আদি শংকরাচায্যের আবির্ভাব নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও তাঁর আবির্ভাব যে এক যুগ সন্ধিক্ষণে হয়েছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেকুলার, মেকলেপন্থী ও বামপন্থী পাঠ্য ইতিহাস ছাত্রাবস্থায় আমাদের এটাই শিখিয়েছে যে হিন্দু ধর্মে ব্রাহ্মণবাদ , পুরোহিত তন্ত্রের দাপটে জাত-পাত,অস্পৃশ্যতা , যাগ-যঞ্জ, পশুবলি, ধর্মীয় লোকাচার ইত্যাদির বাড়-বাড়ন্তে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ যখন মুক্তির পথ খুঁজছিল তখন তথাগত বুদ্ধের আবির্ভাব। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ ধর্ম অহিংসা ও শান্তির বাণী পাথেয় করে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। গৌতম বুদ্ধ পরম্পরাগত বৈদান্তিক হিন্দু ধর্মকে আঘাত করেছিলেন একথা তাড়িয়ে তাড়িয়ে বলতে সেকুলার ও বামপন্থরা বিকৃত আনন্দ লাভ করেন। কিন্তু এটা অর্ধেক ইতিহাস। এর পরবর্তী অধ্যায় ইতিহাসে আলোচিত হয় না।
প্রথমত, গৌতম বুদ্ধের আগে পর্যন্ত পরম্পরাগত বৈদিক ধর্ম গতিশীল ছিল , সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা পরিবর্তিত হয়েছে। উপনিষদেও কর্মকাণ্ডী, দেব-দেবীর আচার-বিচার সর্বস্ব উপাসনার পরিবর্তে নিরাকার ব্রহ্ম ও উচ্চ দার্শনিক তত্ত্ব আলোচিত। আবার ভাগবতেও শ্রীকৃষ্ণ একদিকে যেমন ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবদবীর পূজা বন্ধ করে গোবর্দ্ধন পূজার প্রচলন করেছেন আবার অন্যদিকে যুধিষ্ঠিরকে রাজসূয় যজ্ঞ করতে বলে বৈদিক ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রত্যেক নবীন ভাবনা পূরনো ভাবনার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত হওয়ায় কোনও নতুন ভাবনার ফলে রাষ্ট্রজীবনে কোনও ধাক্কাই লাগেনি। কিন্তু মহাত্মা বুদ্ধ ও তাঁর থেকেও বেশি তাঁর অনুগামীরা আমাদের প্রাচীন পরম্পরার সঙ্গে কিছুই সম্বন্ধ রাখেননি। অনন্ত জ্ঞানের আধার বেদ থেকে নিজেদের মত কে পুষ্ট করার পরিবর্তে নিজেদের ধার্মিক ব্যবস্থায় বেদকে কোনও স্থানই দেননি। কর্মকাণ্ডে হিংসা দেখে তারা শুধু কর্মকাণ্ডেরই নয় বরং বেদকে সমস্ত পাপের উৎস মনে করে সেগুলিকে নির্মূল করতে উদ্যত হন। ধর্মের প্রচার সংস্কৃতের পরিবর্তে পালিতে করেন। ইশ্বর এবং বেদের প্রতি গৌতম বুদ্ধের এই উদাসিনতার ভাব তাঁর অনুগামীদের মধ্যে বিরোধে পর্যবসিত হয়। পুরনো ভাবনার সঙ্গে নতুনের সংমিশ্রণের পরিবর্তে তিনি পুরনো গাছকে সমূলে উৎপাটিত করে একটি নতুন গাছ লাগিয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি করেন যেন জাদু বলে তিনি গাছটি লাগিয়েছেন। এ রকম ক্ষেত্রে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাব সমাজে পড়া স্বাভাবিক এবং ঠিক সেটাই হয়েছিল। বৌদ্ধ মতও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যায় , এমন কি পরম্পরাগত হিন্দু চিন্তন, দর্শন ও বৌদ্ধ মত পরস্পর বিরোধী হয়ে যায়।
