ঋতুচক্রের আবর্তনে আসে গ্রীষ্ম,বর্ষা,শরৎ ঋতু। এই শরৎকালেই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা। বাস্তবিকই দুর্গা পূজা বাঙালির প্রাণের পূজা। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অন্যান্য বছরের মতো এবছর উৎসবের জৌলুস কমলেও উৎসবের আনন্দ থেকে আম বাঙালি নিজেদের বঞ্চিত করছে না

বঙ্গদেশে দুর্গাপূজার প্রচলন সম্বন্ধে আলোচনা করতে হলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে। মার্কন্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীশ্রীচন্ডীতে (১২/১২) শরৎকালে দুর্গাপূজার কথা স্বয়ং দেবীই বলেছেন, “শরৎকালে মহাপূজা ক্রিয়তে যা চ বার্ষিকী।” তাহলে বঙ্গদেশে দুর্গাপূজা কোন সময় থেকে? মূল বাল্মীকি কৃত রামায়ণে রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার উল্লেখ নেই। অবশ্য বামণপুরাণ, দেবীভাগবত পুরাণ, কালিকাপুরাণে রামচন্দ্রের পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমান যে মৃন্ময়ী মূর্তি পূজিতা হন, তা নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে প্রচলন হয়।

স্মার্ত রঘুনন্দন ভট্টাচার্য মহাপ্রভু চৈতন্যের সমসাময়িক ছিলেন। রঘুনন্দন দুর্গোৎসব তত্ত্বে লিখেছেন “তত আচারাদপরাজিতালতাবদ্ধাং নবপত্রিকাং বিল্বশাখাঞ্চ স্থাপয়িত্বা।” কোনো ক্রিয়াই অল্পদিনের আচরণে সারাদেশ জুড়ে আচারে পরিণত হতে পারে না। পন্ডিত শূলপাণি ‘দুর্গোৎসববিবেক’-এ বলেছেন “শক্রধ্বজাৎ পক্ষযুতে দশাহে মূলর্ক্ষযুক্তা সতসপ্তমী যা।/আরভ‍্য তস‍্যাং দশমীঞ্চ যাবৎ প্রপূজয়েৎ পর্বতরাজপুত্রীম্।।” অর্থাৎ ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের দ্বাদশী থেকে পঁচিশটি তিথি অতিক্রান্ত হলে মূলানক্ষত্রের শুক্লপক্ষর সপ্তমীতে পর্বতরাজকন্যার পূজা আরম্ভ করে দশমী পর্যন্ত তা সম্পন্ন করবে।

জিকন-বচন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এখনও পর্যন্ত বাংলায় প্রচলিত সপ্তম‍্যাদি কল্পের কথাই বচনে বলা হয়েছে। জিকন বাঙালী ছিলেন বলেই অনুমান করা যায়। স্মার্ত রঘুনন্দন দুর্গাপূজাতত্ত্বে বৃহন্নন্দিকেশরপুরাণ থেকে বচন উদ্ধৃত করে সপ্তম‍্যাদিকল্প পূজার কর্ত্তব‍্যতা নির্ধারণ করেছেন। এই বচনগুলি দেবীর নিজের উক্তি। বচন গুলির মধ‍্যে আছে “মূর্ত্তির্ম্মে পুত্রায়ুর্দ্ধনবৃদ্ধয়ে”।

প্রসিদ্ধ বৈষ্ণবপদকার মৈথিল পন্ডিত বিদ‍্যাপতি ১৩৯৩ শকাব্দ হতে ১৪০১ শকাব্দের মধ‍্যে দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী রচনা করেন। রঘুনন্দনের অল্পপূর্বেই ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’ রচিত হয়। রঘুনন্দন স্বনিকৃতনিবন্ধে দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণীর অনেক উক্তি ও মত উদ্ধৃত করেছেন।

পরবর্তী কালে বাঙালী কবি কৃত্তিবাস ওঝা ১৪৬০ খৃষ্টাব্দে বাঙলায় রামায়ণ রচনা করেন। তিনি সেই সময় তাহিরপুরের রাজসভার রাজা কংসনারায়ণের সভাকবি ছিলেন। রাজার অনুরোধে তিনি বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত রামায়ণের অনুসরণে বাংলা রামায়ণ রচনা করেন। তাঁর রচিত বাংলা  রামায়ণে অকাল বোধনের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই তিনি বলছেন “শ্রীরাম আপনি কয় বসন্ত শুদ্ধসময়”। অন‍্যদিকে রাজা কংসনারায়ণ কোনো মহাযজ্ঞের আয়োজন করতে চাইলে পন্ডিত রমেশ শাস্ত্রী তাঁকে রাজসিক ভাবে দুর্গোৎসবযজ্ঞ করার পরামর্শ দেন, কারণ কলিতে দুর্গোৎসবই প্রাচীনকালের অশ্বমেধ যজ্ঞের সমতুল‍্য। এই ভাবে কলিযুগে বঙ্গদেশে তখনকার দিনে সাড়ে আট লক্ষ টাকা ব‍্যয়ে অকালবোধনের মাধ‍্যমে শারদীয়া দুর্গার মৃন্ময়ী প্রতিমায় পূজারম্ভ হয়। পরবর্তীকালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, ইংরাজ শাসনকালে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের দুর্গাপূজার  কথা শোনা যায়।

দিন বদলানোর সাথে সাথে বাঙালির ভাবনায় এলো পরিবর্তন।কখনো মাতৃরূপে, কখনো কন‍্যারূপে বৎসরান্তে পিতৃগৃহে আসেন।আগমনী গানের মধ্যে  দিয়ে করি তাঁর বন্দনা
যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী
উমা আমার কত কেঁদেছে
।”
এবার আমার উমা এলে
আর উমায় পাঠাবো না ।
বলে বলবে লোকে মন্দ
কারো কথা শুনবো না
।”
 
(শ্রী অরিন্দম মজুমদার, প্রান্ত সহ স‌ংযোজক, শিক্ষা  সংস্কৃতি উত্থান ন‍্যাস পশ্চিম বঙ্গ প্রান্ত)

অরিন্দম মজুমদার (Arindam Majumdar)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.