সেই শ্বেত শুভ্র কোমল সুন্দর শিল্পের কথা – দ্বিতীয় পর্ব


দ্বিতীয় পর্ব


মালাকার সম্প্রদায় পুষ্পজীবি। মালাকার জাতির কুলদেবী মালঞ্চী । মাঘ মাসের শুক্লা নবমীতে মালাকারগণ মালঞ্চী দেবীর পূজা করেন। এই দেবীর পূজায় বনফুল, লোধ্র , আটাং , পদ্মফুল দেবার রীতি আছে। 

মালাকারগণ পুষ্পের আভরণের সঙ্গে শোলা দ্বারা নানা শৌখিন দ্রব্য প্রস্তুত করে। তাঁদের নির্মিত গহনা , ফুল, ফল, পাখী , নানা প্রকার নকশা ইত্যাদি পাল পার্বণে বিক্রি করেন।  দেবদেবীর মূর্তি গুলি শোলার অলঙ্কারে সুসজ্জিত হয়ে ওঠে। দেবদেবীর মেড় বা চালচিত্রটিও মালাকাদের তৈরি শোলার সাজ দিয়ে সাজানো হয়। বঙ্গে বিবাহ উপলক্ষে বর , কনেকে সাজাবার জন্য মাথার শোলার টোপর , মুকুট নিৰ্মাণ করা হয়। রাঢ় অঞ্চলে বরের মাথার এই শোলার টোপরকে #মোড় বলে এবং কনের মাথায় শোলার মুকুটকে #পাতি_মোড় পরানো হয়।  রাঢ় অঞ্চলের মানুষ #গোবান্না বা গোরুর বিবাহ উপলক্ষে গাই গোরু এবং বলদের মাথায় সপুষ্প মোড় লতার গুচ্ছ দিয়ে বাঁধিয়ে দেয়। 

মালাকারগণ দেবদেবীর পূজায় যেসব অলঙ্কার প্রস্তুত করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – মুকুট, হার, বাজুবন্ধ , মেখলা, নূপুর ইত্যাদি।  পূজা উপলক্ষে চাঁদমালা অপরিহার্য বস্তু। ঝুলন, রাস , দোলৎসব উপলক্ষে বনমালা, রাশফুল ইত্যাদিও প্রস্তুত করেন। রাঢ় অঞ্চলের অন্যতম ব্রত , পূজা এবং উৎসব ভাদু ও টুসু পূজা। শোলা শিল্পী বা মালাকারগণ  টুসুর ভেলা বা ভাদুর অরূপ সব চৌদান বা চতুর্দোলা শোলা দিয়ে নিৰ্মাণ করেন। কার চৌদান ও ভেলা কত সুন্দর বা জাঁকজমক পূর্ণ  হবে সে ব্যাপারে রীতিমতো প্রতিযোগিতা লেগে যায়। বঙ্গ ও বঙ্গ সংলগ্ন অঞ্চল গুলিতে পূজা উৎসব অনুষ্ঠানে মালাকারগণের হতে নির্মিত শোলার জিনিসগুলি মাঙ্গলিক ও অপরিহার্য । 

তিন শ্রেণীর মালাকার নিয়ে মালাকার সমাজ গঠিত হয় – ১. উত্তর রাঢ়ী , ২. দক্ষিণ রাঢ়ী , ৩. বঙ্গজ। 
রাঢ়ীয় মালাকারদের মধ্যে চারিটি থাক বা উপথাক আছে – ১. সিংহাজারী  ২. শরদাপুরী ৩. মান্দারনা ৪. বর্ধমেনা।  যদিও, মালাকারদের যেমন সুদামার বংশধর বলে মনে করা হয় । তবে রাঢ়ী কুম্ভকারগণের মতো রাঢ়ী মালাকারেরা মনে করেন তাঁরা শিব দুর্গার সন্তান। তাই তাঁরা দেবী মালঞ্চীকে কুলদেবী মানেন , বিশ্বকর্মা পূজা করেন না এবং শিবরাত্রি, দুর্গা দশমী এবং সরস্বতী পূজায় কাজকর্ম বন্ধ রাখেন। পশ্চিম বঙ্গে বাঁকুড়া এবং বর্ধমান জেলার মালাকার সমাজে কিন্তু বিশ্বকর্মা পূজা হয়। যদিও বঙ্গের সর্বত্রই মালাকার সমাজে শিবের স্থান সর্বদাই বিশ্বকর্মার থেকে অনেক উঁচুতে থাকে। 