বৌদ্ধরা আমাদের প্রাচীন পরম্পরাকে বিনষ্ট করে এবং তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল আমাদের পূর্বপুরুষ শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণের কোনও গুরুত্ব জনজীবনে থাকল না। নিজের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে যখন অশ্রদ্ধার ভাব তৈরি হয় এবং স্বভূমিও যখন গুরুত্বহীন হয়ে যায় তখন বিজাতীয় বা অরাষ্ট্রীয় ভাবনা উৎপন্ন হওয়া স্বাভাবিক। আপনত্বের ভাবনা নিয়ে যখন বৌদ্ধরা বিদেশে যায় এবং সেখানকার মানুষদের জ্ঞান দেয় তখন তাঁদের কিছু ভাবনা ও স্বভাবও তাঁরা আপন করে নেয়। শুধু এটুকুই নয়,ধীরে ধীরে তাঁরা স্বদেশবাসীদের তুলনায় নিজেদের ধর্ম-বান্ধবদের বেশি আপন মনে করতে থাকে। বিদেশি আক্রমণকারীরাও তাঁদের এই বিজাতীয় মনোভাবের লাভ ওঠায়। তাঁদের অনেকেই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং বৌদ্ধরাও এই দেশের স্বাধীনতা হরণকারী ওই সব ধর্ম-বান্ধবদের আপন করে নেয়। এমন কি বিধর্মী বিন কাশেমের হাতে সিন্ধুরাজ শৈব দাহিরের পরাজয়ের পিছনে বৌদ্ধদেরই হাত ছিল। অর্থাৎ সেই সময় বৌদ্ধরা যেন এক অত্যাচারী শ্রেণির পোষ্যপুত্র হয়ে গিয়েছিল এবং জাতীয়তার ঊচ্চ স্তর থেকে নেমে গিয়ে অহিন্দু স্বরূপ ধারণ করেছিল।
দ্বিতীয়ত, প্রকৃত অর্থে বৌদ্ধ মত ছিল গৌতম বুদ্ধের আলোয় আলোকিত একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক সম্প্রদায় (Religion)। বুদ্ধের মহাপ্রয়াণের পর তা ধীরে ধীরে একটি State sponsord Religion বা রাজানুগ্রহ প্রাপ্ত সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। অশোক নিজে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করে প্রজাদেরও তাঁর অনুগামী হওয়ার জন্য দেশে-বিদেশে তার প্রচার শুরু করেন ,বৌদ্ধ মঠকে আর্থিক- অনুদান সহ অন্যান্য সাহায্য – কিছুই বাকি ছিল না। ভারতের শাশ্বত বাণী ‘একম্ সদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি বা সত্য এক, জ্ঞানীরা তাঁকে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেন’ বা অতি সহজ ভাবে বললে ‘যত মত তত পথ’-কে অস্বীকার করে অশোক নির্দিষ্ট একটি মত ও পথকেই একমাত্র প্রাধান্য দিয়েছিলেন ও সম্পূর্ণ রাজশক্তিকে তার প্রচারের কাজে লাগিয়েছিলেন। তাই , সেই অর্থে দেখলে অশোকই ভারতের প্রথম সাম্প্রদায়িক সম্রাট,তাঁর পরবর্তী বহু বৌদ্ধ শাসক এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।
নিরন্তর এরকম রাজানুগ্রহ, প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতা লাভ করে, বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। গড়ে উঠে এক সুবিধা ভোগী শ্রেণী ও নতুন পুরোহিত তন্ত্র। ধীরে ধীরে শুরু হয় ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের পরিবর্তে বৌদ্ধতন্ত্রের বাড় বাড়ন্ত। হিন্দু সমাজের কর্ম ভিত্তিক বর্ণ ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে ‘অহিংসা-র নামে প্রাণী হত্যা’ বা ‘আমিষ’ ভোজন নিষিদ্ধ করা হয়। অস্ত্র চর্চা নিষিদ্ধ করা হয় – যা দেশ-ধর্ম রক্ষার সক্রিয় ক্ষত্রিয়দের অবশ্য কর্তব্য ছিল। অর্থাৎ কালক্রমে সমাজ ক্লীবত্ব প্রাপ্ত হয়। বীর সাভারকার তাঁর ‘ভারতীয় ইতিহাসের ৬ টি স্বর্ণোজ্জল অধ্যায়’-এ এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
