন্তু আরও অনেক বিবর্তন হয়ে চলেছে যেগুলো গোড়ার দিকে অভিনব মনে হলেও একটা সময় আসে, যখন রীতিমতো ধাক্কা খেতে হয়। তেমনই ধাক্কা দিয়েছে এবারের দুর্গাপুজোর থীম। বাম জমানা থেকে শুরু হওয়া থীম পুজোকে বরাবর সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পীদের মানবিক ও শৈল্পিক প্রতিক্রিয়া হিসাবেই দেখে এসেছি। যখন পুজোর প্যান্ডেলে বন্যার থীম চিত্রায়িত হয়, তখন কোথাও যেন দেখনদারির পাশাপশি সংবেদনশীলতাও ফুটে ওঠে। প্যান্ডেল সজ্জা পর্যন্ত থীম তাই শিল্পীর স্বাধীনতা বলে ধরাই যায় এবং সচরাচর থীমস্বরূপ মূর্তির পুজো হয় না, হয় অন্য একটি ছোট প্রতিমা ও ঘটের। কিন্তু থীম মণ্ডপসজ্জার সঙ্গে যখন প্রতিমাকে স্পর্শ করে তখন পুজোর তাৎপর্যই লঘু ও বিকৃত হয়ে যায়।।
এ বছর বেহালার বড়িষা ক্লাবের থীমে সপরিবার পরিযায়ী শ্রমিকরূপী মা দুর্গা একটি অত্যন্ত উচ্চমানের ভাস্কর্ষ মণ্ডপ অলংকৃত করছে। অত্যন্ত ব্যঞ্জনাময় থীম সন্দেহ নেই। একজন পরিযায়ী শ্রমিক নারীর মধ্যে দুর্গার প্রতিমূর্তি ফুটিয়ে তোলার অর্থ সব নারীর মধ্যেই ভগবতী দর্শনের অনুপ্রেরণা। কেউ আবার এই মূর্তিকে নোয়াখালী দাঙ্গার সময় কি দেশভাগের সময় প্রাণ ও মান বাঁচাতে পালিয়ে আসা হিন্দু রমণী ও তার অসহায় পরিবার হিসাবেও দেখতে চাইছে। সত্যিই তো, একে যদি দেবীর অপমান মনে করা হয়, তাহলে তো কুমারী পুজোও নিষিদ্ধ করতে হয়। তাহলে এত বিতর্কের কারণ কী?
কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় চালচিত্রে দশটি হাতে দশরকম ত্রাণ সামগ্রী ধরানো। অস্ত্রের বদলে ত্রাণ! এ বছর বেশ কয়েকটি থীমেই দেখা গেছে দুর্গা অস্ত্রহীন। গোটা দেশ জুড়েই যে হারে নারী নির্যাতন বাড়ছে, তাতে মেয়েদের সশস্ত্র হওয়ার অনুপ্রেরণা দেওয়ার বদলে যদি স্বয়ং শক্তিরূপিনীর হাত থেকেই অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে তার অন্তর্নিহীত অভিসন্ধি নিয়ে সন্দেহ জাগবেই। দু দিন আগেই ঘাটালের ৩৫ বছর বয়সী গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে দুই পা চিরে তিনজন মুমিন পুংগব নৃশংসভাবে যা করার করে মেরে ফেলে। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, আর অন্যান্য ঘটনাগুলোও কম নৃশংস নয়। পশ্চিমঙ্গের মাননীয় রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য পুলিসকে ট্যাগ করে একটি টুইট করেন, “Rapes-223 and Kidnappings-639 in August 2020 as per official reports indicate a worrisome state of crime against women — a cause of concern. Time to douse fire under feet and put law and order in place before attending flames elsewhere.” মাত্র এক মাসে এই রাজ্যে ২২৩টি ধর্ষণ ও ৬৩৯টি অপহরণ, যাদের ধর্ষণ ও অন্যান্য অত্যাচার করা হবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়াই যায়। এটা খালি নথিভুক্ত ঘটনা, আসল সংখ্যাটা কত তা কল্পনাতীত। এই অগ্নিগর্ভ নারকীয় পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে স্বয়ং মা দশ প্রহরণধারিণীকে নিরস্ত্র অসহায় করে দেখানোর উদ্দেশ্য কী হতে পারে?
