রাষ্ট্রবাদী মানুষ মনে করেন, “আগে দিয়ে বেড়া/তবে ধরো গাছের গোড়া।” দেশকে আত্মনির্ভরতা দিয়ে, অর্থনৈতিক সুরক্ষা দিয়ে প্রতিটি জীবনবৃক্ষকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, তাই রাষ্ট্রীয় বেড়া দিতে হবে। বিদেশী নির্ভরতা কমিয়ে ভারতীয় সামগ্রীর উৎপাদন ও উৎকর্ষতা বৃদ্ধির নতুন নামকরণ হল স্বদেশী জাগরণ। কোথায় স্বাবলম্বনের বেড়া দিতে হয়, কোথায় দেশরক্ষার জন্য আত্মবলিদান করতে হয়, তার নির্দেশ নেই যে মতাদর্শে — তার ভরকেন্দ্র ভারতবর্ষ নয়, হতে পারে ভারতবর্ষের বাইরের কোন গুপ্তদেশে, বিদেশি শক্তির মন্ত্রগুপ্তির শপথে। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে স্বদেশী জাগরণের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে। প্রথম আয়োজনটি হওয়া উচিত পুঞ্জীভূত মানসিক ধার মেটানোর কার্যক্রম; এতদিনের মানসিক ঋণের বোঝা দূর হোক। স্বদেশী ঘরানার মানসচর্চা কোথা থেকে কোথা পর্যন্ত বিস্তৃত, কোথায় তার নানান সমৃদ্ধি, কোথায় তার বিকাশ ও সম্ভাবনা — তার সুলুকসন্ধান করার নিত্যকর্ম হবে জাগরণের-পূজারী ও প্রচারকবৃন্দের আশু কর্তব্য।

কিন্তু তাই বলে কী পাশ্চাত্যের প্রভাব খারাপ? কোথায় প্রাচ্য আর কোথায় পাশ্চাত্য খাপ খাবে, সে সম্পর্কে আধুনিক ভরতবর্ষের রাষ্ট্রবাদী মানুষের বাইরে সেই জ্ঞানের দীনতা বরাবরই ছিল। কোথায় ভারতবর্ষ চিন্তায়-চেতনায়, সম্পদে-আয়োজনে ধনী, কোথায় আমাদের দারিদ্র্য, কোথায় আমাদের বিদেশী দই-এর দম্বলটুকু নিয়ে ভারতে দই পাততে হবে, সে ধারণার যারপরনাই খামতি ছিল। আজ করোনা পরিস্থিতিতে সুযোগ এসেছে বিদেশি বিদায় করে স্বদেশী আহ্বানের কাজকে বাস্তবায়ন করা। এটাকে বলা যেতে পারে অকাল দীপান্বিতা লক্ষ্মী-পূজার আয়োজন। অলক্ষ্মীকে দূর করে লক্ষ্মীকে গৃহে প্রতিষ্ঠা। দেশীয় বিচারধারার ভিত্তিপ্রস্তর পাকা করার নামই হল নবতর-স্বদেশী-জাগরণ

একটি প্রবাদ বাক্য হল, “এক গাছের ছাল আর গাছে জোড়ে না”। সিদ্ধান্ত নিতে হবে কতটুকু গ্রহণ করবো, আর কতটুকু বর্জন করবো। বিদেশের মোহ আর অন্ধ অনুকরণ বন্ধ করার নাম স্বাদেশিকতা। আপন সামর্থে, দেশীয় সৌকর্যে আপনার বাগানে ফুল ফোটান যিনি, তিনিই স্বদেশী। আপনার চিন্তা-চেতনায় আপন দেশের মাটি যার কাছে বহুগুণ পবিত্র তিনিই স্বদেশী। বিদেশে বসবাস করেও ভারতের মানুষের মঙ্গলের জন্য সতত পরিকল্পনা করতে পারেন যিনি, সেই ত্যাগী মানুষকে স্বদেশীয় বলা চলে। যার মস্তিষ্কে, মননে, করসেবায় ভারতের তপস্যা তিনি ভারতীয়। ভারতে বসে ভারতরাষ্ট্রের ভিত যিনি প্রতিনিয়ত দুর্বল করার সিঁদ কাটেন তিনি বিদেশি। ভারতে বসবাস করে যার হেড কোয়ার্টার বিদেশের সিগনাল ক্যাচ করে তিনি অবশ্যই বিদেশি। দেশী-বিদেশীকে চিনতে পারার অন্য নাম স্বাদেশিকতা

ডাক দেওয়া হয়েছে স্বনির্ভর ভারত গড়ার, প্রচেষ্টা হচ্ছে স্বদেশী জাগরণের, তবে যে জিনিসটি দিয়ে শুরু করতে হবে তা হল, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ব্যবহার-জনিত ধার মেটানোর মানসিকতা। দেশের সব মানুষকে জানতে হবে কোন প্রোডাক্ট, কোন কোম্পানির মালিকানা ভারতীয় নয়, কোন কোন বিদেশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান তাদের নানাবিধ পণ্য সমগ্র ভারত জুড়ে ছড়িয়ে বসে আছে। জানতে হবে এই সামূহিক বেচাকেনায় কত লক্ষ কোটি ভারতীয় মুদ্রা সেই বহুজাতিক সংস্থাগুলি তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষের মতো দেশে যদি ভারতীয় কোম্পানিগুলি সেই সব পণ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হয়, তবে এই দীর্ঘকালের বিদেশী নির্ভরতা কতটা কমবে, তারও একটি অর্থনৈতিক সমীক্ষা পাশাপাশি করা জরুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.