মধ্যযুগের শেষ পর্যায়ে এবং বর্তমান পূর্ব যুগে স্থানীয় জমিদারগণ মালাকারদের দরবারে ও দেবস্থানে  নিয়মিত পুষ্প সরবরাহের জন্য তাঁদের নিষ্কর ভূমি দান করতেন।  তাছাড়া মালাকারগণ  তাছাড়া বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ও পূজাপার্বনে ফুল এবং শোলার জিনিস সরবরাহ করে মূল্য পেতেন। ক্ষেত্রগবেষক , শ্রদ্ধেয় অংশুমান শেঠ মহাশয় বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটি , সিহড় ইত্যাদি গ্রামে এবং হুগলী জেলার কামারপুকুর , অমরপুর ইত্যাদির গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে ক্ষেত্র সমীক্ষা করে মালাকার সম্প্রদায় এবং শোলার কাজ সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। সেই বিবরণ থেকে জানা যায় যে , একসময় মলাকারগণ তাঁদের তৈরি শোলার সামগ্রী গ্রামবাসীদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতেন। পারিবারিক পূজা অনুষ্ঠান বা উৎসবে মালাকারাগণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে শোলার মালা ও বেলপাতা দিয়ে আসতেন।  বদলে গৃহস্থরা তাঁদের ধান বা চাল মূল্য হিসাবে দিতেন।  বিবাহের সময় বর বা কনের বাড়ির থেকে মালাকারদের গৃহে এসে এক সের চাল, একটি পান , একটি সুপারি ও টোপরের উপযুক্ত মূল্য দিয়ে টোপর নিয়ে যেতেন। 

তারপর শোলার কাজ একসময় অবধি বেশ ভালো ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিপণনের রীতির বদল হয়েছিল। মালাকারারা তাঁদের তৈরি দ্রব্যসামগ্রী শহরে বা গঞ্জের কোনো দোকানে পাইকারি  দরে বিক্রি করতেন। এখনো করেন। লোকে দশকর্মা ভান্ডার থেকে বিবাহ ও পূজাদির নিমিত্ত শোলার নির্মিত প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে থাকেন। বড় বড় শোলার ব্যবসায়ীরা গ্রামীন বড় বাজার বা ফড়েদের নিকট থেকে শোলার সামগ্রী কেনে। আবার তাঁদের থেকে ছোট শহর , গ্রাম বা দশকর্মা ভাণ্ডারীরা কিনে বিক্রি করে। এত হাত ঘুরে জিনিষ আসার নিমিত্ত স্বাভাবিকভাবেই দ্রব্যের মূল্য উচ্চ হয় এবং সেই মূল্যের একটি অংশও সেভাবে শিল্পীরা পান না। 

এই শোলা শিল্পের মূল উপাদান হল শোলা। একসময় জলজ উদ্ভিদ শোলা বর্ষাকালে বঙ্গ এবং অঙ্গের খাল, বিল, পুকুর , ডোবাতে  প্রচুর জন্মাতো। শোলার সাধারণত কোনো চাষ হয় না। এর অযত্নে বর্ধিত উদ্ভিদ। নদীয়া জেলার বটের বিলে একসময় প্রচুর শোলা জন্মাত।  ইংরেজিতে একে লিন্ও বলে। বঙ্গ এবং অঙ্গে যেসব শোলা জন্মাতে দেখা যায় পাতলা খয়েরী ছাল যুক্ত শোলা জন্মায়। শোলার আঁশ খুব হাল্কা এবং সহজ দাহ্য। বহু প্রাচীন কাল থেকে চকমকি দিয়ে শোলার আগুন জ্বালানো এবং আগুনকে সংরক্ষণ করে রাখা হতো। এসব কথা পূর্ব পর্বেই বলেছি। একটা সময় পর্যন্ত শোলা গাছের নানা অংশাবশেষ গৃহকার্য , চাষ আবাদ , যুদ্ধ বিগ্রহ একান্ত অপরিহার্য অংশ ছিল। 

শোলার নানা বিদেশি না থাকলেও এটি শোলা এবং #পিথ্ নামেই অধিক পরিচিত। শোলা জলাশয়ের উপরে ভাসমান অবস্থায় নিজেকে বিস্তার করে। শোলাগাছের ব্যাস কখনো কখনো ৪ ইঞ্চি থেকে ২০ ইঞ্চি অবধি লম্বা হয়। এর ফুল ও পাতা বাদ দিয়ে কান্ড অংশ শিল্পের উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয়। শোলা তোলা এবং সংরক্ষণ করার একটি বিশেষ পদ্ধতি আছে। জল থেকে শোলা সংগ্রহ করে শোলাগাছ গুলিকে রোদে শুকিয়ে নিয়ে পরে প্রয়োজন মতো ছোট ছোট টুকরো করা হয়ে থাকে। পাতলা অথচ খুব ধারালো ফলা বিশিষ্ট যে যন্ত্র দিয়ে শোলা মাপ মতো কাটা হয়ে তাকে কাথ বা হেতের বলে। কাথ তিন রকমের হয়  যথা – ধোসা , কালসো এবং ইস্ত্রি। আর লাগে নানা রকম মাপের লোহার কাঁটা। বলা বাহুল্য ওই সব যন্ত্র বঙ্গের কর্মকার সম্প্রদায়ের তৈরি। 