শংকরের আবির্ভাবের সময় (১) বৌদ্ধ প্রভাবে হিন্দু জাতি ক্লীবত্ব প্রাপ্ত। (২) গুপ্ত যুগ শেষ হওয়ার পর ভারতে তখন কোনও শক্তিশালী সম্রাট না থাকার সুযোগ নিয়ে ব্যাকট্রিয়, গ্রীক ও মধ্য প্রাচ্যের বর্বর জাতিগুলির ভারত আক্রমণের আশংকা। এ রকম অবস্থায় বৌদ্ধ মতের উম্মূলন এক রাষ্ট্রীয় কর্তব্য হয়ে উঠল। সেই সময়েই আদি শংকরের আবির্ভাব। তিনি কিন্তু কোনও আক্রোশ বশত বৌদ্ধ মতের উচ্ছেদ লিপ্ত হননি বরং ইতিবাচক দৃষ্টি নিয়ে সেই পরিবর্তন সম্পন্ন করেছেন। গৌতম বুদ্ধের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা নিয়ে তাঁকে বিষ্ণুর দশম অবতার ঘোষণা করেছেন। বৌদ্ধ মতের সঙ্গে বৈদান্তিক মতের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। সাধন-ভজনের বিভিন্ন মত ও পথে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন, পরস্পর বিরোধী সন্ন্যাসী সমাজের মধ্যে অনুশাসন ও সংহতি আনার জন্য ‘দশনামী’ সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেছেন, নিজে অদ্বৈতবাদী হওয়া সত্ত্বেও চারটি মঠে – গোবর্ধন মঠে (বিষ্ণু,ভৈরবী), শৃঙ্গেরি (শিব, সরস্বতী ), জ্যোতির্মঠ (নরসিংহ) ও দ্বারকায় সারদা ও চন্দ্রমৌলির মূর্ত্তি স্থাপন করে বিষ্ণু,শিব ও শক্তি – সব রূপেরই আরাধনার ব্যবস্থা করেছেন। পঞ্চায়তন পূজার মাধ্যমে পুরোহিত তন্ত্রকে নস্যাৎ করে ইষ্টদেবতা রূপে বিষ্ণু,শিব,দুর্গা,গণেশ ও সূর্য্যের মধ্যে যে কোনও এক দেবতার পূজায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহনকে উৎসাহিত করেছেন। শংকরের এই প্রচেষ্টার ফলে ভারতে হিন্দুত্বের নবজাগরণ শুরু হয়। সমাজে আবার ক্ষাত্র তেজ ফিরে আসে। যদিও গান্ধার ও পূর্ববঙ্গ ( অধুনা বাংলাদেশ ) যেখানে বৈদান্তিক হিন্দু চিন্তন খুব বেশি শিকড় গজাতে পারেনি সেখানে বৌদ্ধ প্রভাব থেকেই যায়। পরে ইসলামি আক্রমণের সময় ক্লীবত্ব প্রাপ্ত বৌদ্ধ ও বৈষ্ণবরা হয় কচুকাটা হয় না হলে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়। অথচ হিন্দুরা প্রায় বারোশ বছর ধরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে না হলে অন্যান্য দেশের মতো বা ভারতের বৌদ্ধদের মতো ভারতের সকলকেই ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে হতো। অর্থাৎ শংকরের আবির্ভাবের ফলে যদি হিন্দুত্বের নবজাগরণ না হয়ে ভারতীয়রা বৌদ্ধ প্রভাবেই থাকত তবে এটা নিশ্চিত যে বর্বর মোঘল-পাঠানদের আক্রমণের মুখে সারা দেশই ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে যেত। শংকরের পূর্ববর্তী মহাপুরুষরা হিন্দু সমাজের মধ্যেকার পাপ, অন্যায় ও ধর্মের গ্লানি দূর করেছেন। কিন্তু শংকর তো হিন্দু সমাজকে বাহ্যিক ও বিধর্মী আক্রমণের অসহায় শিকার হওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন। এ জন্য তাঁর চরণে শত কোটি প্রণাম।
সুব্রত ভৌমিক