নারী সশক্তিকরণ ও লিঙ্গ সমতার মানে কি ছেলেদের শাড়ী নাইটি পরিয়ে নপুংসকের ভূমিকায় অভিনয় করানো, আর একটি রাজনৈতিক দল সুবিধা পেয়ে যাবে আশঙ্কায় ধারাবাহিক ও ব্যাপক ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা নিয়ে নীরবতা পালন? মুখে নারী স্বাধীনতার কথা বললেও এবং কয়েকজন ব্যভিচারিণীকে শোকেসে নারীবাদের মডেল বানিয়ে সাজিয়ে রাখলেও, তারা কি আদৌ নারীর ক্ষমতায়ন তো দূর নিরাপত্তাটুকুও চায়? চাইলে মায়ের পদতলে পরাজিত নিহত মহিষাসুরকে মেনে নিতে পারত, শ্রদ্ধাবনত হত রণমত্তা মুণ্ডমালিনীকে শান্ত করার জন্য তাঁর চরণতলে স্বামী মহেশ্বরের বুক বিছিয়ে পড়ে থাকার রূপকল্পটি। কিন্তু নারীর আত্মরক্ষার ও সশস্ত্র প্রতিরোধের দৃশ্য সহ্য হয় না বলেই মহিষসুরকে হুডুড় দুর্গা নামের বীর প্রজাবৎসল অনার্য রাজা আর স্বয়ং জগজ্জননীকে দেহপোজীবিনী বানানোর চক্রান্ত। এটা যদি পুরুষতান্ত্রিক বিকৃতি না হয়, তাহলে কী? স্বয়ং মহিষাসুরও যে শেষ পর্যন্ত মায়ের ভক্ত হয়ে মোক্ষ লাভ করে, এই উপাখ্যান শুনলে লজ্জায় আত্মঘাতী হত মনে হয়।
একে তো এ বছর দুর্যোগের সীমা নেই। উৎসব শুরুর আগেই আনন্দে ভাঁটা। উত্তরপ্রদেশে রামলীলা সাবধানতা মেনে হলেও প্রকাশ্যে দুর্গাপুজো করোনা সংক্রমণ এড়াতে নিষিদ্ধ হয়েছে। খুব সহজে গেরুয়া দল সমান বাঙালী বিদ্বেষ সমীকরণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। কিছুদিন পর দিল্লীতেও মন্দির ছাড়া দুর্গাপুজোর ওপর নিষেধাজ্ঞা নেমে এল। কোনও সমীকরণ খুঁজে পাওয়া গেল না। কারণ ২০২০ দিল্লী দাঙ্গার নেপথ্য কারিগর এক শ্রেণীর বাংলাভাষী ও বাংলাবাসীর খুব আপনজন। তার ওপর খোদ পশ্চিমবঙ্গের বুকে কলকাতা হাইকোর্ট প্রতিটি পুজো প্যান্ডেলকে কনটেনমেন্ট জ়োন বা সংক্রমণ অঞ্চল ঘোষণা করে দিয়েছে। প্যান্ডেল থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার ও প্যান্ডেলের মধ্যে দর্শনার্থী নিষিদ্ধ করে এমনকি আয়োজকের সংখ্যাও সীমিত করে এবছর দুর্গা পুজোর অন্তর্জলীযাত্রার আয়োজন সেরেই ফেলা হয়েছে। পুজো তো চার-পাঁচ দিনের ব্যাপার, নিত্যদিন ভিড় বাসে কী ধরণে সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে, সে প্রশ্ন তোলা বৃথা। তবে কোভিড-১৯ নিয়ে রাজ্য, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সবরকম স্তরে এমন আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে, যে এই সিদ্ধান্তে কী প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত বুঝে পারছে না সাধারণ মানুষ। তারও ওপর এই থীম পুজোর দাপটে শক্তিপুজোর থীমটাই গুলিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে কিন্তু একটা অতি পরুষতান্ত্রিক অস্থিরতা সমাজে, যেখানে খুব সহজে যে শক্তি হতে দেবাদিদেবেরও উৎপত্তি মনে করা হয়, সেই মহামায়াকে নিয়েও অনয়াসে ছেলেখেলা চলেছে।
অস্বীকার করার উপায় নেই থীমগুলো প্রায়শ শিল্পগুণে ও মানবিক আবেদনে প্রায়শ অনবদ্য। আমরা সাধারণ অসহায় নারীর মধ্যেও দেবিত্ব খুঁজে পেতে জানি। সে শিক্ষা আমাদের ধর্মেই আছে; পুরুষোত্তমকেও মানুষ মায়ের ডিম্বে উৎপন্ন হয়ে মাতৃগর্ভে বাস করেই পৃথিবীতে আসতে হয়। তাই থীমগুলো দেখে আমরা মোহিত হয়ে যাই। কিন্তু এখানেই বিপদ বেশি। আমরা বাস্তবের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে ভুলে যাই, দুর্গা পূজা যখন করব, তখন তাঁর দুর্গতিগ্রস্ত রূপ নয়, দুর্গতিনাশিনী রূপেরই করব।