শোলার পাতলা পর্দা বা স্তরকে বলা হয় #কাপ। আর খন্ডগুলিকে বলা হয় পাতুরি। শোলার একেকটি পাতলা পাত বা স্তর ৬ থেকে ১০ ফিট পর্যন্ত দীর্ঘ হয় । আবার প্রয়োজন হলে একটি পাতের সঙ্গে আরেকটি জুড়ে ২০ থেকে ৩০ ফিট পর্যন্ত লম্বা করা যায়। সেটিকে দেখতে লাগে ঠিক গোটানোর ফিল্মের মতো। 
শোলা তোলা এবং শুকানোর ওপর এর রঙ ও কার্যকারিতা নির্ভর করে। শোলা গাছে ফুল আসতে আরম্ভ করে । ভালো শোলা পেতে গেলে এইটিই সংগ্রহ করার উপযুক্ত সময় । ফুল ধরার আগে তুললে শোলার রঙ ঠিক থাকে না। আবার ফুল হবার অনেক আগে তুললে শোলা শক্ত এবং লালচে হয়ে যায়। তখন ওই শোলা ভালো শিল্প কাজে ব্যবহার করা যায় না। শোলার রঙ সম্পূর্ণ সাদা না হলে, তা দিয়ে উৎপন্ন দ্রব্য ভালো হয় না।

 
জল থেকে তোলার সময় শোলার রঙ থাকে সবুজ। গায়ে থাকে সরু সরু কালো রঙের রোঁয়া। রোদে ভালো করে শুকালে শোলার রঙ হয় হাল্কা খয়েরী বা বাদামী। এর ভেতরের অংশ হল শাঁস , শ্বেতশুভ্র শোলা।

এই শুকনো শোলা সংরক্ষণের বিশেষ পদ্ধতি আছে। রোদে শুকনো শোলা সংরক্ষণ কররাও বিশেষ পদ্ধতি আছে।  একবার রোদে শুকিয়ে গেলে , শোলা আর রোদে রাখা ঠিক নয়।  অতিরিক্ত রোদে শোলার রঙ বদলে যায়। তাই শুকনো শোলার ঘরের ভিতরে উপযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করা হয়। বান্ডিল করে কড়িকাঠ বা মাচা থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। শোলা বছরে একবারই জন্মায় , বর্তমানে তার পরিমাণ একেবারেই কম গেছে ; কিন্তু সারাবছর শোলার কাজ হয়। তাই শিল্পীরা প্রয়োজন মতো শোলা তুলে বা কিনে ঘরে ভালোভাবে সংরক্ষণ করেন। 


আগে শোলা বঙ্গ , অঙ্গের প্রায় সব জলাভূমিতে উৎপন্ন হতো। এখন উন্নত প্রথায় মাছ চাষের ফলে পুকু, ডোবা বা অন্যান্য জলাশয় থেকে শালুক, পদ্ম, শোলার মতো জলজ উদ্ভিদ গুলি লুপ্ত হয়ে গেছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা ইত্যাদি কয়েকটি স্থানে বাণিজ্যিক ভাবে শোলার চাষ হয় ।  সেই  শোলা বান্ডিল হিসাবে বাজারে বিক্রি হয়। হাওড়া জেলার বিধাননগরে সোম এবং শুক্রবার একটি শোলার হাট বসতো ; এখনো বসে কি …. জানা নেই । শোলার আকার ও প্রকৃতির উপর এর দাম নির্ভর করে। সাধারণত ৮/১০ টি শোলা দিয়ে এক একটি বান্ডিল হয়।  সরু মোটা এবং গঠনগত মানের অনুযায়ী বান্ডিল বিক্রি হয় । সাধারণত এক একটি বান্ডিলের দাম পড়ে ১৫/২০ টাকা। সরু শোলার দাম কম , অথচ সরু শোলার বান্ডিলে অনেক বেশি শোলা থাকে। 


ক্রমশঃ
©দূর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. অনবদ্য শোলা শিল

্প২. শোলা শিল্প : ডঃ বাদল চন্দ্র সাহা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.